করোনার কারনে গোটা বিশ্ব যেখানে থমকে গেছে সেখানে উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) এর উদ্যোক্তারা ফেইসবুকে মাধ্যমে দেশি পণ্য বিক্রি করে নিজের পাশাপাশি পরিবার, কর্মী, নিকটাত্মীয় ও অসহায়দের জীবিকার ব্যবস্থা করছে। এতে শত শত পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। করোনা কালে উই গ্রুপে দেশী পণ্য বিক্রি ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে মোঃ দেলোয়ার হোসেনের ধারাবাহিক পর্বের আজ শেষ পর্ব ।
ঢাকাইয়া জামদানির উদ্যোক্তা কাকলী রাসেল তালুকদারের উদ্যোগের নাম কাকলী’স এটিয়্যার। উই গ্রুপের বিক্রি সম্পর্কে তিনি বলেনঃ জামদানি এক্সক্লুসিভ এবং স্লো আইটেম হলেও আমার কাকলী’স এটিয়্যার এর জামদানির চাহিদা ভালো। আমাদের নিজের পরিবার ছাড়াও আছে উই পরিবার এবং তাতী পরিবার। আর করোনার মধ্যে তাঁতীদের জীবন জীবিকা সব বন্ধ। উইতে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে জামদানি। আর তা থেকে আমি গতমাস আর এই মাসে মিলিয়ে ৯০ হাজার টাকা আমার তাতীর বিকাশে পাঠিয়েছি।
চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা মৌ বিনতে ইসলামের উদ্যোগের নাম স্পন্দন। তিনি মূলত রেডি টু কুক মাছ মাংস বিক্রি করেন। তিনি বলেনঃ উদ্যোক্তার পাশাপাশি আমি একজন শিক্ষিকা। লকডাউন ঘোষনার আগেই আমার শিক্ষকতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুরোপুরি বেকার হয়ে যাই। এখন ব্যবসাটাই একমাত্র সম্বল। উই থেকে প্রাপ্ত সেল দিয়ে নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি।
ফিসঢাকার উদ্যোক্তা আয়শা সিদ্দিকা কাজ করেন দক্ষিণ বঙ্গের মাছ নিয়ে। তিনি বলেন করোনা পরিস্থিতির কারণে গত একমাস আমার বিক্রি বন্ধ ছিলো। গত একসপ্তাহ থেকে আবার বিক্রি শুরু করেছি এবং এটা যেহেতু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য তাই খুব বেশি সাড়া পাচ্ছি। অফিসারদের বেতন ছাড়াও ১০-১৫ টি দুস্থ পরিবারের মুখে কিছুটা খাবার তুলে দিতে পেরেছি। পরিবারের ঈদের কেনাকাটা ও বাবার হাতে কিছু টাকা দিব ইনশাআল্লাহ।
রাজশাহীর উদ্যোক্তা শাউন আরা জেসমিনের উদ্যোগের নাম আর এস বুটিক এ্যান্ড ফ্যাশান হাউজ। তিনি মূলত মেয়েদের পোশাক বিক্রি করেন। তিনি বলেনঃ করোনায় সব কিছু বন্ধ। এই অবস্থায় আমার শখের ব্যবসা হয়ে উঠে প্রয়োজনীয়। যখন কোথাও বিক্রি হচছিল না আমার বন্ধু উই গ্রুপে এ্যাড করে দেয়। আস্তে আস্তে অর্ডার শুরু হওয়ায় আমার পরিবারের অনেক কিছুই হেল্প হচছে। আমার কর্মীদের অগ্রীম বেতন ও তাদের পরিবারে সাহায্য করতে পারছি। এটা আমার কাছে করোনায় উই থকে সবচেয়ে বড় পাওয়া।
নারায়ণগঞ্জের উদ্যোক্তা তীর্থ খায়ের সিঁথির উদ্যোগের নাম নান্দীপাঠা। কাজ করেন মূলত মেয়েদের পোশাক নিয়ে। তিনি বলেন করোনায় আমার উইতে ৩৫০০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। এতে লাভ হয়েছে প্রায় ৯০০০ টাকা। আমি পুরোটাই কারিগরদের দিয়ে দিয়েছি।
হোমলি ফুডের উদ্যোক্তা সায়মা বেগম বলেনঃ কাজ করছি খাবার নিয়ে। স্বামী স্ত্রী দুজনে পুরোপুরি উই নির্ভর হয়ে ব্যবসা করছি অনলাইনে। রোজার মধ্যে আমাদের ২৬৭০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। প্রতিদিন ৩-৪টা ডেলিভারি থাকছে। গ্রুপে বিক্রির টাকায় চলে আমাদের পরিবার।
ঈশীতা আক্তার তানিয়ার উদ্যোগের নাম ইসরাফ স্টাইল জোন। তিনি কাজ করেন হাতের গয়না ও শাড়ী নিয়ে। তিনি বলেন- এই সময়ে আমি যতগুলো অর্ডার পেয়েছি তার ৭০% উই থেকে। এই অর্ডারের টাকা দিয়ে আমি আমার আব্বা আম্মার জন্য ইফতার বাজার করে দেই এবং বাসার খরচ করছি।
