মুসলমানদের ধর্মীয় যে কোন কার্যাবলী সম্পাদনার প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদ৷ যেসব স্থাপনায় মুসলমানরা একত্রিত হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে সেই ইমারত বা স্থাপনা গুলোই মসজিদ৷ এখানে শুধু নামাজ পড়া হয়না মুসল্লীদের আরবী শিক্ষা দেয়া হয়, তথ্য বিতরন, বিরোধ নিষ্পত্তি, বিয়ে, তাছাড়া ও মুসল্লীদের নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ ও হয়ে থাকে এখানে৷ যা আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
শুরুটা কত শতাব্দীতে তার সঠিক ধারণা না থাকলে ও আরব উপদ্বীপ এ প্রথম যে মসজিদ গুলো হয়েছিলো তা ছিলো খুব ই সাদাসিধে। হাজার বছরের পরিবর্তন এ এখন মসজিদ গুলো হয়েছে অনেক চাকচিক্যময়, জ্বোজুল্যমান, সুন্দর এবং পরিণত হয়েছে আমাদের স্থাপনায়৷ মোঘল আমলে আমাদের উপমহাদেশে মসজিদ এর বিস্তার ঘটে এবং সেই সময়ের অনেক মসজিদ গুলো এখন আমাদের পুরণো ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছে।
বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মসজিদ আছে যেগুলো আমাদের ইতিহাস এর সাক্ষী হয়ে আসছে। নতুন পুরাতন এমন অনেক মসজিদ তাদের রূপ সৌন্দর্যে সেইসব এলাকার গৌরব হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরবো এমন ই কিছু মসজিদ এর বর্ণনা যা আমাদের টাঙ্গাইল জেলার অন্যতম নিদর্শন, যেগুলো আমাদের গর্ব এবং যেগুলো হাজারো দর্শনার্থীর মনে জায়গা করে নিতে পারে৷ চলুন জেনে আসি টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত এমন ই কিছু মসজিদ সম্পর্কে –
২০১ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদঃ
একটি দুইটি বা একশত নয় বরং ২০১ টি গম্বুজ। ভাবা যায়! এতগুলো গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের কথা।
হ্যাঁ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ আছে আমাদের জেলা টাংগাইলে। টাংগাইল জেলার গোপালপুর উপজেলায় নির্মিত হয়েছে ২০১ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি, যার মিনার ৫৭ তলা একটি ভবনের সমান উঁচু । এটি টাংগাইল সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উওর পশ্চিমে নির্মাণ করা হয়েছে।
পাথালিয়া নামক গ্রামে ২০১৩ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রায় ১৫ বিঘা জায়গা জুড়ে মসজিদটি স্থাপন করা হয়েছে যার ব্যয় মূল্য ১০০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ঈদ জামাতের মাধ্যমে প্রথম মসজিদটিতে নামাজ আদায় করা হয়।
সম্পূর্ণ মসজিদটি তৈরিতে মিশর থেকে আনা টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদটির দেয়ালে আছে পুরো ৩০ পারা কোরআন শরিফ এবং আল্লাহর ৯৯ টি নাম।খন্ড খন্ড টাইলস গুলোতে কুরআনের আয়াতগুলো এমনভাবে লেখা আছে যে কেউ বসে কিংবা দাঁড়িয়ে পড়তে পারবে।
