প্রথম যখন ২০০৭ সালে আইফোন এলো, তখন অনেকেই ধারণা করে উঠতে পারেননি যে একদিন স্মার্টফোনের রাজত্ব গড়ে তুলতে পারবে ফোনটি। অনেকে তখনও সাধের ফ্লিপ-ফোন বাদ দেওয়ার কথা চিন্তাই করেননি। প্রায় একই ঘটনা কিন্তু গুগলের অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অ্যান্ড্রয়েড ফোন যখন বাজারে পা রাখে তখনও ব্ল্যাকবেরির বাজার চাহিদা বেশ ভালো। দেখে মনেই হয়নি ব্ল্যাকবেরির সামনে দাঁড়াতে পারবে অ্যান্ড্রয়েড।
পরে ২০১০ সালে আইফোন ৪ নিয়ে এলো অ্যাপল। ওই আইফোন মডেলেই বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো দেখলো উচ্চ-রেজিলিউশন ক্ষমতাসম্পন্ন পর্দা, আধুনিক ডিজাইন ও ফোনের সম্মুখভাগে ক্যামেরা। ব্যস, আমাদের ভাগ্য বদলে গেল। বাজার ছেয়ে গেল ওই ধরনের নকশা সম্বলিত ফোনে। এখন ওই নকশার ফোন বাদে অন্য কোনো স্মার্টফোন চোখেই পড়ে না। ২০১৯-এ অবশ্য ফোল্ডএবল আসার পর গতানুগতিক স্মার্টফোন নকশায় খানিকটা পরিবর্তন এসেছে।
শুধু যে নকশা বা প্রযুক্তির হিসেবে আমরা লাভবান হয়েছি, তা নয়। আমাদের জীবনযাত্রা ও সমাজেও বড় রকমের প্রভাব ফেলেছে স্মার্টফোন। এখন স্মার্টফোনকে কেন্দ্র করে এবং ইন্টারনেটকে পুঁজি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নানাবিধ ব্যবসা ও সেবা।
এক দশকেই আমাদের জীবনকে নতুন এক পথের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে স্মার্টফোন। সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের আলোকে চলুন জেনে নেই বিভিন্ন খাতে স্মার্টফোনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রসঙ্গে।
অর্থনীতিতে
ক্যানালিস রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে পাঁচশ’ কোটি স্মার্টফোন ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১০ সালে বিশ্বে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৩০ কোটি। এখন ওই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২০ কোটিতে। সবমিলিয়ে এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে বিশ্বে বর্তমানে মোট মানুষের চেয়ে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা বেশি। স্বাভাবিকভাবেই স্মার্টফোনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসা ও সেবা।
অর্থনীতিতে বেশ দৃঢ় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে স্মার্টফোন। এক সময়ের কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপল এখন বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী প্রতিষ্ঠান। এর পেছনে অনেক বড় অবদান রয়েছে আইফোনের। শুধু অ্যাপল নয়। ফরচুন ৫০০ তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে শীর্ষ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষ্ঠান। অ্যাপল, অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট এবং ফেইসবুকের সম্মিলিত বাজার মূলধন চার লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার। অথচ ২০১০ সালেও ফরচুন ৫০০ তালিকার শীর্ষে থাকা পাঁচ প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত বাজার মূলধন ছিল ৮০ হাজার কোটি ডলার। স্মার্টফোন কিন্তু এই মূলধনের মাত্রা বাড়াতেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে।
বাণিজ্য গ্রুপ জিএসএমএ’র তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৮ সালেই বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি খাত থেকে আয় হয়েছে চার লাখ কোটি ডলার।
হাতের কাছে অ্যাপ
আমরা এখন যা-ই করি না কেন, তার জন্য রয়েছে অ্যাপ। গাড়ি ডেকে পাঠাতে, খাবার অর্ডার করতে, গান শুনতে, কোনো কিছু কিনতে, এমনকি সঙ্গী খুঁজতেও এখন অ্যাপ ব্যবহার করে থাকেন মানুষ। বিনামূল্যের অ্যাপ ব্যবহারের পাশাপাশি পয়সা খরচ করেও অ্যাপ ব্যবহার করে থাকেন মানুষ।
মোবাইল অ্যাপ বিশ্লেষণী সংস্থা অ্যাপ অ্যানির তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে মানুষ অ্যাপের মাধ্যমে ১২ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করেছেন।
