২০১০ থেকে বাংলাদেশে অনলাইন কেনাকাটা বা সেবা গ্রহনের ধারা শুরু হলেও তা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে ই-কমার্সের একমাত্র এ্যাসোসিয়েশন ই-ক্যাবের মধ্য দিয়ে। দেশের গ্রাহকদের বড় একটা অংশ অভ্যস্ত হতে শুরু করেন ই-কমার্সে ফলে এ খাতে অনেক উদ্দ্যোক্তা তৈরি হন যার বড় একটা অংশ নারী। নিজ ঘর থেকে পন্য ই-কমার্সের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রির সুযোগ নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। ফলে নিজ কর্মসংস্থান তো বটেই পাশাপাশি অন্যদের জন্যেও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছেন এই নারীরা। কিন্তু এই নারীদের সিংভাগই বিবাহিত যার কারনে সংসার ও সন্তানদের বড় দায়িত্ব তাদেরই পালন করতে হয়। নিজের সংসার সামলে এসকল নারীরা আবার নিজ উদ্দ্যোগের মাধ্যমে দেশের অর্থনিতীতে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করছেন। কিভাবে তারা এমন গুরুত্বপুর্ন দুইটি বড় দায়িত্ব একই সাথে পালন করেন তার কিছুটা জানার জন্যে, কথা বলেছি দেশি পন্যের ইন্ডাস্ট্রির কিছু পরিচিত ও সফল উদ্দ্যোক্তাদের সাথে। আমাদের সাথে কথা বলেছেন তিনি কাকলী তালুকদার। উনার উদ্দ্যোগের নাম কাকলী’স এটায়্যার যেখানে মুলত জামদানী পন্য বিক্রি করা হয়ে থাকে।
সংসার সামলিয়ে আবার নিজ উদ্দ্যোগের জন্য কাজ,এই দুটো ব্যাল্যান্স করেন কিভাবে জানতে চাইলে কাকলী তালুকদার বলেন, কথায় আছে “যে রাধে সে চুল বাধে” ঠিক এই প্রবাদ বাক্যের মতোই আমাদের নারীদের জীবন। এখনও আমাদের সমাজে অনেকে আছেন যারা নারীদের কাজ করা পছন্দ করেন না এবং পরিবার থেকেও অনেক বাঁধা দেয়া হয়। বিয়ের পর একজন নারীর জন্য তার সংসার হবে সবকিছু এই কথা শুনেই আমাদের চলতে হয়। তবে যুগের পরিবর্তন এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আজ নারীদের নারীদের পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের সাথে নারীর নিজস্ব কাজ করার মানসিক পরিবর্তন আনা জরুরি। আমি পরিবারের সাপোর্টে আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছি এবং আমার স্বামীর সাপোর্ট আমাকে দুইদিকে ব্যালেন্স করে কাজ করতে সাহায্য করে। পরিবার এবং সংসার ব্যালেন্স করা আমাদের নিজের কাজের উপর নির্ভর করে কিভাবে আমরা তা করছি। যদি নিয়মিত থেকে কাজে সময় দেয়া হয় তাহলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। অনিয়মিত হলেই দুইদিকে ব্যালেন্স করা কঠিন হয়ে পরবে।
পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে এ ব্যাপারে সহযোগীতা পান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাবা-মার উৎসাহ এবং স্বামীর সাপোর্ট সব সময় আমার উদ্যোক্তা জীবনে পেয়েছি। এছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যরা যথেষ্ট সাহায্য করেন। তাদের সবার সাপোর্ট আমার উদ্যোক্তা জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সব সময় প্রমানিত।
প্রায় ২ বছর ধরে নিজ উদ্দ্যোগ আরিয়াস কালেশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন স্বতিধিকারি নিগার ফাতেমা। উনার মতে ব্যাপারটা পরিশ্রমের যদিও তবে অসম্ভব কিছু নয়।
সাংসারিক দায়িত্বের কারনে কখনো উদ্দ্যোগের কাজে সমস্যা হলে কিভাবে কাটিয়ে উঠেন জানতে চাইলে নিগার ফাতেমা বলেন, একজন নারীর কাজের চ্যালেঞ্জ এখানেই।আমার মনে হয় জীবনের কোনো কিছুই সহজ নয় তাই যেকোনো সমস্যার সময় ধৈর্য এবং শৃঙ্খলার সাথে কাজ করলে সব কিছু গুছানো যায়।
