বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন (ইভি)। চাহিদা বাড়ায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিবেশবান্ধব এ গাড়ি উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ব্যাটারির জন্য বৈশ্বিক ইভি বাজারটি অনেকাংশে চীনের ওপর নির্ভরশীল। ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্যযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাটারি তৈরিতে চীন নির্ভরতা কমাতে চাইছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ সস্তা ব্যাটারি উৎপাদন করা। এমন পরিস্থিতিতে সোডিয়াম ও সালফারের মতো সস্তা উপকরণ ব্যবহার করে নতুন ব্যাটারি উৎপাদনের চেষ্টা করছে মার্কিন ও ইউরোপীয় স্টার্টআপগুলো।
বর্তমানে ইভিগুলো লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে চালিত হয়। এ ব্যাটারি লিথিয়াম, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ ও উচ্চ গ্রেডের নিকেল দিয়ে তৈরি। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসব ধাতুর দাম ক্রমবর্ধমান রয়েছে। এতে কম দামি ইভি উৎপাদন ক্রমেই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। আবার এসব ধাতুর ক্ষেত্রে আধিপত্য রয়েছে চীনের। বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের তিক্ততা এসব উপকরণের সরবরাহ নিয়ে আতঙ্কিত করে তুলছে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
অন্যদিকে চীনে ব্যাটারির এসব কাঁচামালের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় পশ্চিমা ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করছে, চলতি দশকের মাঝামাঝি নাগাদ ব্যাটারি শিল্পের কাঁচামাল পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। ফলে ইভি খাতটি একটি ধাক্কার মুখোমুখি হবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০২৫ সালের পরে আসা ইভিগুলো সোডিয়াম আয়ন বা লিথিয়াম সালফার ব্যাটারি সেলগুলোয় স্থানান্তরিত হবে। এ ব্যাটারি আজকের লিথিয়াম আয়ন সেলের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত সস্তা হতে পারে। যদিও বিষয়টি সোডিয়াম ও সালফার ব্যাটারির সম্ভাব্য সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে। বার্লিনভিত্তিক থিয়ন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যারাডিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লাইটেন এসব ব্যাটারি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে সংস্থাগুলোকে কিছু প্রতিবন্ধকতা উতরাতে হবে। যেমন সোডিয়াম আয়ন ব্যাটারি এখনো জ্বালানি সঞ্চয় করতে পারে না। পাশাপাশি সালফার সেলের জ্বালানি দ্রুত শেষ হয়ে যায় এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
বর্তমানে ডজনের বেশি স্টার্টআপ নতুন প্রযুক্তির ব্যাটারি তৈরির জন্য লাখ লাখ ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারি অনুদান পাচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত খনন ও কাঁচামাল পরিশোধনসহ ব্যাটারি উৎপাদনে আধিপত্য ধরে রেখেছে চীন। ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেঞ্চমার্ক মিনারেল ইন্টেলিজেন্সের অনুমান অনুসারে, চীন বর্তমানে বিশ্বের কোবাল্ট পরিশোধন ক্ষমতার ৭৫ শতাংশ এবং লিথিয়াম প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতার ৫৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
ব্রিটিশ সোডিয়াম আয়ন ব্যাটারি স্টার্টআপ ফ্যারাডিয়নের প্রধান নির্বাহী জেমস কুইন বলেন, আমরা এখনো চীনের উপাদান সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। আপনি যদি বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রভাবের দিকে তাকান তবে এটি জ্বালানি, অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এশিয়ার ব্যাটারি জায়ান্টগুলোও নতুন উপাদানের ব্যাটারি নিয়ে কাজ করছে। চীনের সিএটিএল আগামী বছর সোডিয়াম আয়ন সেল উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি ২০২৫ সালের মধ্যে লিথিয়াম সালফার সেল উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি এনার্জি সলিউশনের।
এদিকে ইভি ব্যাটারির একক সবচেয়ে ব্যয়বহুল উপাদান হলো ক্যাথোড। এটি ব্যাটারি সেলের খরচের এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী। বেশির ভাগ ব্যাটারিতে এখন দুই ধরনের ক্যাথোডের ব্যবহার করা হয়। নিকেল কোবাল্ট ম্যাঙ্গানিজ (এনসিএম) ও লিথিয়াম আয়রন ফসফেট (এলএফপি)। এনসিএম ক্যাথোডগুলো আরো জ্বালানি সঞ্চয় করতে সক্ষম। তবে এ ব্যাটারি এলএফপির চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। অন্যদিকে কিছুটা কম ব্যয়বহুল এলএফপি ক্যাথোডগুলো সাধারণত কিছুটা কম জ্বালানি সঞ্চয় করতে পারে। তবে এটি অধিক নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হওয়ায় বেশি ব্যবহূত হয়।
খাতসংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে এগুলোর বাইরে অনেক উপকরণই লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির বিকল্প হতে পারে। এক্ষেত্রে সোডিয়াম আয়নের অবশ্যই একটি জায়গা রয়েছে। বিশেষ করে চীন, ভারত ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো ব্যয় সংবেদনশীল বাজারে স্বল্প ব্যয়ের ইভির জন্য এ ব্যাটারি অনেক জনপ্রিয়তা পেতে পারে। সস্তা এসব উপকরণ দিয়ে ব্যাটারি তৈরি করতে পারলে ইভিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালে আনাও সহজ হবে। বর্তমানে ইভি ব্যাটারি প্যাকগুলোর দাম সাধারণত ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত হয়। সুতরাং গাড়ি তৈরির বড় একটি খরচ চলে যাচ্ছে ব্যাটারির পেছনে। এ অবস্থায় ব্যাটারির খরচ কমাতে পারলে গাড়ি নির্মাণ ব্যয় অনেকাংশে কমে যাবে।
ব্যাটারি স্টার্টআপগুলো বলছে, কয়েকটি বড় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাটারি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। চলতি দশকের শেষ দিকে এসব ব্যাটারি প্রযুক্তি বাজারে আসতে পারে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাটারি নিয়ে বিকল্প রাখতে আগ্রহী। মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ডের বিদ্যুচ্চালিত এফ১৫০ লাইটনিং পিকআপ ট্রাকের প্রধান প্রকোশলী লিন্ডা ঝাং বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো ব্যাটারি রসায়ন আসবে। সুতরাং নতুন এসব রসায়নের সুবিধা না নেয়া বোকামি হবে।