রাজধানীতে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে একশ্রেণীর চালকের চতুরতা ও নতুন নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয়ায় হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। গত কয়েক দিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে যাত্রী আর চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেল যাত্রী হয়রানিতে চালকদের বিভিন্ন কৌশলের কথা।
গুলশান-২ গোল চত্বরে দাঁড়িয়ে ফার্মগেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন আবু রায়হান। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন তিনি। অফিস তার গুলশান-২ নম্বরে। অফিসের জরুরি কাজে তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছাতে হবে ফার্মগেটে। বাসের জন্য অপেক্ষা করার মতো সময় তার হাতে নেই। কিন্তু অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের কোনো চালকই তাকে ফার্মগেটে নিতে রাজি হচ্ছেন না। এক, দুই, তিন করে মোট চারজন চালকের সাথে কথা বলেও তিনি কাউকেই অ্যাপে যেতে রাজি করাতে পারলেন না। প্রত্যেক চালকই তাকে জানালেন, অ্যাপে গেলে পোষায় না। তাই খ্যাপে বা চুক্তি যেতে তারা রাজি আছেন; অর্থাৎ দরদাম করে বনিবনা হলেই কেবল চালকেরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রী পরিবহন করতে রাজি হচ্ছেন।
গাড়ি ভাড়া নিয়ে বিপত্তিতে থাকা রাজধানীতে তিন বছর আগে মোবাইল অ্যাপে যানবাহন চলা শুরুর বিষয়টি আশীর্বাদ হয়েছিল। যদিও মাস তিনেক ধরে জানা যাচ্ছে, যাত্রীদের চুক্তিতে যেতে বাধ্য করছেন চালকরা। অনলাইনে রিকোয়েস্ট পাঠালে বিশেষ করে বাইকাররা বলছেন, ‘অ্যাপে নয়, খ্যাপে যাব।’
যাত্রীদের নিত্যদিনের এই দুর্ভোগের চিত্র এখন পুরো রাজধানীতেই চোখে পড়বে। কিছু কিছু চালক কোনো রাইড শেয়ারিংয়ের আওতায় রেজিস্ট্রেশন না করেই বাড়তি একটি হেলমেট নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছেন মোটরসাইকেল নিয়ে। এসব চালকের অবশ্য অ্যাপে যাওয়ার কোনো সুযোগও নেই। তাই তারা যাত্রীর সাথে খ্যাপ বা কন্ট্রাক্টের মাধ্যমেই চলাচল করেন।
সজিব হোসেন নামের এক চালক জানালেন, কেন তারা অ্যাপে যেতে আগ্রহী হন না। তার মতে, অ্যাপে যাত্রী পরিবহন করা হলে আমাকে শতকরা ২০ থেকে ২৫ টাকা কোম্পানিকে দিতে হবে; অর্থাৎ আমি দিনে যদি দুই হাজার টাকা আয় করি তা হলে দিনশেষে আমাকে চার শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকা কোম্পানিকে দিতে হবে। এর পরও রাস্তায় পুলিশ আর ট্রাফিকের যন্ত্রণা তো আছেই। অন্যান্য খাতেও আমাকে আরো তিন শ’ থেকে চার শ’ টাকা খরচ ধরতে হয়। এভাবে দেখা যায় আয়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই চলে যায় খরচে। আর যদি আমি অফ লাইনে থেকে (অ্যাপসের বাইরে) কন্ট্রাক্টে যাত্রী পরিবহন করি, তা হলে ট্রাফিক পুলিশের বকশিস ছাড়া আমার বাড়তি আর কোনো খরচই নেই।
শুধু চালক একাই নয়, এমনও অনেক যাত্রী আছেন যারা নিজেরাও আবার অ্যাপে যেতে আগ্রহী হন না। বিশেষ করে প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনগ্রসর গোছের এমন যাত্রীই এই তালিকায় বেশি আছেন। দুই দিন আগে মগবাজার চৌরাস্তা মোড়ের দক্ষিণ দিকে আদ-দ্বীন হাসপাতালের গলির সামনে আকবর হোসেন নামের এক যাত্রীকে দেখা গেল ‘ও ভাই’ নামের রাইড শেয়ারিংয়ের এক মোটরসাইকেল চালকের সাথে চকবাজার যাওয়ার জন্য দরদাম করছেন। পেশায় তিনি মুদি দোকানি। তিনি এসব কোনো অ্যাপে বিশ্বাসী নন। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল আকবর হোসেন নিজেও অবশ্য অ্যাপ চালানোর মতো কোনো মোবাইল সেটই ব্যবহার করেন না। চালকের ব্যবহৃত মোবাইলের অ্যাপেও তিনি যাবেন না। তবে অ্যাপে না যাওয়ার পেছনে তার যুক্তি হলো, গন্তব্যে যাওয়ার পর চালক ভাড়া কত দাবি করবে সেটি তিনি আগেই নিশ্চিত নন। তাই যাওয়ার আগেই ভাড়া ঠিক করে নিতে চান তিনি।
পুলিশ বলছে, বাইকারদের এই প্রবণতার বিষয়ে তাদের কাছেও অভিযোগ আসছে। আর নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রেখে ট্রাফিক পুলিশ মোটরসাইকেলের কাগজপত্র পরীক্ষার সময় অ্যাপে যাচ্ছে কি-না সে বিষয়ে নজরও রাখছে। তবে এটি ব্যাপক হারে করা হচ্ছে না বলেও স্বীকার করেছেন একজন কর্মকর্তা।