উদ্দ্যোগের কাজে সময় দিতে গিয়ে সাংসারিক কোন দুরুত্ব সৃষ্টি হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখুন পরিপুর্ন সমানভাবে মাল্টিটাস্কিং বৈজ্ঞানিক ভাবেই সম্ভব না একজন মানুষের পক্ষে,তবে তার জন্য কোন দুরুত্ব তৈরি হয় না আসলে। হ্যা কিছু সাময়িক সমস্যা হয় কখনো কখনো তবে সেটা একজন উদ্দ্যোক্তা হিসেবে না যত,তার চেয়ে বেশি একজন নারী হিসেবেই সামলে নেই গুছিয়ে নেই। আর এ ক্ষেত্রে পারিবারিক সহযোগিতাই মুল শক্তি আমাদের জন্য।
বাহারি ধরনের দেশি শাড়ি থ্রিপিস নিয়ে চার বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন মনিকা আহমেদ। তার উদ্যোগের সবথেকে বড় সাপোর্টার তার স্বামি। এ বিষয়ে মনিকা আহমেদ বলেন, একজন নারীর ক্ষেত্রে সংসার এবং উদ্যেগ কখনই সাংঘর্ষিক হতে পারে না।আমি মনে করি কেউ যদি খুব বেশি ভালোলাগা ও ভালোবাসা থেকে উদ্যেগের কাজগুলো করে তাহলে সংসারের সাথে সাথে উদ্যেগের কাজে কখনও সংঘর্ষ হবে না।সংসার সংসারের জায়গায় এবং উদ্যেগ উদ্যেগের জায়গায়।সংসারের কাজগুলো সময়মতো সম্পাদন করতে পারলে উদ্যেগের কাজে তা কখনও নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে না।
নিজ উদ্দ্যোগ বা নিজ সংসার কোনটা বেশি প্রাধান্য? এমন প্রশ্ন আসার কি কোন যৌক্তিতা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আমার সংসারকে যেমন প্রাধান্য দেই আমার উদ্যেগকেও ঠিক তেমনি প্রাধান্য দেই।হ্যা কখনো কখনো কাজের প্রয়োজনিয়তা হিসেবে কোনটা আগে বা পরে করতে হয়,তবে সেটাকে দিয়ে প্রধান্য বিচার করা যাবে না।এটা আসলে যে যার যার অবস্থা বুঝেই করে।এমন প্রশ্নের আসলে কোন যৌক্তিকতা নেই স্বাভাবিক ভাবেই আমরা আমাদের নারীদের এভাবেই সহযোগিতা করবো,তবে স্বাভাবিক বাস্তবতায় তা সবখানে পালন হয়না। আর সহজ সহযোগিতা গুলো না পেয়ে বা এই অপরিসীম কস্টের জন্য অনেকেই হয়তো হতাশ হয়ে পড়েন ও থেমে যান।
যেসব নারীরা উদ্দ্যোগ ও সংসার জীবন মেইনটেইন করতে হতাশ হচ্ছেন তাদের উদ্দ্যেশে কিছু বলুন।
কাকলী তালুকদার – কোন কিছুতেই কখনও হতাশ হওয়া যাবেনা। হতাশা জীবনকে শেষ করে দেয়। একজন নারী যে উদ্যোগ গ্রহণ করুক না কেন তাকে সেই উদ্যোগ নিয়ে ভালোভাবে জানতে হবে এবং লেগে থাকতে হবে। মাঝপথে কাজ ছেড়ে দেয়া যাবেনা। যেহেতু প্রায় অনেক নারী অনলাইন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন তাই প্রতিদিন তাকে চ্যালেঞ্জের সাথে নিজ উদ্যোগ চালিয়ে যেতে হয়। তাই হতাশ না হয়ে নিজেকে দক্ষ করার পেছনে সময় দিতে হবে। নারীর ধৈর্য নারীকে অসাধারণ করে তুলেছে সবার মাঝে তাই ধৈর্য ধরে কাজ করে যেতে হবে তবেই সফলতা আসতে বাধ্য।
মনিকা আহমেদ- যেসব নারীরা উদ্যেগ এবং সংসাররে কাজ দুটো একসাথে করতে গিয়ে হতাশ হচ্ছেন তাদেরকে আমি একটা কথাই বলবো, বিরক্ত নিয়ে কোন কাজ করা যাবে না।যে কোন কাজ ভালোলাগা ও ভালোবাসা নিয়ে করলে সেই কাজে কখনও বিরক্ত আসে না।নিজেকে মোটিভেট করতে হবে প্রতিনিয়ত তাহলে হতাশ আসবে না কোনভাবেই।
নিগার ফাতেমা- যারা হতাশ তাদের জন্য পরামর্শ, জীবনে নিজের জন্য আসলেই কিছু করতে চাইলে ধৈর্যশীল হয় এগিয়ে যেতে হবে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে অনেক বাধা বিপত্তি আসবে কিন্তু প্রতিবারই লক্ষ্য রাখতে হবে গন্তব্যে পৌঁছাবার।খারাপ সময় আসে আবার চলেও যায় কিন্তু ধৈর্য এবং মন স্হির এগিয়ে যেতে হবে।
সর্বোপরি সকল সমস্যাকে সম্ভাবনাতে রুপান্তরিত করে এক একটা দিন নিজ কাজ দিয়ে দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের নারীরা। আমাদের পারিবারিক জীবন বা সামাজিক জীবন সবাখনেই তাদের সমান অংশগ্রহণ আমাদেরকেই সমৃদ্ধ করবে। নারী দিবসের এই দিনে আমাদের সকল নারীদের সম্মান জানাই,যারা আমাদের পুরুষদের জীবনের সবটা জুড়ে থাকে মা,বোন,স্ত্রী বা মেয়ে হয়ে।