তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের সমাজের জন্য বয়ে আনছে ভয়ংকর পরিণতি। আজকের দিনে অনলাইন জুয়া সেইসব ভয়াবহ বিপদগুলোর অন্যতম। বিশেষ করে বাংলাদেশের শহরাঞ্চল থেকে গ্রাম পর্যন্ত অনলাইন জুয়া ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং মোবাইল ফোনের অবারিত ব্যবহার এই সমস্যাকে দ্রুত বাড়িয়ে তুলছে। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভে অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ছে। প্রাথমিকভাবে মজা কিংবা সময় কাটানোর নামে শুরু হলেও দ্রুতই এটি নেশায় পরিণত হচ্ছে। অনলাইন গেমের ছদ্মবেশে যেমন বাজি ধরা হচ্ছে, তেমনি হাজারো মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অবাধে চলছে অবৈধ টাকার লেনদেন। এ টাকা দেশের বাইরে পাচার হওয়ার অভিযোগও উঠেছে বারবার।
অনলাইন জুয়ার আরেক ভয়াবহ দিক হলো, এটি সরাসরি অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছে। যারা টাকা হারাচ্ছে তারা হঠাৎ করে চুরি, ডাকাতি বা বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক কলহ এবং আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তও অনলাইন জুয়ার পরিণতি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
সরকারের ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে (১৯৬৭ সালের পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট) জুয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু অনলাইন জুয়ার জন্য আলাদা করে আধুনিক কোনো আইন এখনো নেই। কিছুদিন আগে বিটিআরসি কিছু ওয়েবসাইট ও অ্যাপ বন্ধের উদ্যোগ নিলেও সেগুলো সাময়িক; নতুন নামে আবার ফিরে আসে। আন্তর্জাতিক সার্ভার ব্যবহারের কারণে এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর রমরমা বিজ্ঞাপন এবং ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে প্রচার এই অবৈধ কার্যক্রমকে আরো প্রসারিত করছে। সেলিব্রিটিদের মুখে এসব প্ল্যাটফর্মের প্রচার তরুণদের বিভ্রান্ত করছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
সমাধানের পথ কী?
অনলাইন জুয়া মোকাবেলায় প্রথমত দরকার যুগোপযোগী আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাশাপাশি নির্দিষ্ট করে ‘অনলাইন গেম্বলিং প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
একইসঙ্গে প্রযুক্তির সাহায্যে দেশের সকল অনলাইন জুয়া সাইট এবং অ্যাপ সনাক্ত করে স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকার লেনদেন নজরদারিতে আনতে হবে। যারা এই অবৈধ প্ল্যাটফর্মে আর্থিক লেনদেন করছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
সর্বোপরি, তরুণ সমাজকে এই ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে গণসচেতনতা তৈরি করা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সামাজিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সৃজনশীল প্রতিযোগিতার মতো স্বাস্থ্যকর বিকল্প বিনোদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় অনলাইন জুয়া এখন শুধু আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজই যদি কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী দিনে একটি হতাশ, অপরাধপ্রবণ প্রজন্মের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।
এই অবক্ষয় রোধে এখনই জাতীয় জাগরণ দরকার। আমরা যেন দেরি না করি।