সাধারণত আমরা শরীরের যে অঙ্গটাকে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে থাকি সেটা পা। মুখের বা হাতের ত্বকের যত্নে আমরা যতটা তৎপর কিংবা যত্নশীল , পায়ের ত্বকের পরিচর্যায় সেই তুলনায় খুব কম সময়ই ব্যয় করা হয়। । আবার কেউ কেউ তো মোটেও পায়ের যত্ন নেন না। প্রকৃতিতে শীত বিরাজমান। এবার শীতের মাত্রা টা আমরা খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছি। এই সময় ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়াটা খুব স্বাভাবিক। তাই মুখের মতো পায়েরও যত্ন নেওয়াটা আবশ্যক।
শীত কিংবা যে কোন সময়ে পায়ের যত্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে পাটের রুম স্লিপার। সাধারণত শীতে পা ফেটে যায় শুষ্কতার কারণে। আর পা ফাটা প্রতিরোধ করার প্রধান শর্ত হলো পায়ের ত্বক কে নরম ও মসৃণ রাখা। ধুলা বালি ও ময়লা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে পা নরম রাখা সহজ হয়। এছাড়াও পায়ের যত্নের অনেক পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু ব্যস্ততার কিংবা সময় স্বল্পতায় তা আর হয়ে উঠে না কিংবা শীতে আর করা হয় না। সেক্ষেত্রে সবথেকে সহজ, সুন্দর উপায় হলো পায়ে স্লিপার পরে থাকা। এতে করে পায়ে ধুলা বালি, ময়লা লাগার সম্ভাবনা কম, ঠান্ডা থেকেও পা কে রক্ষা করা সম্ভব।
কিন্তু বাজারে এতো এতো রুম স্লিপার থাকতে কেন পাটের রুম স্লিপার ব্যবহার করব? প্রশ্ন টা খুব স্বাভাবিক। একই সাথে এর উত্তর জানাও গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য।
স্লিপার কি?
স্লিপার হলো এক ধরনের হালকা পাদুকা যা সহজে পায়ে পরা ও খোলা যায়। মূলত বাড়ির ভিতরে বিশেষ করে ঘরের মধ্যে পরিধানের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। স্লিপার পরার মূল উদ্দেশ্যই হলো পা কে ঠান্ডা থেকে বাঁচিয়ে সুরক্ষিত রাখা। চীনে ৪৭০০ বছর খ্রীস্টপূর্বাব্দে স্লিপার ব্যবহারের কথা জানা যায়।
আমাদের দেশে বাজারে যেসব রুম স্লিপার পাওয়া যায় তার অধিকাংশ ই প্লাস্টিকের সেন্ডেল জাতীয়। এছাড়াও কাপড়ের বা টিস্যু কাপড়ের কিছু রুম স্লিপার পাওয়া যায়। তবে খুবই কম।
আমরা জানি, প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর। আর অন্যান্য যেসব স্লিপার রয়েছে তাও পুরোপুরি পরিবেশ বান্ধব নয় এবং তা আরামদায়ক কি না তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
পাটের রুম স্লিপার এর কিছু উপকারী দিক বা সুবিধা-
১. যেহেতু পাট পরিবেশ বান্ধব তাই এর থেকে উৎপাদিত সকল পণ্যই পরিবেশবান্ধব। পাটের রুম স্লিপার গুলো ব্যবহারের অন্যতম ভালো দিক হলো এটা পরিবেশবান্ধব।
২. পাটের রুম স্লিপার গুলো সাধারণত পাট ও কটন মিক্সড ফেব্রিক্সে তৈরি। তাই খসখসে নয়, বরং সফট বলে স্কিনের কোন ক্ষতি করে না।
৩. স্লিপারের ভিতরে পাতলা ফোম ব্যবহার করা হয় বলে খুব আরামদায়ক হয়। কেননা ফোম দ্রুত পা গরম করে বলে শীতে বেশ আরাম পাওয়া যায়।
৪. এমনিতেই পাটের তৈরি সকল পণ্য টেকসই আমরা জানি। আর পাটের স্লিপারে পাতলা একটা সোল ব্যবহৃত হয় ফলে আরও বেশি টেকসই ও মজবুত হয়।
৫. ওজনে হালকা তাই বাচ্চাদের বা বৃদ্ধদের পরতে সুবিধা হয়।
৬. স্বাভাবিক ভাবে ছিঁড়ে বা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
৬. ওয়াশ করা যায়। এটা খুব ভালো একটা দিক পাটের রুম স্লিপার এর। যেহেতু রুমে পরার জন্য ব্যবহৃত হয় তাই তুলনামূলক ভাবে কম নোংরা হয়। ফলে তেমন ওয়াশের প্রয়োজন হয় না।
