বাংলাদেশের মত আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু ভয়ংকর জনবহুল দেশে মোটরসাইকেলের মত যান যে বেশিরভাগ মানুষের সেরা পছন্দ হবে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়, তা আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন কিংবা প্যাশন, যেটার কথা ভেবেই বলি। বাংলাদেশ আয়তনে ক্ষুদ্র হতে পারে তবে এখানে মোটরসাইকেলের বিপুল চাহিদা সম্পন্ন একটা বাজার রয়েছে। জেনে অবাক লাগতে পারে, শুধু বাংলাদেশের বাজারেই পনেরোটার বেশি মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দুর্দান্ত ভাবে। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে পছন্দের মোটরসাইকেল কোনগুলো? আজ আমরা আলোচনা করবো সেরা পাঁচটা মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড এবং তাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত মডেলগুলো নিয়ে,
বাজাজ
আমরা সবাই জানি ভারতের সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান বাজাজ। একইসাথে বিক্রি এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাজাজ বেশ দানবীয় একটা বাজার তৈরী করেছে বাংলাদেশে। সরাসরি বাজাজ ব্র্যান্ডের বাজার চিন্তা করলে বাংলাদেশে তেমন সম্প্রসারিত নয় তবে বাজের কিছু সাব প্রডাক্ট বাংলাদেশের বাইকারদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। বাজাজ ২০০০ সালের পর থেকে ভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশে ব্যবসা করার উদ্যোগ নেয়, তারা বাইকিংকে নিত্যপ্রয়োজন থেকে প্যাশনের দিকে বেশি ঝোঁক দেয়, এবং সেভাবেই প্রচার করতে শুরু করে। তারপরের ঘটনা তো রাস্তাঘাটে চোখ মেললেই দেখছি এখন আমরা, শহর থেকে মফস্বল, সব জায়গায় দাপড়ে বেড়াচ্ছে বাজাজের দুই সাব ব্র্যান্ড, পালসার এবং ডিসকভার। বাজজের অন্যান্য মডেল যেমন বাজাজ সিটি কিংবা বাজাজ প্লাটিনাও এদেশে বেশ জনপ্রিয়।
তবে বিক্রির দিক থেকে গত কয়েক বছর ধরেই বাজাজ পালসার ১৫০ এবং বাজাজ ডিসকভার ১২৫ যোজন যোজন দূরে এগিয়ে রয়েছে৷ বাইক দুটি জ্বালানী সাশ্রয়ের দিক থেকে বেশ ভারসম্য পূর্ণ, এ কারণেই এ দুটি বাইক মানুষের পছন্দের তালিকার উপরের দিকে উঠে এসেছে। প্রায় প্রতিটি মোটরসাইকেলের পার্টসের দোকানে কিংবা মেকানিকের কাছে পালসার – ডিসকভারের যে কোন পার্টস পাওয়া যায়, এই সহজলভ্যতাও দুটি ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
অবশ্য এমনও হতে পারে, জনপ্রিয়তার কারণেই সবজায়গায় এদের অতিরিক্ত পার্টস পাওয়া যায়। সবকিছু পর্যালোচনা করে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয় যে, সকল সুযোগ সুবিধার ভারসাম্যপূর্ণতা বাংলাদেশের রাইডারদের সেরা পছন্দ হয়ে উঠেছে বাজাজের পালসার এবং ডিসকভার বাইক দুটো। বাংলাদেশে বাজাজের প্রধান ডিসট্রিবিউটর উত্তরা মোটরস লিমিটেড। তারা বিক্রি পরবর্তী সেবাও দিয়ে থাকে এমনকি মফস্বল শহর গুলোতেও। অনলাইন অফলাইন দুদিক থেকে বাজাজ মোটরসাইকেলের পার্টসের সুলভ মূল্যে সহজলভ্যতা এদেশের বাজারে এদের করে তুলেছে সেরা ব্র্যান্ড।
