দেশি পণ্যের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে এই প্রথম বিভাগীয় ওয়েভ চালু করেছে উইমেন এন্ড ই-কমার ফোরাম (উই)। পহেলা জুন থেকে সিলেট বিভাগের নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ফেসবুকে আয়োজন করা হয় সিলেটি ওয়েভ।
ই-কমার্সের মাধ্যমে স্থানীয় পণ্য গুলো দেশ ও দেশের বাহিরে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। এ গ্রুপের ৮০% নারী ও নতুন উদ্যোক্তা। এখানে বিক্রি বা প্রমোশন পোস্ট দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও থেমে নেই ক্রয়-বিক্রয়। নিয়মিত পোস্ট, কমেন্টের মাধ্যমে সক্রিয় থেকে নিজেদের পরিচিতি ও আস্থা তৈরি করার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় এ গ্রুপে। তাই ফ্রিতে এ সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না দেশি পণ্যের উদ্যোক্তারা। সেলেট বিভাগের নারী উদ্যোক্তা ও তাদের পণ্যের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য মূলত উদ্যোগ নেওয়া হয় সিলেটি ওয়েভের।
সিলেটি ওয়েভের ১৫ জন নারী উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে- পহেলা জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত উই গ্রুপ থেকে মোট অর্ডার এসেছে ১৯২৭ টি। তাদের ভাষ্য মতে জ্ঞান, দক্ষতা, প্রমোশন, বিক্রি সহ সবদিকে ফ্রিতে এগিয়ে দিলো এ ওয়েব।
চিরাচরিতের উদ্যোক্তা সুলতানা ভূইয়া কাজ করেন বেতের তৈরি পণ্য নিয়ে। তিনি বলেন- ওয়েভ শুরু হওয়ায় হঠাৎ করে মেসেজে ভরে গেলো ইনবক্স। একসাথে সর্বোচ্ছ ৩০ জনকে রিপ্লাই দিতে হয়েছে এতে দ্রুত রিপ্লাই, অর্ডার কনফার্ম করা সহ ই-কমার্স বাস্তব অভিজ্ঞতা বেড়েছে।
সুনামগঞ্জের উদ্যোক্তা কৃষ্টি রায়ের উদ্যোগের নাম সাত্তিক। তিনি কাজ করেন মূলত দেশী শাড়ী ও থ্রি পিস নিয়ে। তিনি বলেন সিলেটি ওয়েভে আমার পরিচিতি ও সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়েছে।
ফিজেত এর উদ্যোক্তা নিন্দীয়া সিনহা সিলেট থেকে মনিপুরী পণ্য নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলে- মহামারি করোনা ভাইরাসের লকডাউনের কারণে পণ্য সংগ্রহ করে ক্রেতার কাছে পৌছে দেওয়া ছিলো মূল চ্যালেঞ্জ। ক্রেতাদের আন্তরিক সহযোগীতায় সুন্দর ভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি।
সিলেটের উদ্যোক্তা মিম রয়ের উদ্যোগের নাম দিবানিতা এক্সক্লুসিভ। কাজ করেন মূলত সিলেটের বিখ্যাত সাতকরা ও হাতের তৈরি দুধের ক্ষীরসা নিয়ে। তিনি বলেন এই করোনার সময়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। ওয়েভের ফলে সংসারের খরচ দিতে পেরেছি।
মমতাজ ফারিয়া বলেন- আমার উদ্যোগের নাম মনফড়িং। আমি হাতে তৈরি গহনা এবং কাগজের সামগ্রী নিয়ে কাজ করি। লকডাউনের কারণে উৎপাদন সামগ্রী সংগ্রহ করা এবং কুরিয়ারে পার্সেল বুকিং করা আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিলো। ধাপেধাপে তা মোকাবেলা করতে সক্ষম হই।
ঝিয়ারীর উদ্যোক্তা রোজিনা আক্তার কাজ করেন সিলেটের চা নিয়ে। তিনি বলেন ওয়েভ থেকে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা আমার ক্যারিয়ার গঠনে দারুণ ভুমিকা রাখবে, উই থেকে উদ্যোগ না নিলে হয়তো সারাজীবনেও বাস্তবসম্মত ই-কমার্সের এমন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতাম। যেখানে ক্রেতারাও সাপোর্ট করে আন্তরিকতার সাথে।
ত্রিনয়নীর উদ্যোক্তা স্বর্ণা দাস। কাজ করেন মাটির তৈরি জিনিস নিয়ে। তিনি বলেন নিজস্ব প্রোডাক্ট সোর্সিং না থাকায় বিপাকে পড়ে যাই। এখন নিজস্ব কারিগরের মাধ্যমে কাস্টমারের পছন্দের ডিজাইনে পণ্য তৈরি করে বিক্রি করছি। মাটির জিনিস হওয়ায় ডেলিভারি করা চ্যালেঞ্জ ছিলো।
