দেশিপণ্যের প্রসারিত বাজার এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির এই সময়ে মাছের মতো স্পর্শকাতর পণ্যও ই-কমার্সে সাড়া পাচ্ছে।আজ আমরা জানব তেমনই একজন উদ্যোক্তার গল্প যিনি স্নাতকোত্তর করার পাশাপাশি জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে কাজ করছে ই-কমার্সে। চাঁদপুরের ছেলে এবং পড়াশোনার সূত্রে বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত আহামেদউল্যাহ সিয়াম। তিনি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশ ফর স্পিকার্স অব আদার ল্যাংগুয়েজেস সাবজেক্টে স্নাতক শেষ করেছেন এবং বর্তমানে একই বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর করছেন। তার উদ্যোগের নাম “ইলিশের বাড়ি”। টেকজুম থেকে সিয়ামের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহজাবীন রাখী।
টেকজুমঃ উদ্যোক্তা সিয়াম এবং ব্যক্তি সিয়াম দুজনের সম্পর্কে কি বলবেন?
সিয়ামঃ উদ্যোক্তা ও ব্যক্তি সিয়াম দুটি পরিচয় এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নিজে ব্যক্তিগতভাবে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম।কিন্তু করোনাকালীন সময়ে বাসায় বসে দু’একটি স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেইনিং করার পরও টিউশন/ ইনকাম সোর্স না থাকায় একসময় হতাশ হয়ে পড়ি৷ স্নাতকও শেষ,এরপর কি করা যায়, কি করবো এসব ভেবে প্রায়ই রাত জাগা হতো ৷ ভাবতে ভাবতে ১১টি স্টার্ট আপনি আইডিয়া লিখে ফেলি৷ এবং উইতে ঘোষণা দিয়ে ১২তম স্টার্টআপ আইডিয়া ‘ইলিশের বাড়ি’ নিয়ে ই-কমার্সে কাজ করা শুরু করি। উদ্যোগের কারণে এখন আমার পরিচয় হয়ে গেছে ‘ইলিশের বাড়ি’র সিয়াম।
টেকজুমঃ ১২তম স্টার্টআপ আইডিয়া নিয়ে ই-কমার্স ক্ষেত্রেই কেন কাজ করতে চাইলেন?
সিয়ামঃ অন্য পেশায় না গিয়ে ই-কমার্সে যাওয়ার অনেক গুলো কারণ আছে। প্রথমত, এখানে প্রচুর সম্ভবনা আছে, কিন্তু দক্ষ লোক নেই। আমি নিজে দক্ষ তা বলছি না তবে পড়াশোনা করলে, সময় দিলে ই-কমার্সে নিজে ভালো করতে পারবো মনে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমার মূলধন হিসেবে কাড়ি কাড়ি টাকা ছিলো না৷ ই-কমার্সে কম মূলধনে কাজ শুরু করা যায়, আমার আলাদা দোকান নিতে হচ্ছে না, বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে না, কর্মচারী রাখতে হচ্ছে না দোকানের, ফেসবুক পেইজ কিংবা ওয়েবসাইটই আমার দোকান। তৃতীয়ত, ক্রেতারা ভালো সেবা পেয়ে রিভিউ দিলে দেশ বিদেশের মানুষ খুব সহজেই আমার ব্যবসা সম্পর্কে জানতে পারবে; দ্রুত ব্যবসার প্রসার ঘটবে এটাও একটা কারণ। ইতিমধ্যেই আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, সৌদী আরব, সাউথ আফ্রিকা, মালেশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কিছু দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে থাকা আত্মীয়ের জন্য ইলিশের বাড়ি থেকে অর্ডার দিয়েছেন যা অফলাইনে মোটেও সহজ ছিলো না৷ চতুর্থত, নতুন কিছু শিখতে গেলে অবশ্যই কারো গাইডলাইন লাগে৷ আমি পিওর আর্টসের ছাত্র, বিজনেস নিয়ে আমার জ্ঞান ছিলো প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। ই-কমার্স সংক্রান্ত জ্ঞান নেওয়ার জন্য গাইডলাইন হিসেবে উইয়ের মতো একটা নির্ভরযোগ্য, ডায়নামিক প্লাটফর্ম, রাজিব আহমেদ ভাইয়ের মতো একজন অভিজ্ঞ, দূরদর্শী মেন্টর পেয়েছি এটাও অন্যতম প্রধান কারণ।
টেকজুমঃ চমৎকার। বাধাগ্রস্ত হয়েছেন কখনও এই পথচলায়? সেটির প্রতিকার কিভাবে করেছেন?