দোতলার দরজাটি তৈরি করতে পুরো ৫০ মন পিতল লেগেছে। দারুণ কারুকার্য খচিত দরজাটি হচ্ছে দোতলার প্রধান ফটক। দৃষ্টিনন্দন ছাদে আছে মোট ২০১ টি গম্বুজ। ছাদের মাঝে ৮১ ফুট উঁচু একটি গম্বুজকে কেন্দ্র করে ২০০ গম্বুজ ঘীরে আছে এমনভাবে যে সবগুলোই হাঁটতে হাঁটতে পরিদর্শন করা যায়। যাদের প্রতিটির উচ্চতা ১৭ ফুট করে।গম্বুজগুলো এত উঁচু হওয়ায় মানুষ সহজেই চোখের আড়াল হয়ে যায়।
মসজিদটির চারকোণায় ১০১ ফুট উঁচু ৪টি মিনার আছে। পাশাপাশি আরো চারটি মিনার দেখা যায় যেগুলো ৮১ ফুট উঁচু। এত উঁচু উঁচু মিনারগুলোর জন্যই মসজিদটি মিনারের উচ্চতার দিক দিয়ে বিশ্বের মধ্যে ২য় উচ্চতম মিনার বিশিষ্ট মসজিদ নামে খ্যাত।উওর দিকে আছে অযুখানা।
খানিকটা বাঁকা আকারের ১১৬ টি আসন বিশিষ্ট এই অযুখানায় ছাই রঙের পাথরের মত মোজাইক ব্যবহার করা হয়েছে।মোট কথা স্থাপত্যশৈলীর দিক দিয়ে মসজিদটি অসাধারণ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ সমান ১৪৪ ফুট।
মসজিদের পাশেই আছে ৬ তলা ভবন বিশিষ্ট একটি দালান। যেখানে তৈরি করা হবে এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, বিনামূল্যের হাসপাতাল, দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের আবাসস্থল। এছাড়াও মসজিদ সংলগ্ন লাশ রাখার হিমাগার তৈরি করা হয়েছে।
একদিকে গীনিজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড এ জায়গা করে নিয়েছে আমাদের এ মসজিদ পৃথিবীর সবথেকে বেশি গম্বুজ সংখ্যা বিশিষ্ট মসজিদ হিসেবে, পাশাপাশি পৃথিবীতে ২য় উচ্চতম মিনার এর মসজিদ এটি। তাইতো প্রতিদিন শত শত মানুষ এই মসজিদটি দেখতে আসে। বিশেষ করে শুক্রবার মসজিদটি পরিদর্শন করতে এবং নামাজ পড়তে হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। এজন্যই মসজিদটি ঘিরে আশেপাশে স্থাপন করা হচ্ছে অত্যাধুনিক ডিজাইনের আবাসিক হোটেল, দোকান ও শপিংমল। একটি মসজিদ কে ঘীরে পাল্টে যেতে পারে পুরো এলাকার চিত্র এসব তাই প্রমাণ করে।
আতিয়া জামে মসজিদঃ
পুরনো ১০ টাকার নোট এ আমরা একটা মসজিদ দেখতে পাই যা আমাদের টাঙ্গাইল এর গর্ব আতিয়া জামে মসজিদ। টাঙ্গাইল এর সবথেকে পুরণো প্রাচীন নিদর্শন এ মসজিদ। খুব সম্ভবত আরবী “আতা” থেকে এর নামকরণ হয়েছে আতিয়া। যার অর্থ দানকৃত।
সেই পঞ্চদশ শতাব্দীর কথা। সেই সময় শাহ্ বাবা কাশ্মিরী নামে একজন ধর্ম প্রচারক এই এলাকায় বাস করতেন। ঐ সময়ে কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে তার ধর্মপ্রচার কাজের জন্য একটি বিশাল এলাকা ওয়াকফ হিসেবে পান। এই শাহ বাবার পরামর্শে মোঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি ই ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন, যা বর্তমানে দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত।
