“দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী। পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই; অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে, যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী আমার পাইবে তবে পরিচয়।।”
নারী মানেই এক অঙ্গে নানা রূপ। কখনো মা, কখনো মেয়ে, কখনো স্ত্রী। কখনো নারী মানে বহ্নিশিখা; কখনো তা জ্বালিয়ে দেয় সমস্ত কলুষতা, কখনো দেখায় আলোর পথ কখনো বা শীতার্ত সমাজকে তপ্ততার আবেশ দেয়। নারী মানে অসাধারণ, নারী মানে অতি সাধারণ। নারী কখনো দেখা দেয় রুদ্রমূর্তিতে, কখনো নারীর দেখা মেলে অপরূপ সৌমাকান্তিতে। আবার কখনো নারী মানে শুধুই নারী; নিজ পরিচয়ে, নিজ মহিমায় গরিয়সী।
৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসকে সামনে রেখে বিশ্বজুড়ে চলছে নানান তোড়জোড়। সম্পূর্ণ বিশ্বে এই একটা দিনকে শুধুমাত্র সর্বস্তরের নারীদের জন্য ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। নারীদের জন্য চারটি অধিকারকে সম্মান এবং প্রাপ্য হিসেবে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিবছর এই দিনটি পালন করা হয়; নারী দিবসের চারটি মূল লক্ষ্য হলো- নারীদের অর্জনকে স্বীকৃতি, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, নারী-পুরুষের সবক্ষেত্রেই সমান অধিকার নিশ্চিত এবং নারীদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। এই কয়টি বিষয় সম্পর্কে এইদিনে সবাইকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু এই সফলতা পাওয়ার জন্য যে যাত্রাপথ, তা কখনোই সহজ ছিলো না। ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্কে নারী বস্ত্রশ্রমিকরা নিজেদের বেতন সাম্যতা সৃষ্টি করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। সেই সময় পুরুষদের সমান কাজ করেও নারী শ্রমিকরা কম বেতন পেতেন। নারী বস্ত্রশ্রমিকরা তাঁদের কাজের সম্মান আদায়ের লক্ষ্যে নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী কাজ আর সমমানের বেতনের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোশালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকার উদ্যোগে ২৮ফেব্রুয়ারী ১৯০৯ থেকে নারীদিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়, এভাবে চলে ১৯১০সাল পর্যন্ত।
১৯১০ সালে নারী শ্রমিকদের দ্বিতীয় বৃহৎ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ১৭টি দেশের নারী প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই সমাবেশে জার্মানির উইমেন অফিসের নেত্রী ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব দেন যে, সারা বিশ্বজুড়ে একই দিনে নারী দিবস পালন করা হবে। কোপেনহেগেন এ এই প্রস্তাবের সমর্থন করে।
প্রথমবারের মতো অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক এবং সুইজারল্যান্ড এ প্রায় ১ লাখের-ও বেশি নারীদের অংশগ্রহণে সুবিশাল এক র্যালি অনুষ্ঠিত হয় ১৯১১ সালের ১৯শে মার্চ। এই র্যালির মাধ্যমে নারীদের প্রাপ্য অধিকারগুলো আদায়ের জন্যও ভিন্ন রকম আন্দোলন করা হয়। নারীদের ভোটদানের অধিকার, নাগরিক অধিকার, কাজে সাম্যের অধিকার, প্রশাসনিকভাবে সহযোগিতা এবং প্রশিক্ষণের অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো এই আন্দোলনে মুখ্য ছিলো।
কিন্তু এর এক সপ্তাহ পরেই অর্থাৎ ২৫শে মার্চ নিউ ইয়র্ক শহরে আন্দোলনরত নারীদের উপর এক অমানবিক হামলা চালানো হয়, যা ইতিহাসে “ট্রায়াংগেল ফায়ার” নামে লিখিত আছে। এই হামলায় প্রায় ১৪০ জন বিভিন্ন দেশীয় নারী শ্রমিক প্রাণ হারান। নারী শ্রমিকদের আন্দোলন এতে আরো বেশি বেগবান হয়ে উঠে। নারী শ্রমিকবৃন্দ “রুটি এবং শান্তি” (bread and roses) ক্যাম্পেইন শুরু করে। এই দুটি বৃহৎ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্ব নারীদের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে এবং ভয়াবহ দিকগুলো চোখের সামনে আসতে থাকে।
১৯১৩-১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে নারীদের অধিকারের বিষয়টি আরও ভালো ভাবে সামনে আসে। আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে থাকে। ইউরোপে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারীদেরও গ্রেফতার করা হতে থাকে।
এতবছর ধরে ২৩শে ফেব্রুয়ারী বা ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার নারী দিবস পালন করে আসা হচ্ছিলো। কিন্তু এই সময় অর্থাৎ ১৯১৪সালে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে যে তারিখ নির্ধারণ করা ছিলো, তা থেকে বদলে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৮ই মার্চ -কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হবে এবং সারা বিশ্ব জুড়ে একই দিনে এই দিবস পালিত হবে।
তবুও রাশিয়া, ইউরোপ এবং এমন বেশ কিছু দেশকে তারপরও আরও অনেক লড়াই, ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে নিজেদের অধিকারকে আদায় করে নিতে হয়েছে এবং এখনো করতে হচ্ছে। জাতিসংঘ ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্ব নারী দিবস পালন করে। প্রথমবারের মতো ইউনাইটেড ন্যাশনস থেকে পালিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো_ “Celebrating the past, planning for the future.”