৬. প্লাস্টিকের সেন্ডেল বাদে বাজারে যেসব রুম স্লিপার পাওয়া যায় তা সাধারণত বড় একটা সাইজের হয়ে থাকে। পাটের রুম স্লিপার এর ৪ টা সাইজ হয়ে থাকে। ৯”, ১০”, ১১”, ১২”।
৭. মানুষ বরাবর ই কালারফুল কিছু পছন্দ করেন। পাটের রুম স্লিপার গুলো বিভিন্ন কালারের করা হয় বলে যে কোন বয়সের নারী – পুরুষ, বাচ্চা – বৃদ্ধ সবার পছন্দ। সাধারণত সাদা, কালো, লাল,নীল, আকাশী, সবুজ, কমলা, গোলাপি, হালকা গোলাপি রঙের পাটের রুম স্লিপার দেখা যায়।
৮. স্লিপার ব্যবহার শেষে যখন ফেলে দেওয়া হবে যেহেতু পাটের তৈরি তাই স্বাভাবিক ভাবে ই তা মাটি বা পানিতে অর্থাৎ প্রকৃতিতে মিশে যাবে পরিবেশের কোন রকম ক্ষতি করা ছাড়াই।
কোন সাইজের স্লিপার এর চাহিদা বেশি?
বাংলাদেশের জনগণের গড় উচ্চতা অনুযায়ী সাধারণত ১২” সাইজের স্লিপার খুব কম প্রয়োজন হয়। তবে দেশের বাইরের জন্য ১২” সাইজের চাহিদা বেশি। সবথেকে বেশি চাহিদা রয়েছে ১০” এবং ১১” সাইজের। এছাড়াও বাচ্চাদের জন্য ৯” সাইজটা রয়েছে। মোটামুটি ৫-৯ বছরের বাচ্চারা পরতে পারে এই সাইজটা। বয়স অনুযায়ী একটু ছোট বড় হয় যদিও কিন্তু পিছনে রাবার দিয়ে বেল্ট বানিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের পরানো যায়।
শীতে মায়েদের কমন একটা কথা হলো, বাচ্চারা গরম কাপড় পরতে চায় না বিশেষ করে পায়ে জুতা, মোজা মোটেও পরতে চায় না। আমার বাসায় তো এটাই দেখি।
শীতে ফ্লোর মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা থাকে। বেশি শীতে ফ্লোর থেকে শিশিরের মতো ঘামতে দেখা যায়। এ অবস্থায় বাচ্চাদের খালি পায়ে রাখা একেবারে ই রিস্ক। তারা যতই বলুক গরম লাগে, আর জুতা, মোজা কিছু পরতে না চায়, ঠান্ডা কিন্তু লেগেই যায়।
বাচ্চাদের কালারফুল জিনিস পছন্দ। পাটের রুম স্লিপার গুলো বেশ কালারফুল। আর পাতলা ফোম ব্যবহার করায় সফট, আরামদায়ক কিন্তু ওজনে হালকা। তাই বাচ্চাদের অনায়াসে আকৃষ্ট করা সম্ভব।
শীতে বাচ্চাদের ঠান্ডা থেকে সুরক্ষিত রাখতে পাটের রুম স্লিপার গুলো বেস্ট সমাধান হতে পারে।
নারীরা বরাবরই খুব সৌখিন হয়ে থাকে। তাদের ব্যবহার্য সকল কিছুতেই থাকে যেন নান্দনিকতার ছোঁয়া। পাটের রুম স্লিপার গুলোও নান্দনিকতার মাধ্যমে নারীদের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে। রঙিন পাটের রুম স্লিপার গুলো তে ভিন্ন ভিন্ন ফিউশন এ্যাড করা যায়। পাটের চটের উপরে উলের সুতায় তৈরি বিভিন্ন ডিজাইন, কাঠের পুঁথি, কড়ি, সুতা ও অন্যান্য উপকরণের মিশ্রণে পাটের রুম স্লিপার এ ভ্যালু এ্যাড করা যায়।
পাটের রুম স্লিপার এর প্রধান কাঁচামাল হলো পাটের ফেব্রিক্স। যা সহজলভ্য। ফলে পাটের রুম স্লিপার এর গুণগত মান অনুযায়ী দাম খুব কম। ফলে সকল শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ই থাকে।
পাটের রুম স্লিপারের যত্ন-
যে কোন জিনিস যত্নে ভালো থাকে।পাটের রুম স্লিপারও তার ব্যতিক্রম নয়। বাইরে পরার জুতা ও ঘরের পরার স্লিপার এর মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। দুটোতে উপকরণও ব্যবহৃত হয় ভিন্ন ভিন্ন। ভালো মানের স্লিপার গুলো অনায়াসে ৬ মাস ব্যবহার করা যায়। তবে অবশ্য ই কিছু দিকে খেয়াল রাখা উচিত –
১. কোন ভাবে ভিজে গেলে শুকিয়ে নিতে হবে। পাট যেহেতু পচনশীল তাই বেশি ভেজা অবস্থায় রাখা উচিত নয়।
২. অল্প ময়লা হলে ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে শুকিয়ে নিতে হবে।
৩. যখনই ওয়াশ করা হবে খুব ভালো ভাবে রোদে শুকিয়ে নেওয়া উচিত।
৪. ওয়াশ করার সময় খুব বেশি ব্রাশ দিয়ে ঘষামাজা করা উচিত নয়। হাত দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ই ধুয়ে নিতে হবে।
৫. ওয়াশ করার পর পানি ঝরানোর জন্য মোচড়ানো যাবে না।