সিয়ামঃ শুরুর সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি পদে বাধাগ্রস্থ হয়েছি। প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে অনার্স করে মাছ বিক্রি করবো এটা পরিবারসহ আশেপাশের লোকজন খুব সহজভাবে নিতে পারেনি৷ কেননা, আমাদের সমাজে মাছ বিক্রির পেশাটাকে সম্মানজনক হিসেবে দেখা হতো না। ধারনা করা হতো খুবই নিচুলোকদের পেশা এটি। আমি নিজেও মাছ নিয়ে কাজ করা ঢাবির কাউকে অনলাইনে প্রচার করতে দেখিনি। যাইহোক, পরিবারের সকল নিষেধ, সংকোচ, সমাজের সকল ভুলভাল চিন্তায় কুঠারাঘাত করে, নিজের উপর পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে কাজ শুরু করে দেই। নিজের উপর নিজের বিশ্বাস থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক, নাঈম নামে আমার ঢাবিরই এক বন্ধু শুধুমাত্র আমাকে সাপোর্ট দিতে প্রথম অর্ডার করে এবং শুরু হয়ে যায় ‘ইলিশের বাড়ি’র পথচলা। দ্বিতীয়ত, আসল চাঁদপুরের ইলিশপর্যাপ্ত পরিমানে সোর্সিং করা ছিলো বিশাল চ্যালেঞ্জিং বিষয়। প্রথম যার কাছ থেকে ইলিশ নেই সে আমাকে একটা ইলিশ কাস্টমারের কাঙ্খিত সাইজের চেয়ে তুলনামূলক কম সাইজের নিতে বলে, তাই রাগ করে আর কখনো তার কাছে যাইনি৷ কেননা, সাইজভেদে ইলিশের দামের ব্যাপক পার্থক্য হয়৷ ৫ মাসে বুঝতে পারলাম এ সেকশনের লোকদের সততার খুবই অভাব। পরে এক ছোটভাইয়ের সাথে ওভাবেই কথা বলে ডিল ফাইনাল করি এবং সেই সাথে আরো দুতিন জন আড়ৎদারের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলি।
তৃতীয়ত, ইলিশ মাছ পচনশীল পণ্য হওয়ায় এর প্যাকেজিং এবং ডেলিভারিতে আমার সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছিলো। প্যাকেজিংয়ের জন্য বরফ, পলিথিন দিয়ে কর্কশীটের বক্সের ব্যবহার করি এবং ডেলিভারির জন্য এসএ পরিবহন কুরিয়ার নির্বাচন করি। কারণ তারা দুদিনের মধ্যে সারাদেশে ডেলিভারি দিয়ে থাকে। আর আমার প্যাকেজিংয়ের পদ্ধতিতে মাছ অনায়াসে দুদিনের বেশি মাছ ভালো থাকবে।চতুর্থত, প্রাইসিং করতে গিয়ে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। রাজিব ভাইয়ের প্রাইসিং সংক্রান্ত পোস্ট পড়েও সঠিক প্রাইসিং করতে ব্যর্থ হই। পরে মার্কেট রিসার্চ করে প্রাইসিং ঠিক করি৷ পঞ্চমত, দ্বিতীয় অর্ডারে বিশাল ধাক্কা খাই। ২ কেজি সাইজের রেয়ার ইলিশ অর্ডার করেছিলেন সিলেটের এক আপু। এত বড় সাইজের ২টা মাছ হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে উনার সাথে কথা বলে কোন প্রকার এ্যাডভান্স ছাড়াই মাছ সংগ্রহ করি৷ পরবর্তীতে উনি জানায় উনার মামা মারা গেছেন তাই মাছ নিবেন না৷ এত বড় সাইজের মাছ হুট করে কারো প্রয়োজন না হয়না তাই টেনশনে ছিলাম। পরে ধৈর্য্যধারণ করে কাজ করে যেতে থাকি। আমাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে আব্বু’ই কিনে নেয়। এর পর থেকে অর্ডার কনফার্ম করতে কিছু টাকা এ্যাডভান্স নেওয়ার নিয়ম করি।
ষষ্ঠত, কাজ শুরুর সময় পরিবারের সাপোর্ট না পেলেও শুরুর পর সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দেয় পরিবারই৷ তবে, হঠাৎ একদিন আব্বুর পরিচিত জনৈক ব্যক্তির সমালোচনা, হাসি ঠাট্টায় মন খারাপ করে আব্বু বাসায় এসে এসব বন্ধ করতে বলেন৷ “বিপদে আমাদের পাশে দাঁড়াবে কিনা জানিনা। ‘ইলিশের বাড়ি’ বড় হলে, একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হলে তারাই আপনাকে, আমাকে তাদের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচয় দেবেন” আমার এমন যুক্তিতে শান্ত হন আব্বু।
টেকজুমঃ মাছের মতো চ্যালেঞ্জিং পণ্য নিয়ে কাজ করতে গেলে কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