তানজীলা সিদ্দিকার উদ্যোগের নাম ন্যাচারাল চা। কাজ করেন মূলত গ্রিন, ব্লাক ও গোল্ড টি নিয়ে। তিনি বলেন- উই থেকে আমার টোটাল অর্ডার ১৫০০০ হাজার টাকা। আমার বাবা মাকে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য টাকা পাঠাবো।
টাঙ্গাইলের উদ্যোক্তা নহরে জান্নাত মিষ্টির উদ্যোগের নাম আরওয়া। তিনি মূলত শাড়ী বিক্রি করেন। তিনি বলেনঃ এই করোনা পরিস্থিতিতে আমার বিজনেস থেকে উপার্জিত অর্থ থেকে আমার বাবা, তাঁতী, ছেলের হুজুর, কাজের বুয়াকে সাহায্য করতে পেরেছি। বন্ধুদের সাথে মিলে ৭৫ টা পরিবারকে সাহায্য করেছি।
সিরাজগঞ্জের উদ্যোক্তা ইফাত সোলাইমান লোবনার উদ্যোগের নাম লবানা’স কিচেন। কাজ করেন মূলত হোম মেইড ফুড নিয়ে। তিনি বলেন- করোনার সময় উই গ্রুপে সেল করে আমি যে টাকা লাভ করেছি তার পুরোটাই আমি অসহায় কয়েকটি মধ্যবিত্ত পরিবারে দান করেছি। গত দুই মাস হলো আমি আমার আম্মার বাসার একটি ভারাটিয়া পরিবারের পুরো খরচ বহন করে চলেছি।
রাজিয়া এগ্রো ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা রাজিয়া কবির। কাজ করেন নিজস্ব খামারের গরুর খাঁটি দুধ নিয়ে। তিনি বলেন উইতে বিক্রি হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। হঠাত লকডাউন হওয়ায় কর্মচারীদের বেতন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমাদের উপর কয়েকটা পরিবার নির্ভরশীল। কর্মীদের বলেছিলাম অর্ধেকের বেশি বেতন দিতে পারবো না। আলহামদুলিল্লাহ এখন পুরো বেতনটাই দিতে পারবো।
চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা ফারহানার উদ্যোগের নাম আরিহান কালেকশন। তিনি মূলত মেয়েদের পোশাক বিক্রি করেন। তিনি বলেনঃ কাজ করছি দেশীয় হাতের কাজের পোশাক নিয়ে। করোনা পরিস্থিতিতে আমার পেজ থেকে উই এর কিছু আপু খিমার,ড্রেস এবং শাড়ি অর্ডার করেছে। আমি আমার পরিবারের জন্য কিছু না করলেও, মোট ৫টি পরিবারের জন্য আমার ব্যবসায়ের জমানো টাকা দিয়ে সাহায্য করছি।
রংপুরের উদ্যোক্তা ফারদীন জ্যোতির উদ্যোগের নাম রঙ্গিলা রং। বিক্রি করেন রংপুরের শতরঞ্জি। তিনি বলেনঃ এই করোনা পরিস্থিতিতেও আমার শতরঞ্জী বিক্রি হচ্ছে এবং আমার কারিগররাও কাজ করছেন। সব অর্ডার উই থেকে। আমার মুখে তো হাসি এবং আমার কারিগরদের মুখে হাসি।
কুমিল্লার উদ্যোক্তা নুসরাত জাহানের উদ্যোগের নাম নুসরাত,স কিচেন। কাজ করেন হোম মেইড খাবার নিয়ে। তিনি বলেন- এই করোনা পরিস্থিতিতেও আমি উই থেকে অর্ডার পেয়েছি। আর আমি কুমিল্লার হয়েও ঢাকা থেকে অর্ডার পাচ্ছি উইয়ের মাধ্যমে। উই থেকে আমি ১০ দিনে ৮০০০ টাকা ইনকাম করেছি যার থেকে আব্বুর জন্য সদকা দিয়েছি এবং আম্মার জন্য শাড়ী কিনেছি।
উই এর এডভাইজার রাজিব আহমেদ বলেন, “দেশী পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা ভাল করছেন উইতে। এটি অনেক আনন্দের ব্যপার। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরাও অর্ডার দিচ্ছে।“
উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন ‘আমি সবার করোনাকালীন সেলস রিপোর্ট দেখে খুবই আবেগাপ্লুত হয়েছি। করোনার লকডাউনে আমাদের মেয়েরা যেভাবে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে তা সত্যিই খুব প্রশংসনীয়। ওদের টাকা দিয়ে কারিগরদের বেতন, তাঁতিদের খরচ দেওয়া সহ অনাহারী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি সত্যিই খুব গর্ব বোধ করছি’