প্রেম, বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তরুণ-তরুণীদের ভরসাস্থল এখন ডেটিং অ্যাপ। এই প্ল্যাটফর্মটির মাধ্যমে তরুণরা মনের মানুষ খুঁজে নিচ্ছেন। বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে হঠেছে ডেটিং অ্যাপ। যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপারদের তৈরি টিন্ডার অ্যাপটি পৃথিবীব্যাপী ব্যবহারকারী রয়েছে।
চিঠিপত্র, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরে বহুদিন ধরেই নতুন সম্পর্ক তৈরির জন্য বিশ্বের বহু দেশে ডেটিং অ্যাপসগুলো জনপ্রিয়।
গত কয়েক বছর ধরে সেই ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশের তরুণদের মাঝেও। এখন অনেকেই এসব ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে সঙ্গী খুঁজতে শুরু করেছেন।
এদেরই একজন ঢাকার বাসিন্দা মিজান (ছদ্মনাম)। কিছুদিন আগে টিন্ডার নামের একটি ডেটিং অ্যাপে নিবন্ধন করেছেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমার একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর খুব একা লাগছিল। ইচ্ছা করলেই তো আর নতুন প্রেম হয় না। তাই দুইটা ডেটিং অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম, যদি এখান থেকে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি কারও সঙ্গে মিলে যায়।’
মিজানের মতোই অনেকেই সম্পর্কের খোঁজে ঢু মারেন ডেটিং অ্যাপসগুলোতে।
মিজান জানিয়েছেন, যাদের সঙ্গে তার অ্যাপ ব্যবহার করে দেখা হয়েছে, তাদের একজন একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ হলেও তিনি আসলে এভাবে বিয়ে করার জন্য পাত্র খুঁজছেন। অন্য আরেকজনের এর আগে বিয়ে হয়েছিল, তবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারকারী এক তরুণী জানান, প্রেমের বিয়ে হলেও পাঁচ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার। একটি ছোট মেয়ে আর মাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের ওই কর্মকর্তা।
নাম, পরিচয় জানাতে অনিচ্ছুক এই তরুণী বলেন, আত্মীয়-স্বজন চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমার মেয়েটাকে মেনে নিয়ে বিয়ে করবে, এরকম কারও সঙ্গে মেলেনি। এক বান্ধবীর পরামর্শে বাম্বল অ্যাপে একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম। একা নিঃসঙ্গ থাকতে কার ভালো লাগে?’
‘কাউকে ভালো লাগলে কোথাও দেখা করি, এক সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাই। হয়তো এভাবে কারও সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যাবে, মনের মতো কাউকে পেয়ে যাবো। আর সেটা না হলেও কিছুটা সময় তো ভালো কাটছে।’ বলছিলেন ওই তরুণী।
কী ধরনের ডেটিং অ্যাপ রয়েছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে এখন বেশ কয়েক ধরনের ডেটিং অ্যাপ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এর মধ্যে বেশ কিছু অ্যাপ রয়েছে, যা বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। টিন্ডার, বাম্বল, ওকেকিউপিড- ইত্যাদি হলো বিনামূল্যের অ্যাপ।
বন্ধুত্ব তৈরি করা, নতুন সঙ্গী খুঁজে পাওয়া বা জীবন সঙ্গী খোঁজার জন্যই মূলত এসব ডেটিং অ্যাপ ব্যবহৃত হয়। ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, টেলিফোন নম্বর, ছবি এবং ব্যক্তিগত তথ্য যোগ করে এসব অ্যাপে নিজস্ব অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। সেখানে নিজের আগ্রহের বিষয়গুলোও উল্লেখ করে দেয়া যেতে পারে। এরপর আপনার সঙ্গে মিলতে পারে, এমন সঙ্গীর পরামর্শ দেবে অ্যাপটি। ব্যবহারকারীদের ভেতর থেকে পছন্দের সঙ্গে মেলে, এমন সঙ্গীর পরামর্শ দিতে পারে এসব অ্যাপ। আবার নিজস্ব পছন্দ জানিয়ে সঙ্গী খোঁজাও যেতে পারে।