স্মার্টফোন না এলে এরকমটি হত কিনা সন্দেহ।ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম অ্যাপে ঘন্টার পর ঘন্টা স্ক্রল করা এখন খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মানুষ এখন যত আপডেট পায়, তার চেয়েও বেশি আপডেট চায়।
গবেষণা সংস্থা ইমার্কিটারের তথ্য অনুযায়ী, মানুষ এখন সোফায় বসে সরাসরি সম্প্রচার দেখেন কম, স্মার্টফোন চালান বেশি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টিভি বিজ্ঞাপনের আয়কে ছাড়িয়ে গেছে মোবাইল বিজ্ঞাপনের আয়।
ইন্সটাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার, সেক্সটর্শন এবং ভুয়া খবরেও কিন্তু বেশ বড় ভূমিকা রাখছে স্মার্টফোন।
স্মার্টফোন ক্যামেরার দিকে হাসি
গত দশকের শেষেও ছিল ডিজিটাল ক্যামেরার জয়জয়কার। ‘ক্যামেরা অ্যান্ড ইমেজিং প্রডাক্টস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ডিজিটাল ক্যামেরা বিক্রি হয়েছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ইউনিট। অথচ ২০১৯ তা কমে মাত্র এক কোটি ৯০ লাখ ইউনিটে এসে ঠেকেছে।
এর মূল কারণ, স্মার্টফোনের ক্যামেরা। এখন মানুষ স্মার্টফোন ক্যামেরাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেলফি এখন নিত্যদিনের বিষয়। গুগলের তথ্য অনুয়ায়ী, প্রতিদিন গড়ে ৯ কোটি ৩০ লাখ সেলফি তোলা হয় অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসের মাধ্যমে।
কোথায় আছি
স্মার্টফোন আমাদের দিক নির্দেশনার হিসেবটিও বদলে দিয়েছে। ম্যাপস ও জিপিএসের মাধ্যমে এখন আমরা নিমিষেই জেনে নেই কোথায় রয়েছি, কোথায় যাবো, কীভাবে যাবে ইত্যাদি তথ্য।
গোপনতার আলোকে চিন্ত করলে বিষয়টি খুবই খারাপ হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে দিচ্ছি আমরা। আবার ভিন্ন দিকে থেকে ভাবলে, আমাদের অনেক মূল্যবান সময় বাঁচিয়ে দিচ্ছে এই প্রযুক্তি।
স্মার্টফোন না এলে কিন্তু দেখা মিলত না এই প্রযুক্তির।
খোঁজ করে জানা
এখন আর কোনো কিছু জানতে লাইব্রেরিতে ছোটা লাগে না। হাতের ফোন থেকে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় হানা দিলে নিমিষেই বের হয়ে আসে অনেক তথ্য। ভুল তথ্যের হিসেবটিকে আমলে না নিলে বিষয়টি কিন্তু খারাপ নয়। রয়টার্স উল্লেখ করেছে প্রতিদিন ২৪ কোটি মানুষ হানা দেয় অনলাইন বিশ্বকোষ খ্যাত উইকিপিডিয়া সাইটে।
এর পেছনেও ভূমিকা রয়েছে স্মার্টফোনের।
অমনোযোগিতা ও মৃত্যু
স্মার্টফোনে এখন মানুষ এতটাই আসক্ত থাকে যে চারপাশে কী হচ্ছে তা ভুলে যায়।
ন্যাশনাল হাইওয়ে ট্রাফিক সেইফটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনএইচটিএসএ) তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৮ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে দুই হাজার ছয়শ’ ২৮টি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে অমনোযোগীতাকে। আর ওই দুর্ঘটনাগুলোর ১৩ শতাংশই ঘটেছে স্মার্টফোনে ব্যস্ত থাকার কারণে।
ওয়ালেট ভুললেও ক্ষতি নেই
আমাদের দেশে এখনও ওভাবে শুরু না হলেও অনেক দেশেই কিন্তু মোবাইল লেনদেন খুব বেশি চলছে। গতানুগতিকভাবে ওয়ালেটে পয়সা নিয়ে ঘেরার চেয়ে এখন আলিপে, উইচ্যাট পে বা অন্য মাধ্যমে মোবাইল দিয়ে অর্থ লেনদেন করতেই মানুষ বেশি আগ্রহী।
স্মার্টফোন না এলে এত দ্রুত হয়তো চোখে পড়ত না ঘটনাটি।
বদলে গেছে
স্মার্টফোন আসার পর বদলে গেছে অনেক কিছুই। মানুষ এখন আগের উপায়ে অনেক কাজ না করে, নতুন বিকল্প উপায় খুঁজে নিতেই পছন্দ করেন বেশি। মানুষ এখন আর আগের মতো ফোনে কথা বলতে পছন্দ করেন না। প্রায় সবাই এখন গতানুগতিকভাবে কথা বলার চেয়ে জিফ, ইমোজি, ভিডিও কল’কেই প্রাধান্য দেন বেশি।
আর তাই হয়তো, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোবাইল ডেটা ব্যবহার বেড়েছে প্রায় নয় গুণ। এদিকে, ২০১০ সালের তুলনায় ইমোজি’র পরিমাণ বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।