বিগত কয়েক বছর থেকেই দেশে অনলাইন কেনাবেচা জনপ্রিয় হচ্ছে। শহরের মানুষ যান-জট উপেক্ষা করে ঘরে বসেই কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। করোনা অতিমারি যখন সারা বিশ্বের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে নাজেহাল করে তুলেছিল, তখন ই-কমার্স ও ডেলিভারি কোম্পানিগুলোই ছিল মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা। কোভিডের প্রথম বছর অনলাইনে বেচাকেনা বেড়ে যায় প্রায় ৩০০ শতাংশ, ১ লাখ নতুন উদ্যোক্তার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে ৫ লাখ কর্মসংস্থান। যেখানে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৪০-৪৫ শতাংশ, কোভিডে লেনদেন বৃদ্ধি পেয়ে খাতটির মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
তবে সময় এসেছে নতুন এই খাতটির প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবার, বিশেষ করে, ভ্যাট ও ট্যাক্স নির্ধারণের আলোকে। দেশের মাত্র ২ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে আছে ই-কমার্স খাত, তাই এখনি যদি এই খাতে প্রতিষ্ঠিত খাত গুলোর সমতুল্যে ভ্যাট ও ট্যাক্স বর্তানো হয় সেক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হবে এবং ফলপ্রসূ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পরবে।
রাজধানীর বনানীর দারাজ বাংলাদেশের এর প্রধান কার্যালয়ে টেকজুম ডটটিভির সাথে ই-কমাস খাতের বর্তমান-ভবিষ্যত এবং ২০২২-২৩ সালের বাজেট নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন দারাজের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ. এইচ. এম. হাসিনুল কুদ্দুস রুশো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন মিরাজুল ইসলাম জীবন।
টেকজুম : এবারের বাজেট এবং ই-কমার্স খাত নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?
রুশো: ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা হলেও উল্লেখযোগ্য ই-কমার্স খাতটিকে গুরুত্বের মধ্যে আনা হয়নি, বাজেটে এবারও উপেক্ষিত থেকে গেছে খাতটি। সম্প্রতি প্রকাশিত ফাইন্যান্স বিল (২০২২-২০২৩)- এ দেখা গিয়েছে যে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলি বিজনেস সাস্টেইনেবিটি ইস্যু যেমন লস ক্যারি ফরওয়ার্ড (৯ বছর) এবং ন্যূনতম ট্যাক্স (০.১%) এর ক্ষেত্রে অনুকূল প্রণোদনা পেয়েছে। আমরা উদ্যোক্তা বিকাশের স্বার্থে নীতিনির্ধারকদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সাধুবাদ জানাই, কারণ স্টার্টআপের জন্য ব্যাপক বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন । তাছাড়াও সত্ত্বেও, ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে, স্টার্টআপ একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই শুধুমাত্র বৃহত্তর শিল্পের একটি অংশকে উৎসাহিত করা কাঙ্খিত প্রবৃদ্ধি আনতে পারে না, তাই সামগ্রিকভাবে ই-কমার্স শিল্পকেও বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা উচিত। একটি টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক পরিকল্পনার জন্য বিশাল তহবিলের প্রয়োজনের কারণে ই-কমার্স সেক্টর যেটি বিদেশী বিনিয়োগের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, স্পষ্টতই এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দারাজ, চালডাল, শপআপ, পাঠাও এর মত প্রতিষ্ঠান সমূহ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই সেক্টরে প্রচুর বিনিয়োগ করে আসছি এবং এখনও লোকসানে রয়েছি তাই এই ক্ষেত্রটিকে বিশেষ বিবেচনায় রাখতে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে।
টেকজুম : দেশের শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে, গত ৭ বছরে ই-কমার্স সেক্টরের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং উত্থানের বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
রুশো: দেশের শীর্ষস্থানীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দারাজের এই উত্থানটা একেবারেই সহজ ছিলনা । দারাজের নিরলস প্রচেষ্টার ফল্প্রসু ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবা আমাদের কে তাদের ইকোসিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করেছে, আমরা এখন দেশের ৬৪টি জেলায় আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, ৪৪,০০০ সেলার দারাজের প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রি করছে। যেখানে মাত্র ১০০টি পণ্য নিয়ে দারাজ যাত্রা শুরু করে সেখানে বর্তমানে প্রায় ২.৫ কোটিরও বেশি পণ্য দারাজে কাস্টমাদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের ই-কমার্স একটি সম্ভাবনাময় খাত, আমরা প্রত্যাশা করছি, আগামী পাঁচ বছরে ই-কমার্সে পাঁচ কোটি গ্রাহক হবে। এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করছে, যা এই খাতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। এই সেক্টর বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় আমরা সরকার, ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ই-ক্যাব কে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
টেকজুম : বিদেশী বিনিয়োগের উপর বেশি নির্ভরশীল এমন ব্যবসাগুলির উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে বাজেটের ২০২২-২৩?
রুশো: আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে ই-জব সংশ্লিষ্ট খাতের উপর বেশ জোর দিতে বলেছেন এবং বিদেশী বিনিয়োগকারী বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে বলেছেন । কিন্তু যখন ভ্যাট ও ট্যাক্স পলিসি করা হয় তখন তা বিদেশী বিনিয়োগকারী বান্ধব হয়না । দেশের ই-কমার্স খাত মাত্র ২ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে আছে। এখনি যদি এই সেক্টরটাকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে বিদেশী বিনিয়োগ আশার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে যা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। আর যদি বিদেশী বিনিয়োগ আশার ক্ষেত্র ঠিক থাকলে আমরা আগামী ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে গ্লোবাল স্টান্ডার্ডে চলে যেতে পারব।
টেকজুম : মার্কেটপ্লেসের জন্য আলাদা সংজ্ঞা থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
রুশো: বর্তমান ভ্যাট আইনে অনলাইন পণ্য বিক্রয়ের সংজ্ঞায় শুধুমাত্র রিটেইল ক্রয় বিক্রয়কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যেখানে মার্কেটপ্লেসের সংজ্ঞাও সংযোজন করা প্রয়োজন, যা আইনগত ও ভ্যাট প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ এ মার্কেটপ্লেস এর সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে অনলাইন মার্কেটপ্লেস এমন মডেল যা ক্রেতা এবং বিক্রেতাকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমে একটি সেতু বন্ধন তৈরি করে। এর ফলে ক্রেতা সরাসরি বিক্রেতার এনলিস্ট করা পণ্য থেকে বেছে নিজের পছন্দের পণ্য বা সেবা কিনতে পারেন এবং প্ল্যাটফর্ম প্রোভাইডার এই পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয় এবং বিক্রেতার পক্ষে পণ্য মূল্য সংগ্রহ করে। অতএব, যথার্থ শ্রেণীকরণ ছাড়া অনলাইন মার্কেটপ্লেস ক্রমাগতভাবে কার্যকরী অসুবিধা ও বাধার সম্মুখিন হবে কারণ তাদের কার্যক্রম রিটেইলার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।