বাংলার স্থাপত্যসমূহ মূলত ইটের তৈরি। এই মসজিদ টি ও তার ব্যতিক্রম না। প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ এই মসজিদ নির্মানে নিযুক্ত ছিলেন এবং তা নির্মাণ করেছিলেন সুলতান ও মোগল আমলের স্থাপত্য রীতি অনযায়ী। ঠিক এই রীতির বহিঃপ্রকাশ এ মসজিদের চারকোণের চারটি বিশাল অষ্টাকোণাকৃতির মিনার।
এ মসজিদ এর বড় গম্বুজটিতে দেখা যায় কিবলা কক্ষের উপরের বড় গম্বুজটির খিলানভিত্তিক নির্মান পদ্ধতি অর্থাৎ স্কুইঞ্জ পদ্ধতি। এর বক্রাকার কার্ণিস, সূচালো খিলান, গম্বুজ নির্মাণ এ বাংলা পান্দানতিভ ব্যবহার এবং টেরাকোটা নকশালংকার গুলো সুলতানী বৈশিষ্ট্য বহন করে। আসলে সুলতানী আমলের বিদায় এবং নবাগত মোগল আমলের অসাধারণ এক মেলবন্ধন এ আতিয়া মসজিদ।
অত্যন্ত সুন্দর এ মসজিদ টি বাংলাদেশ এর মুসলিম যে সকল স্থাপত্য রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম। টাঙ্গাইল এ যতগুলো মূল শিলালিপি পাওয়া গেছে তার মধ্যে আতিয়া মদজিদ থেকেই দুটো, একটি আরবী এবং অন্যটি ফারসী।
মসজিদ এর দেয়ালের পুরুত্ত্ব, লাল ইটের আভা ছড়ানো রঙ৷ দেয়ালে খোচিত নকশা, ছোট হলেও মসজিদ কে আলাদা রূপ দান করেছে। পাশে পুকুর পারে বাঁধানো ঘাট যেন দর্শনার্থীকে অনেক মুগ্ধ করে এবং পুকুরের পানিতে ও যেন এর লাল ইটের আভা ছড়িয়ে পরে সারাক্ষণ। তাইতো এত পুরাতন মসজিদ অথচ এখনো দর্শনার্থীতে মুখর থাকে৷ তাছাড়া এখনো এখানে প্রতি ওয়াক্ত এ নামাজ হয়, আরবী শিক্ষা প্রদান করা হয়৷ ।
করটিয়া জামে মসজিদঃ
টাঙ্গাইল এ জমিদার পরিবারের মধ্যে অত্যন্ত সুপরিচিত যারা ছিলেন তাদের মধ্যে পন্নী পরিবার অন্যতম৷ যেমন ছিলেন ধর্মভীরু তেমনি তাদের সমাজসেবার কাজগুলো এখনো এলাকার মানুষরা শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করে। এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে কত মনে রাখার মত কাজ যে এই পরিবার করেছেন তা এই এলাকার মানুষদের জন্য অবিস্মরণীয়।
এর ই ধারাবাহিকতায় সাদত আলী খান পন্নী প্রায় ২১ বছর ধরে তাদের বাড়ি অর্থাৎ জমিদার বাড়ির প্রায় গা ঘেঁষে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা করটিয়া জমিদার বাড়ি জামে মসজিদ নামে পরিচিত। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটির সেই শুরুর সময় হিসেব করলে এর বয়স প্রায় দেড়শ বছর। অথচ সমহীমায় দাঁড়িয়ে আছে এখনো।
মোঘল স্থাপত্য শৈলিতে নির্মিত এ মসজিদ এর বর্তমান নাম করটিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।
কয়েকবারে এর নির্মাণ কাজ হয়েছে। এখনো চলছে কেননা জনসংখ্যা বেড়েছে তাই দুই কাতারে নামাজ পরে হয়না। তালা বাড়ানো হয়েছে সাথে বাড়ানো হচ্ছে এর জায়গাও। তবে সামনের দিকে প্রসার করতে গিয়ে ঢাকা পরছে এর একেবারে প্রথমে করা নজড়কারা গম্বুজ। প্রথমদিকে এর তিনটা গম্বুজ থাকলে ও পরবর্তীতে আরো ৫ টা গম্বুজ করা হয়েছে।
