বিশ্বের বৃহৎ স্মার্টফোন নির্মাতা স্যামসাং ডিভাইস উৎপাদনের জন্য চীননির্ভরতা শূন্যে নামিয়ে এনেছে। এখন ডিসপ্লে উৎপাদনের জন্যও চীননির্ভরতা কমাতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই অংশ হিসেবে চীন থেকে মোবাইল এবং আইটি ডিসপ্লে কারখানা ভারতের উত্তর প্রদেশে স্থানান্তরে ৪ হাজার ৮২৫ কোটি রুপি বিনিয়োগের নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক ইলেকট্রনিকস প্রতিষ্ঠানটি। উত্তর প্রদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্যামসাংয়ের ভারতে বিনিয়োগ পরিকল্পনার বিষয়টি জানানো হয়েছে। খবর ইটি টেলিকম।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে প্রডাকশন লিংকড ইনসেনটিভ (পিএলআই) স্কিমের ঘোষণা দিয়েছে। এর আওতায় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে মোদি সরকারের আর্থিক প্রণোদনা পাবে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতারা। পিএলআই স্কিমের আওতায় ভারতে স্থানীয়ভাবে ডিভাইস উৎপাদনের কার্যক্রম জোরদার করেছে একগুচ্ছ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। এ তালিকায় রয়েছে অ্যাপলের চুক্তিভিত্তিক আইফোন নির্মাতা ফক্সকন, পেগাট্রন ও উইস্ট্রনের পাশাপাশি স্থানীয় ডিভাইস নির্মাতা মাইক্রোম্যাক্স ও লাভা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন উত্তর প্রদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা স্যামসাং ডিসপ্লে নয়ডা প্রাইভেট লিমিটেডকে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টিতে অনুমোদন দিয়েছে। এর পরই চীন থেকে ডিসপ্লে কারখানা উত্তর প্রদেশে স্থানান্তরে বড় অংকের বিনিয়োগ পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে স্যামসাং।
বিবৃতিতে উত্তর প্রদেশ সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ভারতে এটিই প্রথম কোনো হাইটেক প্রজেক্ট, যা চীন থেকে ভারতে স্থানান্তর করতে যাচ্ছে স্যামসাং। এ রকম প্রজেক্ট থাকা বিশ্বের তৃতীয় দেশ হতে চলেছে ভারত, যা সরাসরি ৫১০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি কারখানাটিতে পরোক্ষভাবে কয়েক হাজার মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
টানা কয়েক বছর ধরে প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে চীননির্ভরতা কমাতে কাজ করছে স্যামসাং। বর্তমানে টিভি, মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট ও স্মার্ট ঘড়িতে ব্যবহূত ৭০ শতাংশের কিছু বেশি ডিসপ্লে দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং চীনের কারখানায় উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ভারতে এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ স্মার্টফোন উৎপাদন কারখানা পরিচালনা করছে স্যামসাং। ২০১৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানাটির কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ওই সময় কারখানাটিতে ৪ হাজার ৯১৫ কোটি রুপি বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল।
স্যামসাং গত আগস্টে স্মার্টফোন উৎপাদন কার্যক্রমের বৃহৎ একটি অংশ ভিয়েতনাম এবং অন্যান্য দেশ থেকে ভারতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। ওই সময় দেশটিতে আগামী পাঁচ বছরে ৪ হাজার কোটি ডলার মূল্যের (৩ লাখ কোটি রুপি) স্মার্টফোন উৎপাদনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।
ইলেকট্রনিকস জায়ান্ট স্যামসাং ডিভাইস উৎপাদন লাইনে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করছে। ভারতে ডিভাইস উৎপাদনের লক্ষ্যে কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারত সরকারের পিএলআই স্কিম সুবিধার আওতায় এখন ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের স্মার্টফোন উৎপাদন কার্যক্রমও ভারতে সরিয়ে নিতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি।
চীনের পরই ভিয়েতনাম হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন রফতানিকারক দেশ। তবে ভারত সরকার এখন স্থানীয় উৎপাদনে গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশটিতে স্মার্টফোনসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। পিএলআই ঘোষণা দেয়ার পর অ্যাপল ও স্যামসাংসহ অন্যান্য ডিভাইস নির্মাতারাও এখন ভারতে উৎপাদন কার্যক্রম জোরদারে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গত আগস্টে ভারত সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, অ্যাপল কয়েক বছর ধরে ভারতে চুক্তিভিত্তিক ডিভাইস নির্মাতাদের মাধ্যমে আইফোনের সাশ্রয়ী মডেলগুলো উৎপাদন করে এলেও এখন হাই-এন্ড আইফোনের উৎপাদন শুরু করেছে। স্যামসাং এরই মধ্যে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতে ৪ হাজার কোটি ডলারের স্মার্টফোন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার নথিপত্র ভারত সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এসব ডিভাইসের মধ্যে ২০০ ডলার মূল্যের ডিভাইস থাকবে মোট ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের এবং এ মূল্য সেগমেন্টের বেশির ভাগ ডিভাইস বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হবে।
ভারতের নয়ডায় নিজেদের সবচেয়ে বৃহৎ স্মার্টফোন উৎপাদন কারখানা পরিচালনা করছে স্যামসাং। এ কারখানা থেকে উৎপাদিত ডিভাইসও বাইরের দেশে রফতানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। স্যামসাং চীনে নিজেদের ডিভাইস উৎপাদন কার্যক্রম শতভাগ গুটিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে ভিয়েতনামে নিজেদের ৫০ শতাংশ স্মার্টফোন উৎপাদনের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। দক্ষিণ কোরিয়ায় চড়া মজুরির কারণে বাইরের দেশে ডিভাইস উৎপাদন জোরদার করছে প্রতিষ্ঠানটি। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায়ও প্রতিষ্ঠানটির স্মার্টফোন উৎপাদন কার্যক্রম রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ভারত স্মার্টফোনের পরবর্তী উৎপাদন হাব হওয়ার পথে রয়েছে। ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের চলমান বাণিজ্য বিরোধের জেরে আইফোন নির্মাতা অ্যাপল উৎপাদন সক্ষমতার এক-পঞ্চমাংশ চীন থেকে ভারতে সরিয়ে নিচ্ছে। গত মে মাসে এমন তথ্য জানা যায়। একই সময় ভারতীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট নির্মাতা লাভা ইন্টারন্যাশনালের উৎপাদন কার্যক্রম চীন থেকে ভারতে সরিয়ে নেয়ার তথ্য সামনে আসে। ভারতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলেও এতদিন চীনে ডিভাইস উৎপাদন করে আসছিল লাভা। শুধু উৎপাদন কার্যক্রমই নয়; ছয় মাসের মধ্যে নিজেদের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি) কার্যক্রমও চীন থেকে নিজ দেশে সরিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরেই চীন থেকে ভারতে ডিভাইস উৎপাদন কার্যক্রম স্থানান্তরের জন্য ৮০ কোটি রুপি বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছিল লাভা। এছাড়া আগামী পাঁচ বছর ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠানটি ৮০০ কোটি রুপি বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন বাজার, যা স্যামসাংয়ের জন্য বড় বাজার। ভারতের ক্রমবর্ধমান স্মার্টফোন বাজারে গত প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শাওমিকে হটিয়ে শীর্ষ অবস্থান পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বার্ষিক মোট উৎপাদিত ডিভাইসের বৃহৎ একটি অংশ ভারতে বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে ভারতকে ডিভাইস উৎপাদন ও রফতানি হাব হিসেবে দেখছে স্যামসাং।