হোন্ডা
আমরা সবাই জানি হোন্ডা কতটা শক্তিশালী একটা নাম। মানুষের পছন্দ এবং হোন্ডার কোয়ালিটি, কোনটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোন কারণ নেই, বাংলাদেশে তো বটেই, পুরো বিশ্বজুড়েই। এখানে হয়তো আমাদের তালিকার প্রথমে রাখা যায়নি হোন্ডাকে, তবে আমাদের দেশে বছরের পর বছর ধরে প্রথমে থেকেই রাজত্ব করে গেছে হোন্ডা। গত শতাব্দীর শেষ ভাগ ছিল বাংলাদেশে হোন্ডার সোনালী যুগ। কিন্তু যখন থেকে ‘এ্যাটলাস বাংলাদেশ’ হোন্ডার ডিস্ট্রিবিউট বন্ধ করে বাংলাদেশে, ঠিক তখনই ভারতের মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড গুলো বাংলাদেশের বাজার দখল করতে শুরু করে। ফলে বাংলাদেশে হোন্ডার বাজার ক্রমশ ধূসর হতে থাকে গত কিছু বছর ধরে।
তবে বর্তমানে হোন্ডা আবার ফিরে এসেছে ‘বাংলাদেশ হোন্ডা লিমিটেড ‘ নামে, এবং তাদের বাজার পূনরুজ্জীবনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পুরোদমে, পর্যালোচনা করে বলা যায় তারা সঠিক পথেই আছে তবে আগের মত ফাঁকা মাঠে রাজত্বের সুযোগ এখন আর না থাকায় তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে কিছু শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে৷
হোন্ডার প্রোডাক্টসের উচ্চমূল্য এবং তাদের পার্টসের সব জায়গায় সবসময় তেমন সহজলভ্যতা না থাকলেও, তারা ক্রমশ বাজার দখল করছে তাদের প্রোডাক্টের শক্তিশালী কোয়ালিটির জনপ্রিয়তায়। বিশ্ববাজারের সাথে তাল মিলিয়ে হোন্ডা তাদের প্রোডাক্ট লাইন তৈরী করার কাজ করে যাচ্ছে যুগের চাহিদা অনুযায়ী। এসবের পাশাপাশি হোন্ডার উচিৎ দেশজুড়ে তাদের ডিলার পয়েন্ট বাড়ানো এবং পার্টসের সহজলভ্যতা তৈরী করা।
বর্তমানে হোন্ডার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্বোচ্চ বিক্রিত মডেল হোন্ডা সিবিআর সিরিজ। এদের মধ্যে হোন্ডা সিবি হর্নেট ১৬০আর এসডি এবং হোন্ডা সিবি ট্রিগার এসডি মডেল দুটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। দারুণ হেড রোটেশন থাকার কারণে হেভি ট্রাফিকের মাঝেও এই বাইক দুটো বেশ দ্রুত চলতে পারে। হোন্ডার বাইকগুলো জ্বালানী সাশ্রয়ের দিক থেকে বাজাজের চেয়েও বেশি সাশ্রয়ী।
এদেশে হোন্ডার জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ এদের বিক্রি পরবর্তী সেবা, কম ডিলার পয়েন্ট থাকলেও পয়েন্ট গুলোর আফটার সেলস সার্ভিস কোয়ালিটি দারুণ রকমের সন্তোষজনক। মেকানিকাল ইকুইপমেন্টের দিক থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকায় এ নিয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
ইয়ামাহা
অল্প কিছু বছর পূর্বেও এদেশে ইয়ামাহার তেমন ডিস্ট্রিবিউট ছিল না। এমনকি ২০১৬ তেও ইয়ামাহার শোরুম ঢাকার বাইরে কদাচিৎ দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইয়ামাহা, রাজার মত। চমৎকার ইন্জিন এবং দারুণ ডিজাইনের জনপ্রিয় বাইকগুলোতে রাইড করলে আপনি অনুভব করবেন আপনি হয়তো ঠিক উড়েই বেড়াচ্ছেন৷