নামাজ পড়ার জায়গা থেকে শুরু করে দেয়াল গুলো পর্যন্ত খুব ই সুন্দর নকশায় খোচিত মসজিদ এর ভেতরের অংশ। দেশ বিদেশের শিল্পীরা এসব করেছেন। ভেতরে ঢুকলে ই চোখ চলে যায় ছাদে। অপরূপ সৌন্দর্য মসজিদ এর ভেতর পাশের ছাদ এখনো৷ ঝারবাতি গুলো এখনো যেন জমিদারী ভাব নিয়ে মাথার উপরে জায়গা করে নিয়েছে।
পন্নী পরিবার এর রুচির প্রশংসা করতে ই হয়৷ দানশীলতায় তো সেরা আছেন ই। মসজিদ এর ছাদে উঠলে একপাশে শানবাধানো পুকুর রয়েছে, অন্যপাশে আছে মাঠ যা এখন ঈদগাহ মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ এই সব ই এলাকাবাসীর জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন জমিদার পরিবার।
সাদা রঙ এর মসজিদটি এত্ত সুন্দর এবং এতই শৈল্পিক যে ভ্রমণপিয়াসী মানুষদের নজর কারে। করটিয়া জমিদারবাড়ি, এই মসজিদ মিলিয়ে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষদের লিস্ট এ থাকেই এই করটিয়া জায়গাটি।
ধলাপাড়া জামে মসজিদঃ
শত বছরের ঐতিহ্যকে ধারণকারী ঘাটাইল উপজেলায় অবস্থিত ধলাপাড়া জামে মসজিদ। এটি টাংগাইল জেলা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া বাজারের কাছে অবস্থিত।বাজারের কাছে হওয়ায় ধলাপাড়া বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ নামেও পরিচিত।
ধলাপাড়া চৌধুরী বংশের জমিদার ছমির উদ্দিন চৌধুরী১৯১৭সালে ( ১৩২৩ বঙ্গাব্দ) এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ২ একর ৫০ শতাংশ জায়গা জুড়ে মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে। যার মধ্যে ১ একর ৫০ শতাংশ জুড়ে আছে পুকুর এবং একটি ঈদগাহ মাঠ।
মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। ৭ গম্বুজ বিশিষ্ট সাবলীল,সুন্দর ,নিপুণ কারুকাজে সমাদৃত উপরে ৩ টি গম্বুজ এবং বারান্দার ছাদে রয়েছে ৪টি ছোট গম্বুজ। দরজাগুলোর উপরে খাঁজকাটা কারুকাজ করা যাতে করে সহজেই বাহিরের আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে। প্রতিটি দেয়ালে আছে অপরূপ সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ কারুকাজ।
মসজিদটিতে মোট দুই শতাধিক মানুষ নামাজ পড়তে পারে। উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে মসজিদের অনেকাংশেই ভেঙে গিয়েছে। তবুও মসজিদটি ধলাপাড়ার জমিদার চৌধুরী বংশের পুরাতন ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
দেলদুয়ার জমিদারবাড়ি জামে মসজিদঃ
টাঙ্গাইল এর ঐতিহাসিক দেলদুয়ার জমিদারবাড়ি কতটা মনোমুগ্ধকর তা বলার অপেক্ষা রাখেন। ঠিক এর গা ঘেঁষেই অত্যন্ত সুন্দর এবং একদম ব্যতিক্রমী দেখতে একটি মসজিদ অবস্থিত।
জমিদার আবদুল করিম গজনবীর হাত দিয়েই এই মসজিদ এর কাজ পূর্ণতা পায়৷ এই মসজিদ টি ২৮ শতক জায়গার উপর অবস্থিত। এখানে একসাথে ৩০০ লোক নামাজ আদায় করতে পারে। ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদ টি সম্পূর্ণভাবে কড়ি ও শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি।