সোনালী আঁশ খ্যাত পাট বাংলার ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম। বহুমুখী পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
৩ হাজার বছর পূর্বে বাংলাদেশের গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে পাট চাষ শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলায় পাট চাষ হয়ে আসছে। ১৮৫০ সালে আবার নতুন করে বাংলায় পাট চাষ শুরু হয়েছিল নতুন উদ্যোমে। আর বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ পরিচিতি পায় “সোনালী আঁশের দেশ” হিসেবে। বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশে আবার সোনালি আঁশের সোনালি সুদিন ফিরে আসতে শুরু করেছে।
একটা সময় ছিল যখন পাটের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বস্তা, দড়ি, ছালা, দড়ি, চট, বাজারের ব্যাগ এর মতো সস্তা কিছু পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে নান্দনিক, আধুনিক ও উন্নতমানের পণ্য তৈরি হচ্ছে পাট থেকে।
গত কয়েকবছর ধরে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুতা, এর মধ্যে পাটের রুম স্লিপারও রয়েছে, যা বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। পাটের এমন নতুন নতুন ব্যবহার যেমন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, একই সাথে কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি করছে।
তরুণ উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ইনোভেশন ও ফিউশনের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে পাটপণ্য কে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এখন বেশি বেশি করে প্রচারণা প্রয়োজন। আমাদের সৌভাগ্য যে বাংলাদেশ সরকারের পাটপণ্যের প্রতি রয়েছে সুদৃষ্টি। ফলে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে পাটপণ্যকে আরও বেশি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব । বাংলাদেশ সরকার পাটপণ্য হিসেবে ২৮৫ টি পণ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে যা সবই দেশের বাইরে রপ্তানি হয়ে থাকে। পাট পণ্যের প্রধান রপ্তানিকারক হলো তুরস্ক। পাটের রুম স্লিপার গুলো মধ্যপ্রাচ্য সহ আরও অনেক দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।
পাটের রুম স্লিপার কে জনপ্রিয় করতে আরও বেশি প্রচারণা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফেইসবুক । ফেইসবুক মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের প্রচারের যে ঢেউ ই – ক্যাব প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট শ্রদ্ধেয় রাজীব আহমেদ স্যার শুরু করেছিলেন সেই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ধরনের পাটপণ্যের প্রচার করছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। পাটের রুম স্লিপার গুলো ফেইসবুক মাধ্যমে বেশ ভালো পরিচিতি অর্জন করছে। শুধুমাত্র উদ্যোক্তারা নয়, ক্রেতা – বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচারই এর পরিচিতি ও ব্যবহার বাড়াতে পারে।
উল্লেখ্য, পাট বাংলাদেশের সম্ভাব্য জি আই পণ্য। জি আই স্বীকৃতি পেলে দেশের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। ইন শা আল্লাহ। বাংলাদেশ সবথেকে ভালো জাতের পাট উৎপাদন ও রপ্তানি তে বিশ্বে ১ম অবস্থানে রয়েছে। পাটের ইনোভেটিভ পণ্য বিশ্ব বাজারে পৌঁছে দিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সকলকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।
Ruma Akhter
Owner of Jute Heaven