রাজধানীতে এখন বেশ কয়েকটি কোম্পানির অধীনে এই রাইড শেয়ারিংয়ের পরিবহন সেবা দেয়া হচ্ছে। পাঠাও, উবার, ওভাই, সহজ, পিকমি নামের কোম্পানির অধীনেই মূলত প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, এমনকি বাইসাইকেলও নাগরিকদের পরিবহন ও পার্সেল সেবা দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচার রয়েছে ‘পাঠাও’-এর। গুলশান-২ নম্বরে পাঠাওয়ের প্রধান কার্যালয়ে গত ২৯ আগস্ট কথা হয় এই কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা উসমান সালেহর সাথে।
তিনি জানান, নির্দিষ্ট অ্যাপসের বাইরে গেলে চালক ও যাত্রী দু’জনের জন্য ঝুঁকি থাকে। কেননা অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিংয়ের সেবা গ্রহণ করলে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। কারণ সেবা গ্রহণের শুরুর সময় থেকে যাত্রী তার গন্তব্য পৌঁছা পর্যন্ত যাত্রীর সার্বিক রেকর্ডটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমাদের কাছে রেকর্ড থাকে। তাই আমরা যাত্রীদেরকেও সতর্ক করে এই বার্তাটিই দেয়ার চেষ্টা করি, যাতে যাত্রীদের নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই অ্যাপের বাইরে গিয়ে এই সেবা গ্রহণ না করেন।
তিনি আরো জানান, গত সপ্তাহে রাজধানীর মালিবাগের উড়াল সড়কে মোটরসাইকেলের একজন চালককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। পরে জানা গেছে ওই চালক ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করলেও ওই সময়ে তিনি কোনো অ্যাপ ব্যবহার করছিলেন না। যদি অ্যাপ ব্যবহার করে যাত্রী পরিবহন করা হয়, তা হলে যাত্রী ও চালক উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। কেননা অ্যাপের মাধ্যমে চালক ও যাত্রী দু’জনেরই মোবাইল নম্বর সংরক্ষিত থাকে। এ ছাড়া সময় এবং গন্তব্যও স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের কাছে রেকর্ড থাকে। কিন্তু অ্যাপের বাইরে গেলে কারোরই কোনো তথ্য সংরক্ষিত থাকে না। কাজেই জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টিকেও যদি গুরুত্ব দেয়া হয় তা হলে অ্যাপের বাইরে যাওয়া চালক ও যাত্রী কারো জন্যই নিরাপদ হবে না।
মুসক আইন ও বিধি বিভাগ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এটিকে ‘ভার্চুয়াল বিজনেস’ এর অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। গাড়ি চালক সেবা দেয়ার বিপরীতে যে অর্থ উপার্জন করেন, তা মুসকের আওতায় পড়ে না। কিন্তু আয়ের যে অংশ অ্যাপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নেয়, সেই অংশের ওপর পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে বলা হয়।
সরকারের এই ঠকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আগে সিএনজির ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ প্রতিনিয়ত পাওয়া যেত। এখন অ্যাপভিত্তিক শেয়ার রাইডিংয়ের ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে। মোটরসাইকেলের কাগজপত্র পরীক্ষার সময় অ্যাপে যাচ্ছে কি-না সেটা জিজ্ঞাসা করা হয়।’
‘তবে এটা ঠিক, নানাভাবে শুনলেও আমাদের কাছে এই খ্যাপে চলার বিষয়ে যাত্রীরা খুব একটা অভিযোগ করেন না।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা যাত্রীদেরকে চুক্তিতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এটাতে যাত্রী ও চালক দুজনেরই ঝুঁকি সমান। নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রেখে আমরা এমন চলাচল বন্ধ করতে চাই।’
বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘রাইড শেয়ারিংয়ের কোন নীতিমালা নেই, একটা খসড়া আছে। নীতিমালা না থাকলে আমরা কোনো কিছুর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারি না। কারণ তাদের কোন আইনের আওতায় আনব? তাই এটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ হচ্ছে না।’
অ্যাপ চালানো রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে অবশ্য সরকার নিবন্ধনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য আবেদন করেছে ১৬টি প্রতিষ্ঠান। যদিও এখনো লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াটি শেষ হয়নি।