বাজেট আসে বাজেট যায়; কিন্তু ই-কমার্স খাত বার বার উপেক্ষিতই থেকে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা হলেও উল্লেখযোগ্য খাতটিকে তেমন গুরুত্বের মধ্যে আনা হয়নি। এবারের বাজেটে ই-কমার্স খাতে সুসংবাদের চেয়ে দুঃসংবাদই বেশি বলেই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বাজেটে এবারও উপেক্ষিত থেকে গেছে খাতটি।
এবারের বাজেট প্রস্তাবেও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের আকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন ধরনের ভ্যাট কমানোর বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। ই-কমার্স ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানিয়েছেন, বাজেটে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো কোনো কাজেই আসবে না তাদের। কেননা গত ৫/৬ বছর ধরেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। এমন কি বিবেচনাও করা হয়নি। এবারও উপেক্ষিত থেকে গেছে ই-কমার্স নিয়ে বাজেট। তাই এবারেরও বাজেটে এই খাতের উন্নয়ন বা সুবিধা হবে না বলেছেন ব্যবসায়ীরা।
এছাড়াও ভ্যাটের বিষয়টিও খুবই হতাশাজনক। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, ই-কমার্স ব্যবসায় ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল গত ৩ বছর আগে। ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর এই কর বাতিল চেয়েছেন। কিন্তু বাজেটে সেটা বিবেচনা করা হয়নি। এমনকি ডেলিভারি সার্ভিস ফির ওপর এখন ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ই-কমার্স সংশ্লিষ্টরা এটাকে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিলেন। সেটাও বিবেচনায় নেয়নি।
ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ডেলিভারি ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাটের কারণে ঢাকার বাইরে পণ্য পেতে গ্রাহকদের অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হয়। ফলে ই-কমার্স সারা দেশে ছড়াচ্ছে না। ই-কমার্সের মতো উদীয়মান খাতে এ ধরনের ভ্যাট থাকাটা ব্যবসার প্রবৃদ্ধিতে বড় বাধা।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘ই-কমার্স খাত নিয়ে প্রতি বছরও নানা ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও কোনো কিছুই বিবেচনায় আনা হয় না। এবারও ৫টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কোনো কিছুই আমলে নেয়া হয়নি এবং হচ্ছেও না। বাজেটে ই-কমার্স খাতের খুব একটা লাভ হবে না আবার ভয়ের একটা কারণও আছে। এই বাজেটে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমে যাবে। আর ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমে গেলে ই-কমার্স ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা। ই-কমার্স খাত নিয়ে অনেক প্রত্যাশার কথা শোনা যায়, কথাগুলো কতটুকু সত্য সেটা মিডিয়াকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য অনুরোধ করছি। আর নিজেদের দাবির জন্য নিজেদের কাজ করতে হয়। ই-কমার্স সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে কাজ করতে হবে। নিজেদের দাবির জন্য, ভালো-মন্দের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
চালডালের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলামেডসের পরিচালক ওয়াসিম আলিম বলেন, ‘প্রতিবারেই এনবিআরকে প্রস্তাবনা দেয়া হওয়া হলেও তারা কোনো কিছুই আমলে নেয় না। অনলাইন থেকে অফলাইনেই তাদের কাছে প্রাধান্য বেশি পায়। নতুন এই খাতকে সহযোগিতা করলে এটি বড় একটি খাতে পরিণত হবে। কারণ ই-কমার্স খাত বিপুল সম্ভাবনাময়। এখানে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ সব ধরনের ব্যবসায়ীরাই যুক্ত আছেন। তাই সকলের প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতা থাকলে এই খাতে ভালো কিছু করা সম্ভব।’
সিন্দাবাদের কো-ফাউন্ডার এবং আরটিএস এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জীশান কিংশুক হক বলেন, ‘করোনার ২ বছর যারা দাঁতে-দাঁত-চেপে, ভ্যাট-ট্যাক্সের জটিলতায় খাবি খেয়ে, রোদ-বৃষ্টি-করোনা উপেক্ষা করে মানুষের কাছে তবুও পণ্য পৌঁছে দিয়েছে, তাদের জন্য এই বাজেটে আসলে কিছুই নেই। বরং, এদের অপারেশন চালানোর, কম্পিউটার আর প্রিন্টারের কালি কেনার খরচ, সেবার উপর ভ্যাট বেড়ে গেল। মূল সমস্যাটা হচ্ছে, যারা বাজেট তৈরি করছেন, ই-কমার্সের বিষয়ে তাদের মানুষের কাছে নিয়ে আসা হয়নি। পলিসি পর্যায়ে কাজের ব্যর্থতার দায়ভার সংগঠনকেই (ই-ক্যাব) নিতে হবে। আমাদের বেদনার জায়গাগুলো এবং তাতে গ্রাহকদের কি কি ক্ষতি হচ্ছে, এটা যেমন বোঝানো দরকার; তেমনি দরকার নীতি-নির্ধারকদের দেখিয়ে দেয়া যে নম্বর কোথা থেকে আসবে।
ই-কমার্স উদ্যোক্তা এবং আমার শপ ডটকম ডটবিডি’র সিইও রুনা আমির বলেন, ‘আমরা যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছি তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। কারণ গত কয়েক বছর অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে এবারের বাজেট আমাদের জন্য সুফল আনবে বলে মনে হচ্ছে না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এই বাজেট খুব একটা সুখবর নয়। কেননা একদিকে যেমন ভ্যাটের ব্যাপার আছে অন্যদিকে ডেলিভারিতেও খরচ বাড়বে। আমি মনে করি, ই-কমার্স সংগঠন ই-ক্যাবকে এগিয়ে আসতে হবে এবং এসব বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।’
জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটাতে এবং ই-কমার্স খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে অধিকতর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘ই-বাণিজ্য করব, নিজের ব্যবসা গড়ব’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ই-কমার্স বিষয়ে নতুন উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে ই-কমার্স বিষয়ক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে সিডিবিসি চালু করার লক্ষ্যে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি পরিচালনা করা হবে। এতে ভার্চুয়াল লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থ আদান-প্রদান সহজ হওয়ার পাশাপাশি স্টার্টআপ ও ই-কমার্স ব্যবসা উৎসাহিত হবে। আমাদের সরকারের যুগোপযোগী পদক্ষেপের কারণে দেশে ইন্টারনেট ও ই-কমার্সের প্রসার ব্যাপক হারে বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে সিডিবিসি চালুর লক্ষ্যে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি পরিচালনা করা হবে।’
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৬০০ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-ক্যাবের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে এবং ফেসবুক বা এফ-কমার্সের মাধ্যমে অনলাইনে আরও প্রায় ২ লাখ উদ্যোক্তা ব্যবসা করছেন।