মসজিদটির সামনের পাশে মূল ৪ টি স্তম্ভ মসজিদ কে একদম অন্যরকম একটি স্থাপনায় পরিণত করেছে৷ এছাড়া ও আছে মসজিদটির আরো ১৬ টি স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভে খোচিত নকশা গুলো অপূর্ব। মসজিদ এর ভেতরের দেয়ালে কুরআন এর আয়াত খোচিত আছে যা অত্যন্ত সুন্দর দেখতে এবং পুরোটাই স্বেতপাথরে খোদাই করা। ব্যতিক্রমধর্মী একটি মসজিদ এবং চাকচিক্যে পূর্ণ মসজিদ এর বাহির এবং ভেতরের দেয়ালের নকশার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন প্রতিটি দর্শনার্থী।
নওয়াব শাহী জামে মসজিদঃ
ধনবাড়ীর ঐতিহ্যবাহী মসজিদ হচ্ছে নওয়াব শাহী জামে মসজিদ। ইসলামি ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্ন ধারণকারী ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নির্দশন হিসেবে ৭০০ বছরের পুরনো মসজিদটি আজো দাঁড়িয়ে আছে মধুপুর উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে। একে নবাব বাড়ীর মসজিদও বলা হয়।
মোঘল স্থাপত্যের চিহ্ন দেখা যায় মসজিদটিতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই। মসজিদের দেয়ালগুলো নানা নকশা ও কারুকার্য খচিত মোজাইক ও মার্বেল পাথর দ্বারা নিপুণ ভাবে তৈরি করা হয়েছে।পাথরে লতাপাতা আঁকা রঙিন নকশা, কড়ি পাথরের টেরাকোটা নকশা দেখেই চোখ জুড়ানো অনুভূতি।
মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে ষোড়শ শতাব্দীতে। ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামক দুইভাইয়ের যৌথ উদ্যোগে ১০ কাঠা জমির উপর মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। শুরু লগ্নে এটি ছিলো মাত্র ১ কক্ষ বিশিষ্ট মসজিদ। সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটির সম্প্রসারণ ঘটে।মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য আছে ৫ টি দরজা। দরজাগুলো খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত। রয়েছে ৩৪ টি গম্বুজ, ১০ টি মিনার। মিনারগুলোর উপর চাঁদের নকশা করা হয়েছে তামা দিয়ে।মসজিদটিতে প্রায় ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে।
মসজিদের পাশেই আছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মাজার শরীফ। এখানে বিগত ৯২ বছর ধরে ২৪ ঘণ্টা কুরআন তিলাওয়াত করা হচ্ছে। এক মিনিটের জন্যও কুরআন তিলাওয়াত বন্ধ হয় না।৭ জন কারি পালাক্রমে কুরআন তিলাওয়াত করেন।এর পাশেই আছে ৭ বিঘা আয়তনের এক বিশাল দীঘি। দীঘিটিতে আছে শান বাঁধানো ঘাট। ফলে মানুষ অযু সহ গোসলের কাজেও দীঘিটি ব্যবহার করে থাকে।
প্রতিদিন দূর দূরান্ত থেকে মসজিদটি দেখতে শত শত মানুষ সমাবেত হয়।ধনবাড়ি জমিদার বাড়ি পাশে হওয়ায় এখানে গেস্ট হাউজ রয়েছে ফলে দর্শনার্থীদের থাকা, খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয় না।একসাথে ঘুরে দেখা যায় জমিদার বাড়ি ও ঐতিহ্যবাহী নবাব মসজিদটি।