শ্রীমঙ্গলের মেয়ে ফারহানা আহমেদ সুহার উদ্যোগের নাম লংলা টি। তিনি কাজ করেন শ্রীমঙ্গলের বিশুদ্ধ চাপাতা নিয়ে। আমার মূল চ্যালেঞ্জট ছিলো সংসার এবং অফিস সামলে একাধারে কাস্টমার ডিলিং করা। আগে থেকে উই গ্রুপে বড় বড় কমেন্ট করার কারণে দক্ষতার সাথে কাস্টমার ডিলিং করতে সক্ষম হয়েছি।
সিলেটের মেয়ে জিবা বেগমের উদ্যোগের নাম সুরমা কুটির। বিক্রি করেন শিমের বিচি নিয়ে। তিনি বলেন ওয়েভের ফলে আমার ই-কমার্স জ্ঞান ও দক্ষতা বেড়েছে কয়েকগুণ। তা আমার সারাজীবন কাজে লাগবে।
সিদরাত ফারজানা আঁখির উদ্যোগের নাম উমাইমাহ্। তিনি কাজ করেন মহিলাদের শাড়ী, ওড়না ও জুম শাড়ী নিয়ে। ওয়েভে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে জুম শাড়ী। সিলেট ওয়েব আমার ক্যারিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে থাকবে। ওয়েভে অর্জিত জ্ঞান আমাকে আরও এগিয়ে নিলো ই-কমার্স ফিল্ডে।
ফিরোজা জান্নাতের উদ্যোগের নাম সিলেটিআনা। তিনি বলেন ওয়েভে কাস্টমার বেস গড়ে উঠেছে। তারা আমার সার্ভিসে সন্তুষ্ট হয়ে বার বার ক্রেতা হচ্ছেন।
সুনামগঞ্জের উদ্যোক্তা বৃষ্টি রাজ ঋতু। তার উদ্যোগের নাম পরিধি। বিক্রি করেন মায়ের তৈরি দুধের সন্দেশ ও নারকেলে নাড়ু নিয়ে। তিনি বলেন আমার প্রোডাক্ট স্টক করার সুযোগ নাই। তাই নিয়মিত তৈরি করে সারা দেশে ডেলিভারি করা একটু চ্যালেঞ্জিং ছিলো। তবে মার নিরলস পরিশ্রমের ফলে বেগ পেতে হয় নি। আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে, ভবিষতে বেশি অর্ডার আসলেও ডেলিভারিতে সমস্যা হবে না।
সিলেটের উদ্যোক্তা আয়েশা হেনার উদ্যোগে নাম শীতলপাটি। তিনি বলেন আমার কাজ শীতলপাটির ফিউশন নিয়ে নতুন নতুন ডিজাইন করা। ওয়েভের কল্যাণে শীতলপাটি ছড়িয়ে দিতে পেরেছি সর্বত্রে।
ইসমত জাহান হলির উদ্যোগের নাম হলি’স কালেকশন রকমারি পণ্য। কাজ করেন হ্যান্ডলুম মনিপুরী শাড়ি নিয়ে। তিনি বলেন কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে সবসময় আমি নিজের হাতে ধরে দেখে পণ্য আনি তাই নিয়মিত বাসার বাহিরে ২০ কিলোমিটার যাতায়ত আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিলো।
সুনামগঞ্জের উদ্যোক্তা শাহরীন সুলতানা রীমার উদ্যোগের নাম সপ্তপর্ণা। কাজ করেন মূলত বেবি ড্রেস এবং গাউন নিয়ে। তিনি বলেন বাসা থেকে বের হয়ে কাপড় সংগ্রহ করা পরিবার শুরুতে মেনে নেয়নি। ধাপেধাপে পরিবারের সহযোগীতা পেয়েছি।
সিলেটি ওয়েভ সম্পর্কে উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন- বাংলাদেশে অনেকটা নতুন করে ইতিহাস রচনা করেছে ’সিলেটি ওয়েভ’। এই করোনাকালীন সময়ে হতাশ না হয়ে নিজেদের মেধা ও পরিশ্রমকে সুন্দর ভাবে প্রমান করতে পেরেছে সিলেট বিভাগের নারী উদ্যোক্তারা। চা পাতা, মনিপুরি শাড়ি, সাতকড়া, শীতল পাটি, মাটির তৈজস পত্র সহ ইত্যাদি পণ্য দেশবাসীর কাছে তোলে ধরছে এ ওয়েভে। কোন রকম সেল পোস্ট ছাড়া, মার্কেটিং খরচ ছাড়া শুধু উই গ্রুপের সক্রিয়তা আর পরিচিতি দিয়ে এ ওয়েভের বেশিরভাগ উদ্যোক্তারা লাখ টাকার উপরে বিক্রি করেছে। এটা ছিলো আমাদের প্রাথম ওয়েভ। আশা করছি সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে বিভাগীয় পর্যায়ের এমন ওয়েভ করতে পারবো।
সিলেটি ওয়েভের মূল উদ্যোক্তা ও উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) এর উপদেষ্টা রাজিব আহমেদ বলেন- সিলেট বিভাগের পণ্য নিয়ে এ ওয়েভ আশার থেকেও বেশি সফল হয়েছে। আশা করছি অন্য বিভাগ গুলো নিয়েও এমন কিছু করা যাবে সামনে।