বাংলাদেশেও প্রতিবছর নানা সমারোহে পালিত হয় দিবসটি। বাংলাদেশে এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য_ “করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব”।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিষ্ঠান ক্ষেত্রেই এখন নারীদের সাফল্য অতুলনীয়। দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে শিক্ষকতা,চাকুরী, ব্যাবসা, অনলাইন উদ্যোগ বা স্টার্টআপ — সবক্ষেত্রেই নারীদের অবদান অদম্য গতিতে বেড়ে চলেছে।
বর্তমানে এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে পুরো বিশ্ব যখন স্থবির, তখন শত শত সংসারের হাল ধরেছেন নারীরাই! অনলাইন ভিত্তিতে উদ্যোগ পরিচালনার মাধ্যমে যেমন সংসারের অর্থনৈতিক সমস্যা মিটিয়ে চলেছেন, তেমনি নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করছেন অনেকেই। নারীদের এই উদ্যোগ ভূমিকা রাখছে দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করে রাখতেও!
প্রতিবছর বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ৫জন সাহসী ও অদম্য নারীকে “জয়িতা” পুরষ্কারে ভূষিত করেন। এবছরও তার ব্যতিক্রম নয়। এবছর “জয়িতা” পুরস্কার পাচ্ছেন— বরিশালের সফল উদ্যোক্তা হাছিনা বেগম নীলা; বগুড়ার মিফতাহুল জান্নাত,যিনি চোখে না দেখেও এগিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষায়, পড়ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে; সেরা জননী পটুয়াখালীর মোসাম্মৎ হেলেন্নছা বেগম, যার ৬ ছেলেমেয়ের প্রত্যেকেই দারুন প্রতিষ্ঠিত। টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিজান এবং নড়াইলের সমাজসেবিকা অঞ্জনা বালা বিশ্বাস, যিনি তার এলাকার নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন নানা কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে।
বাংলাদেশে এবার ১১১ তম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হচ্ছে। নারীদের এত অবদানের পরও এখনো প্রাপ্যের তুলনায় খুব সামান্যই কিন্তু পাচ্ছেন তারা। নারীদের প্রতিদিনের শ্রম আর কষ্টের বেশিরভাগ অংশই পড়ে আছে অগোচরে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখনো লাঞ্ছনা আর অবমাননা নারীদের নিত্য সঙ্গী।
এখনো নারীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান ও সফলতা থেকে দূরে পড়ে আছেন। শুধু বাইরের কর্মজগতেই নয়_ঘরে-সংসারেও প্রতিনিয়ত অনেকভাবে তারা বঞ্চিত এবং অবমাননার শিকার হচ্ছেন। ইদানীং প্রবাসে কর্মজীবী নারীদের উপরেও ভয়াবহ নির্যাতন এবং অমানবিক জুলুম চলছে, যার অধিকাংশই হয়তো চাপা পড়ে যাচ্ছে যোগাযোগ এবং প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে।
জগতের আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ। কিন্তু সেই সেই নিমন্ত্রণ পত্র ক’জনের হাতে এসে পৌঁছাতে পারে? আজ থেকে শত বছর আগেও আমাদের সমাজে নারীদের যে বিদীর্ণ হাল ছিলো, এত বছর পরে এসেও কি তার খুব একটা পরিবেশ হয়েছে? পুরুষশাষিত সমাজে নারীদের এই জীর্ণ দশা তো অতি প্রাচীন। নারীরা অন্তঃপুরবাসিনী, কোনো মতামতের অধিকার তাদের নেই,হোক সেটা ঘরে কি বাইরে, সংসারে কি রাস্ট্রেই। নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অধিকার নেই, তাদের জীবন শুধুই ঘরের কাজ করে যাওয়ার জন্যই!
এই যে স্বাধীনতাপূর্ব ধারণাগুলো, এই বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও তার খুব একটা কি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়? তবে পরিবর্তন আসছে। উচ্চ থেকে উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা বাড়ছে, সেই সাথে কর্মক্ষেত্রেও বাড়ছে নারী ক্ষমতায়নের প্রভাব। নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন,নিজের পায়ের নিচে শক্ত মাটির অবলম্বন পাচ্ছেন।
ধীরে ধীরে হলেও আমরা এখন দৃঢ় চিত্তে আশা করতে পারি, একদিন স্বপ্নের দিন হবে, হবেই! যেদিন নারীরা সমান সুযোগ এবং অধিকার পাবেন, যেদিন সমগ্র মানবজাতি একত্রে স্বীকার করতে বাধ্য হবে_ “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।।”
সেই সুদিনের অপেক্ষায় আজও আন্তর্জাতিক নারী দিবস শুধুই একটা দিবস নয়, একটা প্রতিবাদ, একটা আন্দোলন হিসেবে দেখে সমগ্র নারী জাতি। এবারের নারী দিবসে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য বিষয়_ “Choose To Challenge”. চ্যালেঞ্জ নেওয়া মানে নতুন কিছু করে দেখানো,চ্যালেঞ্জ মানে একটা নতুন স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা। একজন মানুষের এক একটা চ্যালেঞ্জ নিজেকে ক্রমশ বদলে দিতে পারে। তেমনি সমগ্র একটা জাতির চ্যালেঞ্জ সমগ্র বিশ্বকেই বদলে দিতে পারে।
এবার নারীজাতির সময় এসেছে, নিজেকে বদলানোর, বিশ্বকে বদলানোর। সময় এসেছে নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সফল হোক।