পাকুল্লা শাহে জামে মসজিদঃ
টাঙ্গাইল জেলায় অবস্থিত যে মসজিদগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম নির্দশন হিসেবে দাড়িয়ে আছে এদের মধ্যে অন্যতম একটি হলো পাকুল্লা শাহে জামে মসজিদ। এটি দেলদুয়ার থানার পালপাড়ায় অবস্থিত।মসজিদটির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে দিল্লির আওরঙ্গজেবের মতি মসজিদ, বর্ধমানে খাজা আনোয়ার শহীদের সমাধি এবং ঢাকার কাজী খাজা শাহবাগের মসজিদের।
পাকুল্লা মসজিদটির মূল কাঠামোতে আছে মধ্যযুগীয় স্থাপত্য রীতির অনন্য নিদর্শন। ধারণা করা হয় সতেরো কিংবা আঠারো শতকে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিলো। এটি ৩টি খিলান, ৪টি বুরুজ,৩টি মিহরাব,৩টি গম্বুজ বিশিষ্ট নানা নকশায় তৈরি করা হয়েছে । খিলানগুলো আড়াআড়ি খাঁজবিশিষ্ট এবং মিহরাবের চারদিকে তাকাতেই চোখে পড়ে পলেস্তরার স্ট্যাকো নকশা। এই নকশা গুলোতে স্থান পেয়েছে পদ্মপাপড়ি, পাতা, ফুল, দড়ি ও নানা জ্যামিতিক আকারের নকশা। যা মসজিদটিকে করে তুলেছে আরো দৃষ্টিনন্দন।
বুরুজগুলো অষ্টভুজাকৃতির এবং একেবারে ছাদের উপর পর্যন্ত উঠে গেছে।আয়তাকার মসজিদটির উভয় পাশেই আছে দুটি ছোট চৌচালা আকৃতির ঘর। এগুলো ইট ও পলেস্তরার দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। যেগুলোর প্রবেশপথ মসজিদের ভেতরে ও বাইরে দুইদিকেই।এগুলো মকতব এবং ইমামের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
দৃষ্টিনন্দিত এই মসজিদটির কারুকাজ সংস্কারের অভাবে আজ অনেকটাই বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। দেয়ালে দেয়ালে ফাটল এবং অনেকাংশ ভগ্নদশাগ্রস্থ।উপযুক্ত সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদটি আবারো ফিরে পেতে তার হারানো সৌন্দর্য এবং ঐতিহ্য।
বল্লা আহলে হাদীস জামে মসজিদঃ
এত বিশাল একটা মসজিদ, জেলা সদর থেকে এত ভেতরে অথচ এর রূপ এর কোন ঘাটতি নেই। অসম্ভব সুন্দর দেখতে এ মসজিদ টি টাঙ্গাইল এর কালিহাতী থানার বল্লা গ্রামে অবস্থিত এবং ধারণা করা হয় আহলে হাদীস এর সবচেয়ে বড় জামে মসজিদ। আল্লামা মোহাম্মদ আবদুল্লাহেল আফী আল-কোরায়েশী এর কাজ শুরু করেন ১৯৪২ সালে।
খুব ই ভালো লেগেছে জেনে যে এখানে মহিলাদের জন্য ও জামায়াত এর ব্যবস্থা রাখা আছে। মসজিদটি এত বড় যে এর প্রতি কাতারে ২০০ জন নামাজ পড়তে পারে৷ দোতলা মিলিয়ে মোট ১৫০০০ মুসল্লী একসাথে নামাজ পড়তে পারে। বড় ৩ টি গম্বুজ এর শোভা কতগুণ যে বাড়িয়ে দিয়েছে তা বলাবাহুল্য। তবে হ্যা বড় গম্বুজ তিনটি হলেও এ মসজিদ এর ছাদে অনেকগুলো ছোট বড় মিনার দাঁড়িয়ে আছে যার ডিজাইন এমনভাবেই করা যেন প্রতিটার চূড়া শেষ হয়েছে গম্বুজ এর আকৃতি দিয়ে। আর এই মনোরম ডিজাইন অন্য যেকোন মসজিদ থেকে একে আলাদা করে তুলেছে রূপ সৌন্দর্যে।
