একবিংশ শতাব্দীর স্বাস্থ্যখাতে অবিস্মরণীয় উৎকর্ষতার যুগেও আমরা মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের কাছে আজ বড় অসহায়। মাত্র তিন মাসে কোন ধরনের যুদ্ধ বিগ্রহ, গোলাগুলি বা পারমানবিক বোমার আক্রমণ ছাড়াই দেড় লাখের বেশি মানুষ আজ মৃত। শুধু তারাই যে মারা গেছেন এমনটা নয়; মৃতদের সংস্পর্শে আসা বেশিরভাগ মানুষ আজ কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিনই বাড়ছে লকডাউন। ২১০টির বেশি করোনা আক্রান্ত দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশেও করোনা রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর এই দুঃসময়ে যে খাতটি এখনো যোগাযোগ, লেনদেন, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য, শিক্ষা, গণমাধ্যমসহ সবগুলো খাতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে সেই খাতটির নাম তথ্যপ্রযুক্তি।
বিশ্বায়নের এই যুগে লকডাউনের কঠিন মুহূর্তকেও আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলপ্রসু করে তুলেছি। কিন্তু সত্যিই কি ভালো আছে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠন থেকে শুরু করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাঝারি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা? ২০০৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর লাখো তরুণ-তরুণী স্বল্প পূঁজি নিয়ে অথবা খালি হাতে নিজের মেধা এবং সৃষ্টিশীল মনোভাবের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে এই খাতকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে এসেছিল। তারুণ্যের অহংকার প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা এবং সুদূর প্রসারী নেতৃত্বে তরুণ-তরুণীরা কঠিন কঠিন প্রতিবন্ধকতাগুলো টপকে গেছে। তাই তাদের প্রতি দেশের দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জয়যাত্রায় মাত্র ১০ বছরেই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রুপকল্প’ অর্জন করে আন্তর্জাতিক সম্মাননা। আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভ্যানে আইসিটির অলিম্পিক খ্যাত ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব আইটি-তে (ডব্লিউসিআইটি) চেয়ারম্যান অ্যাওয়ার্ডটি গ্রহণ করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে মাত্র এক বছর পরেই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি সংগঠন বিসিএস এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে দেশে অনুষ্ঠিত হবে তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্ব সম্মেলন (ডব্লিউসিআইটি ২০২১)। তথ্যপ্রযুক্তির এই মহা সম্মেলনে এগিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো আমরা সারাবিশ্বকে জানানোর একটি সুযোগ পাবো। কাজেই এই সময়টি আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮৭ সালে মাত্র ১১ জন সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নেতৃত্ব দেয়া সবচেয়ে পুরাতন এবং বর্তমানের সর্ববৃহৎ সংগঠন। ২ হাজার ৩১১ জন সদস্যের প্রত্যেক বিভাগে নিজস্ব শাখা কার্যালয় স্থাপন করে এই বৃহৎ সংগঠনটি সারাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসার এবং জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিসিএস এর সঙ্গে এই যাত্রায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্য) এবং ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় ১০ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আইসিটি খাতের সঙ্গে জড়িত। বিসিএস সদস্যদের রয়েছে প্রতিটি তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। প্রতিটি সংগঠন দেশের তথ্যপ্রযুক্তিকে খাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বাংলাদেশকে আইসিটি পণ্যের উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত করতে ও এই খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার উপার্জনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিনিয়ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে হঠাৎ বদলে গেছে দৃশ্যপট। সারা বাংলাদেশ জুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিপণন কেন্দ্র, হাইটেক পার্ক, জনতা সফটওয়্যার পার্কসহ তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে যখন দম ফেলার ফুসরত পাচ্ছিল না তখন হঠাৎ করেই এই বিশাল কর্মযজ্ঞ স্থবির হয়ে গেলো।
দেশের ক্রান্তিকালে ব্যাংকিং সেবার পূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে অটোমেটিক টেলার মেশিন(এটিএম) বুথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ঘরবন্দী মানুষদের স্বাস্থ্যসেবায় টেলিমেডিসিন সেবা এবং আইটি সংক্রান্ত প্রতিটি কাজেই হার্ডওয়্যার পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানিকারক দেশ থেকে আইসিটি সেক্টরে আমরা রফতানি নির্ভর এবং নিজের দেশেই সংযোজন এবং উৎপাদনের কার্যক্রম পরিচালনা করছি। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগানে আমরা এখন নিজেদের তৈরি স্মার্টফোন ব্যবহার করছি। কম্পিউটারের মাদারবোর্ড এবং র্যাম তৈরিতেও আমরা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছি। হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি সফটওয়্যার, আউটসোর্সিং, কল সেন্টারের মাধ্যমে আমাদের সেবার খাত নেহায়েত ক্ষুদ্র নয়। প্রতিবছর শুধুমাত্র আইসিটি হার্ডওয়্যার থেকে আমরা প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা করছি। বেকারত্বের অবসান ঘটাতে নিত্যনতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, উদ্যোক্তা বানানোর প্রচেষ্টা এবং বাসায় থেকেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অনলাইন ব্যবসা করার প্রয়াস এই খাতের কারণেই সহজ হয়েছে। কাজের পাশাপাশি বিনোদনেও রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবদান। শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস ব্যবস্থা প্রণয়ণেও তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