বর্তমানে বাংলাদেশে ইয়ামাহা প্রোডাক্টের ডিস্ট্রিবিউশন করছে এসিআই মোটরস লিমিটেড। তারা একটার পর একটা শোরুম খুলে যাচ্ছে দেশ জুড়ে, যদিও এখনো তা পর্যাপ্ত নয়৷ তারপরও, বাংলাদেশের বাজারে দিন দিন ইয়ামাহার জনপ্রিয়তা বাড়ছে দুর্দান্ত ভাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ইয়ামাহা নজরকাড়া চমৎকার সব মডেলের বাইক লন্চ করেছে সিসি লিমিটের কথা মাথায় রেখেই৷ তাই ইয়ামাহা বাইক নিয়ে তরুণদের উন্মত্ততা ক্রমশ আকাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে৷ বিক্রির দিক থেকে দেখতে গেলেও, ইয়ামাহা বেশ আক্রমণাত্মক ভাবেই বাজার দখল করছে৷ প্রায় সব ধরণের পার্টসই দেশের ভেতর পাওয়া যায়, এমনকি ডিস্ট্রিবিউটররা অত্যাধুনিক পার্টসটা আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সাথে দেশেও প্রথমদিকেই সহজলভ্যতা নিশ্চিৎ করায় ক্রেতাদের আকর্ষণ বাড়ছে। তারপরও সার্ভিস সেন্টার কম থাকার একটা অসন্তোষ কিছু মানুষের মনে এখনো রয়েই গেছে।
তবে দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেকানিকরা ইয়ামাহার টেকনোলজি সম্পর্কে বেশ ভালভাবেই অবগত এবং অভ্যস্ত। তাই কেনার পর ক্রেতাকে খুব বেশি ঝামেলায় পড়তে হবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়৷ তাছাড়া, এসিআই মোটরস প্রতিনিয়ত সেবা দিয়েই যাচ্ছে ইয়ামাহাকে। তাই সেরা পাঁচ তালিকায় ইয়ামাহাকে বেশ শক্ত স্থানই দিতে হচ্ছে।
ইয়ামাহার বাইকের মধ্যে ইয়ামাহা এফজেডএস এবং ইয়ামাহা এফজেড ফেজার বাইক দুটি সবচেয়ে বেশি বিক্রিত। দুটি মোটরসাইকেলই বাংলাদেশে সবচেয়ে সেরা ডিজাইনের, এটা বলাই যায়৷ বাইকের প্রতিটা অংশ, ছোট থেকে বড় প্রতিটা অংশই যত্নের সাথে ডিজাইন করে রাইডার মানসিক সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম। ভারসম্য এবং দৃঢতার দিক থেকে এদের সেরাদের সেরা বলা যায়। এজন্যই উচ্চমূল্যের পরও তরুণ রাইডাররা প্রায় পাগলের মতই এই বাইকগুলো কিনছে৷ এছাড়াও তাদের জনপ্রিয় মোটরসাইকেলের তালিকায় ইয়ামাহা ওয়াইজেডএফ আর১৫ এর নামও বলা যায়।
টিভিএস
টিভিএস বাংলাদেশে সরাসরি নিজেরাই নিজেদের নামে ডিস্ট্রিবিউশন করছে৷ সারাদেশ জুড়েই টিভিএসের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে৷ তুলনামূলক সস্তা মূল্য এবং জ্বালানী সাশ্রয়ী হওয়ায় টিভিএস দ্রুত বাংলাদেশের বাজারে স্থান করে নেয়ার সুবিধা পেয়েছে। টিভিএসের ব্যবসায়িক কৌশলও টিভিএসকে সময়ের সাথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে৷