বাম্বলের মতো কোন কোন অ্যাপে মেয়েদের জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে। এখানে কাউকে পছন্দ হলে মেয়েদের আগে বার্তা পাঠাতে হয়। পরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই বার্তার জবাব পাওয়া গেলে সংযোগ তৈরি হয়, না হলে সেটি মুছে যায়।
সাধারণত ডেটিং অ্যাপে বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে পরিচয়, আলাপচারিতার পর ফোন নম্বর বিনিময় বা দেখা-সাক্ষাতের প্রসঙ্গ আসতে পারে।
অনেক সময় মিথ্যা পরিচয় বা তথ্য গোপন করেও এসব ডেটিং সাইটে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। ভারতসহ অনেক দেশে এসব ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগও উঠেছে।
ফলে সম্পর্ক নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সঙ্গীর দেয়া তথ্য যাচাই করে নেয়া ভালো। কিন্তু আলাপ করার বা দেখা করার পর সম্পর্ক হবে কিনা, সেই সম্পর্কের পরিণতি কি হবে, সেসব নির্ভর করে দুজনের মধ্যে।
কেন ডেটিং অ্যাপের দিকে ঝুঁকছে তরুণ-তরুণীরা
বাম্বল এবং টিন্ডার ব্যবহারকারী মিজান (ছদ্মনাম) বলছিলেন, চাকরি-বাকরি নিয়ে ব্যস্ততার কারণে সামাজিক মেলামেশা বেশি একটা হয় না। তাই বন্ধু খোঁজার জন্যই তিনি এসব অ্যাপ ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এজন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হয় না, নিজেরাই নিজেদের মতো বন্ধু খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
তিনি এখনো ছেলেদের তুলনায় ডেটিং অ্যাপগুলোয় অংশ নেয়া মেয়েদের সংখ্যা কম বলে তিনি মনে করেন।
সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, বিশ্বায়নের প্রভাবে একেকটা গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে সমাজ যেহেতু পরিবর্তনশীল, আমাদের সমাজেও আস্তে আস্তে অনেক পরিবর্তন আসছে।
তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা বিশ্বে ৩০/৩৫ বছর আগে থেকে এটা চালু হয়েছে। সেখানে অ্যাপসের মাধ্যমে চেনাজানা হয়, সম্পর্ক তৈরি হয়।
ধীরে হলেও বাংলাদেশে ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরির প্রবণতা বাড়ছে
একটা সময়েও জুটি বা সঙ্গী তৈরিতে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন ‘ঘটক’রা। এখন সেই জায়গা করে নিয়েছে ম্যাচ-মেকিং প্রতিষ্ঠান। সেই তালিকায় নতুন যোগ হচ্ছে এসব ডেটিং অ্যাপ। প্রযুক্তি আর মোবাইল ফোনের সহজলভ্য হয়ে ওঠায় আরও বিশেষত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ জাতীয় অ্যাপ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বাংলাদেশে যখন নব্বইয়ের দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ম্যাচ-মেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, তখনো এ ধরনের কথা হয়েছিল যে, এভাবে বাংলাদেশে সম্পর্ক তৈরি হয় কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় একটু পার্থক্য আছে। তাদের মতো হয়তো শুধু সম্পর্ক তৈরি করা এখানে মুখ্য হবে না। হয়তো এখানে অনলাইনে চেনাজানা হবে, কিন্তু মূল লক্ষ্য হবে হয়তো একটি পরিণত সম্পর্ক তৈরি করা। সমাজে সবসময়েই নানা পরিবর্তন আসবে, ইতিবাচক হলে সেটাকে গ্রহণ করার কোন বাধা আমি দেখি না।