অন্যান্য বছরের চেয়ে ২০২০ সাল ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় পরিবর্তন এসেছে প্রতিটি খাতে। দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়ে অনলাইননির্ভর। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটসহ মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে যায় ব্যাপকভাবে।
করোনাকালে ই-কমার্স মাধ্যমে কেনাকাটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সভা, সেমিনারসহ সংবাদ সম্মেলন—সব হতে থাকে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে। ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম, টেলি মেডিসিন সেবাসহ বিভিন্ন অনলাইন সেবায় অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় মানুষ।
ব্যতিক্রম বছরটিতে যদি আরেকটি নাম দেয়া হয়, তাহলে ‘ভার্চুয়াল-২০২০’ বেশ মাননসই হবে। করোনার হানা মোকাবেলায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নির্ভরতা ও অর্জনে কী কী আলোচিত ছিল বছরজুড়ে, তা রইলো এ আয়োজন—
অনলাইনে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম
করোনাকালে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। তবে গ্রামীণফোন, রবি, ইউনিলিভারসহ অনেক বড় বড় অধিকাংশ কোম্পানি, ব্যাংক তাদের কর্মীদের হোম অফিসে পাঠায়। এছাড়া গ্লাক্সোস্মিথক্লিন বাংলাদেশ লিমিটেড, গ্রামীণফোনের মতো নিবন্ধিত কোম্পানিগুলো ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে বার্ষিক সাধারণ সভাও করে।
সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অলনাইনে তাদের ক্লাস, শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে থাকে। তা বছরের শেষ পর্যন্ত চলমান রয়েছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনেই পরীক্ষা নিয়েছে। এছাড়া ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ডাক্তাররা রোগী দেখতে শুরু করেন।
বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ফেসবুকের মামলা
ফেসবুক ডটকম ডটবিডি (facebook.com.bd) ডোমেইনটি বিটিসিএল থেকে ২০০৮ সালে এস কে সামসুল আলম নামের এক ব্যক্তি বরাদ্দ নিয়ে রেখেছেন। ২০২০ সালের শেষ দিকে ডোমেইনটি উদ্ধারে তার বিরুদ্ধে মামলা করে ফেসবুক। এ বিষয়টি বেশ আলোচনায় ছিল।
গত ২৩ নভেম্বর ঢাকা জেলা জজ আদালতে ট্রেডমার্ক অ্যাক্ট ৯৬ ও ৯৭ ধারায় এবং ফৌজদারি আইনের ১৫১ ধারায় এস কে সামসুল আলম নামে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা করে ফেসবুক। মামলায় এই ডোমেইন ‘দখলকারী’র বিরুদ্ধে ৫০ হাজার ডলার (প্রায় ৪৪ লাখ টাকা) ক্ষতিপূরণ দাবির পাশাপাশি ডোমেইনটি যাতে ব্যবহার ও হস্তান্তর না করতে পারে সে জন্য এর ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টটি।
এরপর এই ডোমেইন ব্যবহারে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। ২০২১ সালের ৯ মার্চ মামলার পরবর্তী তারিখ দেয়া হয়েছে। সে পর্যন্ত ডোমেইন ব্যবহারের এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
দেশের তৃতীয় সাবমেরিন প্রকল্পের অনুমোদন
ডিসেম্বরের প্রথম দিনে দেশের তৃতীয় সাবমেরিন প্রকল্পে অনুমোদন দেয় সরকার। ‘বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন’ শীর্ষক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)।
প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯৩ কোটি ১৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এতে সরকার দেবে প্রায় ৩০১ কোটি টাকা এবং বাকি ৩৯২ কোটি আসবে বিএসসিসিএল থেকে। চলতি বছর কাজ শুরু হয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এটির বাস্তবায়নের সময়।
সিঙ্গাপুর থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সংযুক্ত সি-মি-উই-৬ সাবমেরিন কেবলটি ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, লোহিত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। কেবলটির কোর ল্যান্ডিং স্টেশন হবে সিঙ্গাপুর, ভারত, জিবুতি, মিসর ও ফ্রান্সে। বাংলাদেশের শাখাটি বঙ্গোপসাগর হয়ে কক্সবাজারের কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
ই-কমার্স, এফ-কমার্সে নির্ভরতা
২০২০ সালে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সে মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে ব্যাপক। করোনাকালে মানুষ দৈনন্দিন বাজারসদাই হতে শুরু করে ঈদের কেনাকাটা সবকিছুই করেছে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে।
করোনাকালে ফেসবুকেও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বেড়ে যায়। উইমেন অ্যাণ্ড ই-কমার্স, রিসাইকেলবিনসহ বেশ কিছু গ্রুপে যুক্ত হন হাজার হাজার উদ্যোক্তা। আবার অনেকেই নিজেরাই পেজ পরিচালনা করছেন।
ই-ক্যাব বলছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মধ্যে গত ৮ মাসে ই-কমার্স সেক্টরে লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। যেখানে এক লাখ পণ্য ডেলিভারি হয়েছে প্রতিদিন, ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
ভার্চুয়াল ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড
করোনার চ্যালেঞ্জ উতরে ডিসেম্বরের শুরুতে আয়োজন করা হয় তথ্য-প্রযুক্তি খাতের মহোৎসব ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০২০। ৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সোশ্যালি ডিস্ট্যান্স, ডিজিটালি কানেক্টেড’।
বৈশ্বিক এই মহামারিতে পুরো পৃথিবী যেখানে টালমাটাল, সেখানে ভার্চুয়ালি এই আয়োজন সম্পন্ন করেছে সরকার। অ্যাপের মাধ্যমে পুরো প্রদর্শনী ঘুরে দেখেছে দর্শনার্থীরা। আয়োজনের মধ্যে ছিল বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের অংশগ্রহণে মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স। অনুষ্ঠিত হয়েছে বিষয়ভিত্তিক ২৪টি সেমিনারও।
ফ্রিল্যান্সারদের পরিচয়পত্র
দেশে বসে অনলাইনে কাজ করে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করছেন, এমন ফ্রিল্যান্সারদের ভার্চ্যুয়াল আইডি কার্ড বা পরিচয়পত্র দিচ্ছে সরকার। নভেম্বরের শেষ দিকে ভার্চুয়াল আইডি কার্ড পোর্টালের উদ্বোধন করা হয়।
দেশের প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারকে ভার্চুয়াল কার্ড দেয়ার পোর্টাল চালু করা হয়। এদিকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ফ্রিল্যান্সারদের ক্রেডিট কার্ড ও ঋণসুবিধা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উইটসায় বাংলাদেশের ছয় প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার
টুয়েন্টি-টুয়েন্টি উইটসা গ্লোবাল আইসিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ডস’র পাবলিক বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছে বাংলাদেশের ছয় প্রতিষ্ঠান। ৪ বিভাগে রানার-আপ এবং ২ বিভাগে মেরিট পুরস্কার পেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে অনুষ্ঠিত তথ্যপ্রযুক্তির অলিম্পিক খ্যাত ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (ডব্লিউসিআইটি) সম্মেলনে এ পুরস্কার দেয়া হয়। মোট ১০টি বিভাগে ১০ চ্যাম্পিয়ন ও রানার-আপ এবং ২১টি মেরিট পুরস্কার ছিল।
রানার-আপ পুরস্কার পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- কোভিড ১৯ টেক সলিউশনস ফর সিটিজ অ্যান্ড লোকালিটিজ বিভাগে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের এটুআই প্রকল্প এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সিনেসিস আইটি লিমিটেড’। প্রাইভেট পার্টনারশিপ বিভাগে সরকারের ‘ইনোভেশন ডিজাইন অ্যাণ্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ একাডেমি (আইডিয়া) প্রকল্প’।
ইনোভেটিভ ই-হেলথ সলুসনস বিভাগে ‘মাইসফটের মাই হেলথ বিডি’ এবং ‘ভার্চ্যুয়াল হসপিটাল অব বাংলাদেশ’। ই-এডুকেশন অ্যাণ্ড লার্নিং বিভাগে ‘বিজয় ডিজিটাল’। এছাড়া মেরিট পুরস্কার পেয়েছে ডিজিটাল অপরচুনিটি অর ইনক্লুশন বিভাগে ‘নগদ’ এবং সাসটেইনেবল গ্রোথ বিভাগে ‘ডিভাইন আইটি লিমিটেডের প্রিজম ইআরপি’।