টিভিএসের স্পোর্টস ফ্ল্যাগশিপ প্রোডাক্ট এপাচি আরটিআর ১৫০ এবং ১৬০ বাইকগুলো বাজারে থাকা অন্য বাইকগুলোর সাথে দারুণ প্রতিযোগিতায় আছে৷ বাইকগুলো বেশ দ্রুতগামী এবং একইসাথে জ্বালানী সাশ্রয়ী। এদের মূল আকর্ষণই হচ্ছে স্পোর্টি ডিজাইন এবং তুলনামূলক সল্প মূল্য৷ কিন্তু এদের দূর্বল জায়গা হচ্ছে ইন্জিন, ইন্জিন শেইক কিছুটা বেশি হওয়ায় এই বাইকগুলোর বাহ্যিক ক্ষতির একটা শঙ্কা থেকে যায়। এসব সত্ত্বেও মানুষ এপাচি কেনার উন্মাদনায় আছে এদের সল্পমূল্যে দারুণ সব ফিচারের আকর্ষণে।
টিভিএস অতিসম্প্রতি আরো কিছু নতুন প্রোডাক্ট লন্চ করেছে যা সারাদেশেই টিভিএসের ডিস্ট্রিবিউটর শপগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। টিভিএস দিন দিন এমন একটি কোম্পানি হিসেবে আমাদের দেশে দাড়াচ্ছে যাদের এতো বেশি মডেল রয়েছে যে আপনার চাহিদার সাথে কোন না কোনভাবে মিলে যাবেই৷
অন্যদিকে টিভিএস বিক্রি পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে স্থানীয় মেকানিকাল শপগুলোর সাথে সহযোগিতামূলক চুক্তিতে যাচ্ছে, ফলে তাদের পার্টসের সহজলভ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। পার্টসের সহজলভ্যতা এবং তুলনামূলক সল্পমূল্য টিভিএস বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বাজারে অন্যরকম এক চাহিদা তৈরী করেছে৷ তাই সেরা মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডের তালিকায় সন্দেহাতীতভাবে উঠে আসতে পারে টিভিএস।
হিরো
বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বাজারে সবচেয়ে বেশি প্রোডাক্ট সম্ভবত হিরো ব্র্যান্ডের। নিটোল নিলয় গ্রুপ প্রায় পুরো সময় ধরেই বাংলাদেশে হিরো মোটরসাইকেলের ডিস্ট্রিবিউট করে আসছে। বাংলাদেশে হিরোর খুচরা বিক্রিও দারুণ লক্ষনীয়। হিরোর যেমন কিছু জনপ্রিয় কম্যুটার রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু নির্দোষ স্কুটার, নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই৷ হিরো বাংলাদেশের স্পোর্টস বাইক শাখায়ও দারুণ আকর্ষণীয় যেমন তাদের হান্ঙক এবং এক্সট্রিম সিরিজ অনেক বছর ধরেই আমাদের দেশে জনপ্রিয়।
তরুণ রাইডারদের মধ্যে অন্যরকম চাহিদা তৈরী করেছে মডেলগুলো। তবে এদের মূল আকর্ষণ আরামদায়কতা, প্রতিটা মডেলেরই ডিজাইনই এমনভাবে করা যাতে চালক এবং পেছনে পেসেন্জার দুজনই আরামদায়ক ভাবে চড়ে যাতায়াত করতে পারে। ডাবল সাসপেনপেশন থাকার কারণে লম্বা জার্নিতে বেরুলেও তেমন ক্লান্তি অনুভব করে না রাইডাররা।
ঘাতশোষক (Shock Absorbent), ব্রেক এবং বসার সিটের পজিশন দারুণ, সর্বোপরি আরামদায়ক এবং ভারসাম্যপূর্ণ রাইডিং সিরিজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। দেশজুড়ে হিরো’র প্রচুর ডিস্ট্রিবিউটর এবং ডিলার ছড়িয়ে রয়েছে। তারা একইসাথে বিক্রি পরবর্তী সেবাও দিচ্ছে গ্রাহকদের, মোটামুটি তিন বছরের বিক্রি পরবর্তী সেবার নিশ্চয়তা পায় হিরো’র ক্রেতারা, যা অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় অনেক বেশি৷ এছাড়াও সেবার কোয়ালিটি ধরে রাখতে প্রতিনিয়তই হিরো’র অফিশিয়াল মোবাইল টেকনিক্যাল টিম সার্ভিস সেন্টারগুলো তদারকি করে। তাই সেরা ব্র্যান্ডগুলোর তালিকায় হিরো থাকছেই ।