নারীর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, কাজের স্বীকৃতি জানাতে ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চ “আন্তর্জাতিক নারী দিবস” আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। এ দিনে (৮ মার্চ) নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সহ সার্বিক সমস্যা ও সাফল্যের কথা উঠে আসে। নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও প্রতিবছর পালিত হয় নারী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে সুন্দর সমতার বিশ্ব’।
প্রতিপাদ্যে গুরুত্ব পেয়েছে, মহামারী করোনাকালে জীবন বাজি রেখে ডাক্তারি, প্রশাসনিক সহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশায় নিজেদের অবদান রেখেছে শতশত নারী। প্রাণঘাতী করোনার থাবায় পরিবারের কর্তাদের চাকরি হারিয়ে বা ব্যবসা বন্ধ হয়ে উপার্জন বাধাগ্রস্ত হলে দেশি পণ্যের ই-কমার্সের কল্যাণে পরিবারের হাল ধরেছে ঘরের নারীরা। তাদের উপার্জন সংসারে ভরণ পোষণ ও শান্তি বজায় রাখতে ভূমিকা রেখেছে। শান্তিপূর্ণ পরিবার বা সমাজ গড়তে নারীও অবদান রাখতে পারে, তেমনটাই দেখেছি করোনাকালীন সময়ে।
২০১৮ সালে পার্লারের কাজ শিখেন সুমি আজম। পার্লারের আয়ে মোটামুটি ভালই চলছিল তার পরিবার। দেশে করোনার মহামারী শুরু হলে আয় বন্ধ হয়ে বিপাকে পরে সুমি ও তার পরিবার। হতাশা আর দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন সুমি। কিছুদিন পর ফেসবুকে স্ক্রল করে দেখা মিলে উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপের। অন্যদের পোস্ট কমেন্ট দেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের রান্নার গুণ কাজে লাগায় সুমি। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শুরু করেন নিজের হাতে রান্না খাবার বিক্রি। পুনরায় আয় শুরু হয়ে ঘুরে দাড়ায় সুমির পরিবার। অনলাইনে হোম মেইড খাবার বিক্রি এখন সুমির নতুন পেশা ও পরিচয়।
নারীর একটা সময় একজন মা, মেয়ে, বোন বা স্ত্রীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার প্রথা থাকলেও বর্তমানে চাকরি, ব্যবসা, প্রশাসন, ই-কমার্স, স্টার্টআপ সহ বিভিন্ন খাতে নারীর অবদান প্রশংসনীয়।
বিভিন্ন খাতে অবদান রাখায় এবারের নারী দিবসে পাঁচজন নারীকে “জয়িতা” সম্মাননা দিচ্ছে সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারা হলেন- টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিজান, বরিশালের হাছিনা বেগম নীলা, পটুয়াখালীর মোসাম্মৎ হেলেন্নছা বেগম, বগুড়ার মিফতাহুল জান্নাত, এবং নড়াইলের অঞ্জনা বালা বিশ্বাস।
দেশি পণ্যের ই-কমার্সে এগিয়ে চলা কয়েকজন নারীর সাথে কথা হয় টেকজুমের। তাদের তিন জনের কথার তুলে ধরা হয়েছে-
কাকলী’স অ্যাটায়ারের স্বত্বাধিকারী কাকলী তালুকদার নারী দিবসে টেকজুম কে বলেন, আমি যদি কিছু তথ্য দিয়ে শুরু করি তাহলে বুঝা যাবে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আমরা কতটা এগিয়ে। বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদন ২০০৬ সালে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর অগ্রগতি ছিল ৬২.৭ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ৭২.১ শতাংশ উন্নীত হয়েছে। ২০০৬ সালে ১১৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম। ২০১৮ সালে ১৪৯ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৮ অবস্থানে এসেছে।
বর্তমানে জেন্ডার গ্যাপ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। যদি এই সূচক গুলো ধরে বলি তাহলে কিন্তু নারী ক্ষমতায়নের জন্য সবদিক থেকেই তাদেরকে সাহায্য করা হচ্ছে। ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে একজন নারী উদ্যোক্তার জন্য সহজে এবং সল্প সুদে লোন নেয়ার ব্যবস্থা আছে। বিভিন্ন ব্যাংক গুলো এই সুবিধা দিয়ে আসছে এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আরও নানাবিধ সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে যেন তারা নিজের উদ্যোক্তা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
পরিধান শৈলীর স্বত্বাধিকারী রাকিমুন বিনতে মারুফ জয়া নারী দিবসে টেকজুম কে বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে নিরাপত্তা, উপযুক্ত কাজের অভাব, পুঁজির স্বল্পতা, ঘরের বাইরে গিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার মতো প্রতিবন্ধকতা গুলো দূর করার সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম হলো ই-কমার্স। ই-কমার্সের মাধ্যমে নারীরা ঘরে বসেই স্বল্প পুঁজিতে নিজের সুবিধাজনক সময়ে নিজের বিজনেস পরিচালনা করতে পারে। নারীদের জন্য সবদিক থেকে ই-কমার্স সুবিধাজনক। নারীর ক্ষমতায়নে ই-কমার্সের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। ই-কমার্সের সাথে নারীরা যুক্ত হলে তাদের নেতৃত্ব নিশ্চিত হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন করতে পারবে।
আরিয়াস কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নিগার ফাতেমা নারী দিবসে টেকজুম কে বলেন, আমি একজন ই কমার্স ইন্ডাস্ট্রির দেশীয় পণ্যের নারী উদ্যোক্তা। আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের প্রতিটি নারী ঘরে ও ঘরের বাহিরে অসাধারন ভূমিকা পালন করে। নারীরা পরিশ্রমী ও শক্ত মনোবল নিয়ে কাজ করতে পারে কিন্তু শত গুণ থাকার পরেও নারীরা পিছিয়ে আছে সামাজিক বৈষম্যের জন্যে। ডিজিটাল বাংলাদেশে নারীদের সকল রকমের সুবিধা নিশ্চিত করছেন। নারীদের সচেতন হতে হবে। ই কর্মাসের মাধ্যমে নারীরা ঘরে বসেও কাজ করতে পারে, নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে।
শুধু তাই নয় ই লার্নিং প্লেটফর্মের মাধ্যমে ঘরে বসে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আজকাল নারীদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা আছে, সেই সব ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হবে। সর্বোপরি আমি সন্তান ও সংসার সামলিয়ে ই কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি দেশীয় পন্য নিয়ে, দেশের অর্থনীতিতে আমি ভূমিকা পালন করতে পারছি। আমি চাই বাংলাদেশের লাখো নারী সামনের দিকে এগিয়ে আসুক দেশ ও নিজর জীবনকে সুন্দর করুক।
ঘরে বাহিরে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন বাধার সম্মুখিন হতে হয় নারীদের। ঘরে বসে নারীর উপার্জন নিশ্চিত ও নির্যাতন বন্ধ করতে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ই-ক্যাব এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ টেকজুম কে বলেন, দেশী পণ্যের ই-কমার্স নিয়ে ফেসবুকে উদ্যোগ নিলে তেমন মূলধনের দরকার হয় না। যা দরকার তা হল, টেকনিক্যাল নলেজ আর বিজনেসের বেসিক সম্পর্কে জানা। এ দুইটা বিষয়ে শিক্ষিত নারীরা সচেতন হলে উপার্জন নিশ্চিত হবে ও নির্যাতন কমে আসবে।