মসজিদের ভেতরে কত পিলার ই তো থাকে। খুব ই নজড়কারা এ মসজিদ এর ভেতরের পিলার গুলোর। প্রতিটির মাথা গোল হয়ে এরা নিজেরাও শোভা ছড়িয়েছে৷ মসজিদ এর মিনার আকৃতির অবয়ব রয়েছে প্রতিটি দরজা ও জানালায়, আছে সুন্দর নকশাখোচিত গ্রিল মসজিদ এর চারপাশে যা আলো বাতাসের কোন অভাব রাখেনি এখানে।
ভেতরে ইমাম সাহেবের জন্য রাখা জায়গাটির দিকে তাকালে যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারেনা। নানা রঙ এ খোচিত আছে এখানে লতা পাতা ফুল এর ডিজাইন। সত্যিই অপরূপ এ মসজিদ যে কেউ এক দর্শন এ মুগ্ধ হবেন।
আলালপুর মসজিদঃ
মোঘল স্থাপত্য রীতি ও আধুনিক স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন হচ্ছে আলালপুর মসজিদ। টাংগাইল এর দেলদুয়ার উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের আলালপুর গ্রামে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরো কমপ্লেক্সটি ১২ একর জায়গার উপর অবস্থিত।যার প্রতিষ্ঠাতা অত্র গ্রামের কৃতি সন্তান আলহাজ্ব আবুল কাশেম।
মোট ৩ একর জায়গার উপর মসজিদটি নির্মাণ কাজ চলছে। সুউচ্চ দুটি গম্বুজ আছে যা দূর থেকে দেখেই শনাক্ত করা যায়।খাঁজকাটা দেয়ালের কাজগুলো এখনোও নির্মানাধীন।চারপাশের দেয়ালগুলো ত্রিভুজ আকৃতির ফাঁকা জায়গা আছে। যেখান দিয়ে মসজিদে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে।মসজিদটির ভেতরেই আছে তিনতলায় উঠার সিঁড়ি। সৌন্দর্যের দিক থেকে অত্র এলাকা তথা আশেপাশের গ্রামের মানুষের কাছে বেশ নাম কুরিয়েছে মসজিদটি। মসজিদটির সৌন্দর্যকে যেন আরো এক ধাপ সুন্দর করতে পাশেই পুকুর খনন করা হয়েছে।
পুরো কমপ্লেক্সটিতে আছে মাদরাসা,এতিমখানা, মাধ্যমিক স্কুল, হেফজখানা,পোস্টঅফিস,কমিউনিটি ক্লিনিক। চলছে মসজিদ এর কাজ, কোন সন্দেহ নেই যে সৌন্দর্যে ভরপুর ওকটি মসজিদ এটি।
তেবাড়িয়া জামে মসজিদঃ
একটি মসজিদ কে ঘীরে এলাকাবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাস কতটা প্রবল হতে পারে, সেই বিশ্বাস এর রেশ ধরে হাজারো মানুষ এখনো ভীড় করে মসজিদ এ, নামাজ আদায় করে৷ বলছিলাম তেবাড়িয়া মসজিদ এর কথা।
সেই সপ্তদশ শাতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকেই এ মসজিদ এর গোড়াপত্তন হয়। এই মসজিদ টি নির্মাণ এর ও বেশ কিছু সময় পর যমুনা নদীর পাড় ভাঙ্গা শুরু করে। খরস্রোতা যমুনায় ভেসে যায় কতকিছু। অথচ অলৌকিক ভাবে যমুনার ভাঙ্গন এর শেষ হয় মসজিদটির পাড় ঘেষে এবং এরপর ই চর জেগে উঠে যমুনা আবারো চলে যায় অনেক দূরে৷ এই কাহিনী এখানকার সবাই জানে এবং মানে, আর তাইতো মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছাড়া ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকরা ও মসজিদ এর অলৌকিক ক্ষমতা বিশ্বাস করে৷ আর এজন্যই এত বেশি প্রসিদ্ধ এই মসজিদটি।
এটি স্থাপন করেছিলেন মৃধা বংশের আব্দুল মালেক খাঁ মৃধা। স্থানীয় তালুকদার পরিবার ই বংশানুক্রমিক ভাবে এই মসজিদ এর মতুয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন। টাঙ্গাইল এর সলিমাদাবাদ থেকে যাত্রা করতেই যে কেউ এ মসজিদ এর নামে চিনে ফেলে যা তেবাড়িয়া গ্রামে অবস্থিত।