করোনার কারণে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারাদেশে লক-ডাউন অবস্থায় জরুরি কার্যক্রমের অধিকাংশই হার্ডওয়্যার পণ্য বা কম্পিউটার দিয়ে অনলাইনে চলছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির সব সেবা এককভাবে অনলাইনে দেয়ার সুযোগ নেই। জরুরি সেবায় এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক্সপার্টকে হার্ডওয়্যার সরবরাহের পাশাপাশি ইন্সটলেশন এবং নিজে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হয়। ব্যাংকের এটিএম বুথ নষ্ট হয়ে গেলে অনলাইনে হার্ডওয়্যার ঠিক করার সুযোগ নেই। হার্ডওয়্যার সংক্রান্ত পণ্যগুলো যদি হঠাৎ বিকল হয়ে যায় সেক্ষেত্রেও টেকনিশিয়ানকে নিজে গিয়ে স্বশরীরে সমাধান করতে হয়। তাই এই খাতকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জরুরি চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকদের এই দিকটিতে বিশেষ নজর দেয়া উচিৎ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন তার জন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মহাসংকটের সময়কে কাটিয়ে তুলতে এই প্রণোদনার অংশ করা হবে বলেই আমার বিশ্বাস। ইতোমধ্যে করোনার নেতিবাচক প্রভাব এই সেক্টরে দৃশ্যমান। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের সম্ভাব্য বিল এবং ওয়ার্ক অর্ডার পাচ্ছে না। রপ্তানির সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা বিরাজ করায় তাদের কাজের পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০-৮০ শতাংশ কমে গেছে। স্থানীয় বাজারেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করায় এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিপুল সংখ্যক জনবলের বেতন, অফিস ভাড়া, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন বিনিয়োগ করে যে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি করেছে তা এই খাতের উন্নয়নের জন্য একটি অতি আবশ্যকীয় উপাদান। ধারণা করা হচ্ছে, এ অবস্থা বিরাজমান থাকলে দক্ষ জনশক্তি হারানোর আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। সরকারের আন্তরিক ভূমিকা ব্যতীত প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনগুলোর একক প্রচেষ্ঠায় এই ক্রান্তিকালে টিকে থাকা চ্যালেঞ্জের বিষয় বটে।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন দৃশ্যমান। এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে আমরা চাই সরকার বরাবরের মতো আমাদের পাশে থাকুক। আমাদের উদ্যোক্তাদের সাহস দিতে এই খাতে প্রণোদনার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনসহ প্রযুক্তি খাতে কর্মরতদেরআগামী ৬ মাসের আংশিক বেতন ও অফিস ভাড়া পরিশোধপূর্বক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য কেবলমাত্র বেতন বাবদ ১৫৬০ কোটি ও অফিস/শো-রুম/ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ ৩৭০ কোটিসহ মোট ১৯৩০ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করা হোক। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে অনুদানের পাশাপাশি সহজ শর্তে ৫ বছর মেয়াদী ২ শতাংশ সুদে জামানতবিহীন ঋণ দেয়া প্রয়োজন। যে ঋণ গ্রহণের এক বছর পর থেকে শোধের সময় শুরু হবে।
১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করার পর কম্পিউটারের উপর আমদানী শুল্ক প্রত্যাহার করেছিলেন। আক্ষরিক অর্থে সেসময় শুল্ক খাতে শকোটি টাকার ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিলেও শুধু একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত পুরো দেশকে আজ ডিজিটাল করতে ভূমিকা রেখেছে। এখন আমরা গর্ব করে আমাদের আইসিটি খাতের অগ্রযাত্রার গল্প পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে পারি। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এই দুঃসময়ে সরকার আন্তরিক হয়ে প্রণোদনা এবং ঋণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করলে আমরা এই খাতকে আরো বেশি লাভজনক খাতে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হবো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই খাতের উপর আস্থা রাখেন বলেই আমার বিশ্বাস। আমরা আশা করবো, জননেত্রী শেখ হাসিনা পূর্বের ন্যায় বর্তমানেও আইসিটি শিল্পের এই দুঃসময়ে আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। যেই আস্থা এবং ভালোবাসায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রুপকল্প’কে লাখো তরুণ-তরুণী বুকে ধারণ করে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, সরকারের সহযোগিতায় আমরা সবাই মিলে এই দুঃসময় কাটিয়ে ভিষন ২০৪১ বাস্তবায়নে একসাথে কাজ করে যেতে পারবো। আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ে বলতে পারি, তথ্যপ্রযুক্তি খাত দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময়ী একটি খাত। ভিষন ২০৪১ পূরণে আমরাই হবো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস)