দেখতে দেখতে কৌতূহল। তারপর নিজেই খোলেন টিকটক অ্যাকাউন্ট। নিজের টুকিটাকি ভিডিও দিতে দিতে পরিচয় হয় টিকটকের কথিত জনপ্রিয় কয়েকজন সেলেব্রেটির সঙ্গে। এদেরই একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূয়া পরিচয়ধারী ‘রাজ’। র্যাবের পরিচয় দেওয়া রাজের বেশভূষা আর ফলোয়ারের সংখ্যা দেখে মজে যান ২৫ বছরের তরুণী হিয়া (ছদ্মনাম)।
পরিচয়ের একপর্যায়ে রাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন হিয়া। ঘনিষ্ঠতা থেকে জড়ান শারীরিক সম্পর্কে। তবে ভূল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি হিয়ার। বুঝতে পারেন প্রতারিত হয়েছেন তিনি। সর্বস্ব হারিয়ে অভিযোগ দেন র্যাবের কাছে। হিয়াসহ ভুক্তভোগী আরও তিন নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হন টিকটক রাজ।
রাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ র্যাব কর্মকর্তাদের। কারণ, হিয়ার মতো শতাধিক নারীকে সর্বস্বান্ত করেছেন বগুড়ার ২৪ বছর বয়সী রাজ। তাকে গ্রেপ্তারের পর র্যাবের কাছে একের পর এক আসতে থাকে ভুক্তভোগী নারীদের অভিযোগ। তারা সবাই টিকটক করতে গিয়ে রাজের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য, গত ১১ মাসে দেড় শ জনের বেশি কথিত টিকটক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা বিতর্কিত এই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে অল্পবয়সী কিশোরী থেকে তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক করে আসছিল। এসব নারীর অনেককে পাচারও করা হয়েছে উন্নত জীবন যাপনের প্রলোভন দেখিয়ে।
মূলত মজা করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে চার বর্ণের ‘টিকটক’ অ্যাপটি। সেই মজার অ্যাপটি এখন সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজে পৌঁছে যাচ্ছে ভুল বার্তা। এতে বাড়ছে ধর্ষণ, নারী পাচার ও কিশোর অপরাধ।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে ‘জনপ্রিয়’ টিকটকারদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। কেউ সেলুনে কাজ করে, কেউ দিনমজুরের কাজ করে। কেউবা কোনো দোকানের বিক্রয়কর্মী। এর বাইরে স্কুল, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও কেউ কেউ টিকটকে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে। কম গতির ইন্টারনেটেও টিকটক-লাইকি অ্যাপ চালানো ও ভিডিও আপলোড করার সুযোগ থাকায় ঢাকার বাইরে এমনকি গ্রাম পর্যন্ত এদের ব্যবহারকারী বেড়ে চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকটক সমাজের ক্যানসার হয়ে দেখা দিয়েছে। এই মাধ্যমটি শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। তা না হওয়ায় এটি এখন বিকৃত একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
গত মে মাসে ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি ২২ বছরের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় দুজন নারীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ভারতের পুলিশ। তাদের সবাই ছিল বাংলাদেশি। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায় এই চক্রের মূলহোতা রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু। ওই তরুণীকে এরাই ভারতে নিয়ে যায়। এরপরই টিকটকের মাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মানব পাচারের মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসে।
টিকটক হৃদয় মূলত নির্যাতনের শিকার তরুণীকে টিকটকের ফাঁদে ফেলে ভারতে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে উচ্চ বেতনে চাকরি দেবার কথা বলে অন্যত্র বিক্রি করে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই তরুণী তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে সেই ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে এসব ঘটনায় রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়। এই মামলায় প্রায় ডজনখানেক টিকটকারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যাদের সবাই টিকটকের আড়ালে পাশের দেশে নারী পাচার ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দেশের উঠতি তরুণ-তরুণীদের একটি অংশ এখন টিকটকসহ বিভিন্ন মিউজিক অ্যাপসমুখী। আর এই অ্যাপসকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ। এসব গ্রুপের নারী সদস্যদের ভারতের বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির অফার দিয়ে প্রলোভনে ফেলে বহুল পরিচিত টিকটকাররা। এরপর নানা কৌশলে ভারতে নিয়ে যান তারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পৃথক অভিযানে গ্রেপ্তার টিকটকারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, দেশে টিকটকের আড়ালে মানবপাচার ও অনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মূলহোতা টিকটক হৃদয়, নদী আক্তার, বস রাফি, ম্যাডাম সাহিদা। এদের মধ্যে ২৮ মে ভারতে হৃদয় গ্রেপ্তার হয় এবং ২২ জুন নদী আক্তার ও ৩১ মে রাফি ও ম্যাডাম সাহিদা গ্রেপ্তার হন র্যাবের হাতে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সারা দেশ থেকে টিকটকের আড়ালে এসব চক্রের মাধ্যমে এরই মধ্যে কয়েক হাজার মেয়ে পাচার হয়েছে। রাফির মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক নারীকে পাচার করা হয়েছে। আর ম্যাডাম সাহিদার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সাহিদা দেশে একটি সেফ হাউস পরিচালনা করত, আর তার দুই মেয়ের ভারতে রয়েছে সেফ হাউস।