পাছরাচান জামে মসজিদঃ
টাঙ্গাইল এর ইতিহাস কতটা পুরনো তা আমরা সবাই ধারণে করতে পারি এর জমিদারবাড়ির নিদর্শনসমূহ দেখেই। আমি মনে করি এই ইতিহাসের ছোঁয়া সম্বলিত স্থাপনা গুলো আমাদের সম্পদ। তেমনি একটা মসজিদ এই পাছরাচান জামে মসজিদ।
আনুমানিক চারশ বছর হবে এ মসজিদের। আসলে এলাকার মুরব্বিদের কাছে পর্যন্ত এর সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা নেই। কালিহাতির বল্লা সড়কের দক্ষিণে অবস্থিত ঐতিহাসিক চারাণ বিলের উত্তর পাশেই এই মসজিদ টি অবস্থিত। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পরে ১৯৮৭ সালে যখন মসজিদ এর জায়গায় নতুন করে ৬৭ শতাংশ জায়গা মসজিদ এর নামে করে দেয়া হয় সেই সময়ের কাগজপত্রেই এই মসজিদ এর বয়স পৌনে চারশ উল্লেখ তার মানে এখন তার বয়স চারশ’র থেকেও অনেক বেশি।
প্রায় বর্গাকার এ মসজিদটি এত পুরাতন হলেও এর কারুকাজ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের৷ বিশাল একটা গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদ কে এক গম্বুজ মসজিদ ও বলা হয়। মসজিদ টি মার্বেল পাথর এর মেঝে, উপরে লতাপাতায় খোচিত ডিজাইন সব গুলো মনোমুগ্ধকর। মসজিদটির সংস্কার খুব বেশি প্রয়োজন তবেই এটি আমাদের গর্বের জায়গা থেকে হয়ে উঠতে পারে ভ্রমণপিয়াসী মানুষের প্রাণকেন্দ্র।
কাদিম হামজানি মসজিদঃ
কালিহাতি উপজেলার কাদিম হামজানি গ্রামে অবস্থিত অনেক পুরাতন একটি নিদর্শন এই মসজিদ। জীর্ণশীর্ণ হলেও মাথা উঁচু করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তিনটি বড় গম্বুজ সহ এর মূলভবন টি। বড় এই গম্বুজগুলোর পাশেই আছে গম্বুজ আকৃতির বেশ কিছু পিলার যা এই মসজিদ এর সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ধরা দেয় এলাকাবাসীর কাছে।
এগুলো শুধু মসজিদ না, আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে যাওয়া স্থাপনাগুলো সব। বছরের পর বছর আমাদের সন্মান এনে দিয়েছে সব মসজিদগুলো৷ প্রতিটি মসজিদ কে ঘীরে আশেপাশের এলাকার উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে যা চোখে পড়ার মত। দর্শনার্থীদের আগ্রহ ই প্রমাণ করে যে এগুলো প্রতিটিই আমাদের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে যাকে ঘীরে দাঁড়িয়ে যেতে পারে পর্যটন সম্ভাবনা৷ ই-কমার্স আমাদের এই সম্ভাবনাগুলোকে আরো বেশি বেগবান করে তুলছে৷ আর এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত যে সদর থেকে এসব জায়গায় পৌছানো শুধুই ইচ্ছার ব্যাপার৷ তাইতো এই ঐতিহ্য গুলোর বেশি বেশি প্রচারণা প্রয়োজন, লোকসম্মুখে আসলে তবেই তো আগ্রহ বেড়ে যায় আমাদের৷
লেখক,
রোখসানা আক্তার পপি
ইপ্পি শপিং
ইসরাত জাহান জীম
স্বপ্নডিঙ্গা