সিয়ামঃ আগের প্রশ্নের উত্তরে ইতিমধ্যেই আমার উদ্যোগের বাধাগ্রস্থ হওয়া এবং সেগুলো মোকাবিলা করার অংশে অলরেডি সোর্সিং, প্যাকেজিং, প্রাইসিং, এ্যাডভান্স পলিসি ইত্যাদি নিয়ে বলেছি৷ তাই সেসব রিপিট করবো না৷ এখানে দুইটা বিষয় বলবো।
প্রথমত, মাছের ব্যবসায় প্রতারণার সুযোগ অনেক তাই এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এবং মাছ নিয়ে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান অনলাইনে শেয়ার করা যায়৷ এতে কাস্টমার জ্ঞান পেয়ে একদিকে উপকৃত হবে, অন্যদিকে আপনার প্রতি কাস্টমারের বিশ্বাস মজবুত হবে। দ্বিতীয়ত, কাস্টমার সার্ভিস ভালো হওয়া প্রয়োজন৷ অর্ডার গ্রহনের সময় গ্রাহকের কাছ থেকে নাম, ঠিকানা, পরিমাণ, মোবাইল নাম্বার সহ প্রয়োজনীয় সকল বিস্তারিত তথ্য নেওয়া এবং ডেলিভারির তারিখ, সময়, পেমেন্টের পদ্ধতি সম্পর্কে গ্রাহককে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া, কাস্টমারের সাথে সবসময় কমিউনিকেশন বজায় রাখা, উপযুক্ত রিটার্ন পলিসি থাকা আবশ্যক।
টেকজুমঃ উদ্যোক্তা জীবনে অনুপ্রেরণা এবং কৃতিত্ব কাকে বা কাদেরকে দিতে চান এবং কেন?
সিয়ামঃ সত্যি বলতে ‘ইলিশের বাড়ি’ আজকের অবস্থায় আসতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম(উই) এবং আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডস যাদের অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী।
প্রথমত, ‘ইলিশের বাড়ি’র জন্মই উই থেকে। উইতে ঘোষণা দিয়েই ইলিশ নিয়ে কাজ করা শুরু করি। ঘোষণার পর উইয়ের আপু ও ফেসবুকের লিস্টে থাকা ভাইবোনদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাই, সাহস পাই৷দ্বিতীয়ত, কাজ শুরুর পর পরিবার সহ আশেপাশের অনেকের কটু কথা, সমালোচনার শিকার হলে উইতে তা শেয়ার করি এবং উইয়ের সকলের বিশেষ করে আপুদের আকুন্ঠ সমর্থন পাই।
তৃতীয়ত, উই থেকেই ই-কমার্স, পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং, কাস্টমার খাতির সহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করি। এখন আমার ‘ইলিশের বাড়ি’কে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষ চেনে, ৫ মাসে আমার নিজের মোট প্রায় ৫ লাখ টাকা সেল হয়েছে, উইতেই ১ লাখ৷ উই না থাকলে আমার দ্বারা যে ৫০ হাজার কিংবা ১ লাখ টাকাও সেল করা সম্ভব হবে তা জানতাম না৷চতুর্থত, এখনো উই থেকে শিখছি৷ কিছুদিন আগেও পণ্যের ফটোগ্রাফি, বিজনেসে ফিন্যান্স ম্যানেজমেন্ট কেমন হবে এসব নিয়ে খুবই চমৎকার ট্রেনিং করার সুযোগ হয়েছে উইয়ের কল্যাণেই৷ পঞ্চমত, উইয়ের কল্যাণেই বাংলায় লেখালেখির ভীত গড়ে উঠে, যা কন্টেন্ট রাইটিংয়ে ব্যাপক কাজে দেয়। ষষ্ঠত, ই-ক্যাবের ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট জনাব রাজিব আহমেদ ভাইয়ের দিক-নির্দেশনামূলক ছোট ছোট পোস্টগুলো অনেক কাজে দিয়েছে। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স, ওয়েবসাইট করার গুরুত্ব, কাস্টমার খাতির সহ আরো অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রতিনিয়তই না চাইতে দিকনির্দেশনা পাচ্ছি যেগুলো কাজে লাগিয়ে সবসময় উপকৃত হয়েছি, হচ্ছি। সবমিলিয়ে আমার উদ্যোগের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উইয়ের, রাজিব ভাইয়ের সেই দিকনির্দেশনাগুলোর অবদান আছে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই উই প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা আপু ও উইয়ের এ্যাডভাইজার, মাই মেন্টর রাজিব আহমেদ ভাইয়ের প্রতি দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তাদের জন্য এত ভালো একটা প্লাটফর্ম উপহার দেওয়ায়।
টেকজুমঃ ধন্যবাদ সিয়াম।আপনার আগামী পথচলায় শুভকামনা জানবেন টেকজুমের তরফ থেকে।
সিয়ামঃ ধন্যবাদ টেকজুমকে।