দুই বোনকে তিন লাখে ভারতে বিক্রি
বছর দুই আগে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দরিদ্র পরিবারের দুই তরুণী চাকরি নেয় শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজার এলাকার একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে। পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত তারা। সেখানেই টিকটক চক্রের নারী পাচারকারীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে তাদের। চক্রের সদস্য সুজন নেত্রকোনার ও অপরজন ইউসুফ ময়মনসিংহের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য পাশাপাশি বসবাস, দেখা-সাক্ষাত শুরু করে। একপর্যায়ে বড় বোনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে ইউসুফ। মাসে ৫০ হাজার টাকা আয়ের লোভ দেখিয়ে তারা দুই তরুণীকে নিয়ে টিকটক ভিডিও বানায়। এরপর জীবননগর সীমান্ত দিয়ে ভারতের রানাঘাট এলাকায় নিয়ে দুই বোনকে তিন লাখ টাকায় নারী কারবারিদের কাছে বিক্রি করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের দিঘা এলাকার বিভিন্ন বাসায় ও হোটেলে রেখে তাদের দিয়ে দেহব্যবসা চালানো হচ্ছিল। পরে পাচারকারীদের নজরদারি এড়িয়ে দুই বোন পালিয়ে অন্য প্রদেশে যায়। পরে একটি এনজিওর সহায়তায় তাদের দেশে ফেরানো হয়।
টিকটকের জনপ্রিয় মুখ নদীও নারীপাচারে
নদী আক্তার ইতি। এটি তার একমাত্র নাম নয়। আরও ১০টি নামে নিজের পরিচয় দিতেন। আর টিকটকের আড়ালে তিনি নারী পাচারকারী দলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতেন। ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে তিনি নারী পাচার করেছেন তিনি। ২১ জুন নদীসহ তার চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে রাজধানীর হাতিরঝিল থানা পুলিশ। এই নদীর ভারতীয় আধার কার্ডও ছিল। নদীর স্বামী ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজীব হোসেন। মারা পড়েন ক্রসফায়ারে।
‘টিকটক সেলিব্রেটি’ বানানোর প্রলোভনে ধর্ষণ
ফেসবুকে কম বয়সী মেয়েদের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ করে ‘টিকটক সেলিব্রেটি’ বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে অপহরণ ও ধর্ষণ করছিল চক্রটি। ১১ নভেম্বর এক কিশোরীকে উদ্ধারের পর খিলগাঁও ও বনানী থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জানা গেছে, ওই কিশোরী হারিয়ে গেছে মর্মে ৮ নভেম্বর হাতিরঝিল থানায় একটি নিখোঁজ জিডি করেন তার ভাই। এরপর ছায়া তদন্ত শুরু করে ডিবি পুলিশ। পরে কিশোরীকে তালতলা মার্কেট এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এই তরুণীকে টিকটকে ভিডিও বানিয়ে সেলিব্রেটি করার প্রলোভন দেখিয়ে একটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে ধর্ষণ করা হয়।
নজরদারিতে অশ্লীল ভিডিও তৈরি চক্র
অশ্লীল ভিডিও তৈরিতে জড়িত লাইকি ও টিকটকারদের তালিকা করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই মধ্যে কমপক্ষে ৪০টি গ্রুপের সন্ধান মিলেছে, যারা অশ্লীল ভিডিও তৈরি করে। এসব ভিডিও দেখে তরুণ-তরুণীসহ শিশুরাও বিপথে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ওই সব টিকটক ও লাইকি নির্মাণকারী এবং এসব প্ল্যাটফর্মে অভিনয়কারীদের শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছে পুলিশ ও র্যাব।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, লাইকি, টিকটক, ইমো, মাইস্পেস, ফেসবুক, ইউটিউব, স্ট্রিমকার, হাইফাইভ, বাদু ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে, তা নজরদারি করা হচ্ছে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে টিকটক-লাইকির মতো অ্যাপ বন্ধ করেছে এবং করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে যে অনৈতিক কার্যক্রম যেমন নারীপাচার, প্রতারণা হচ্ছে তা বন্ধে র্যাব প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে।
দেশে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন)। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট কাজী মুস্তাফিজ বলেন, ‘ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে আমরা পৃথিবীর সব মানুষ এক জায়গার বাসিন্দা হয়ে যাই। তাই প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষের যে কেউ অপরাধী কিংবা ভিকটিম হতে পারি। এজন্য প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
কাজী মুস্তাফিজ বলেন, ‘ইন্টারনেটে যেকোনো কাজ আসক্তি কিংবা অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে চলে গেলেই বিপদ। যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই আমাদের ব্যবহার করা উচিত। টিকটক একটা প্রযুক্তি মাত্র। আর কোনো প্রযুক্তিই সর্বাংশে খারাপ নয়। মূলত সেটি কীভাবে আমরা কাজে লাগাচ্ছি এবং তা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক ফল দিচ্ছে, সেটা দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’