সেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের কথা, নারী শ্রমিকদের পুরুষ শ্রমিকের চাইতে মজুরি, কর্মঘন্টা সহ নানান বিষয়ে কম সুবিধা দেওয়া হতো। মেয়েরা দেখলো যে তাদের কাজ করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নেই এবং এরমধ্যে কষ্ট করে কাজ করেও মজুরি কম পাচ্ছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। শুধুমাত্র নারী বলে তাদের কাজের মূল্যয়ন কম করা হবে তা মেনে না নিয়ে নিউইয়র্ক এর একদল নারী শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে নিউইয়র্ক এর রাস্তাঘাট। যদিও সরকার এর লাঠিচার্জ এর মুখে তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি তবে তার ই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন কার্যক্রম এর মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ই মার্চ “আন্তর্জাতিক কার্মজীবী নারী দিবস” হিসেবে ঘোষনা করা হয় এবং জাতিসংঘ সকল দেশের প্রতি এ দিবস পালোনের আহবান জানায়। এই মিছিল কে দিবস এ রুপান্তর এর ক্ষেত্রে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন এর অবদান অনস্বীকার্য।
যদিও শুরুতে একে “আন্তর্জাতিক কার্মজীবী নারী দিবস” হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং এর মূল উদ্দেশ্যও ছিলো নারী-পুরুষের শ্রমের সমান মূল্যায়ন করা। তবে তা যখন থেকে নারীর সামগ্রিক সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে উজ্জাপন তার নাম খানিকটা পরিবর্তন করে করা হয়েছে “আন্তর্জাতিক নারী দিবস”।
বর্তমানে বিভিন্ন রাস্ট্র নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, নারীর কাজের সঠিক মর্যাদা প্রদান সহ বিভিন্ন প্রতিপাদ্য কে সামনে রেখে প্রতিবছর ৮ই মার্চ নারীদের জন্য উজ্জাপন করে থাকে। দৃষ্টত সকলের উদ্দেশ্যেই এই দিবস। পুরুষ এবং নারী মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। তাইতো নজরুল বহুবছর আগেই বলে গেছেন, “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
নারী দিবস তখনই সফল হবে যখন পুরুষ মন থেকে প্রতিটি নারীর প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারবে এবং ঘরে বাইরে নারীকে তাদের প্রাপ্যটুকু দিতে প্রস্তুত থাকবে। অপরদিকে নারীদের ও একই ভাবে পুরুষের প্রতি সম্মান রেখেই চলতে হবে। নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতিযোগি নয় বরং সহোযোগি। বর্তমান অবস্থা অতীতের তুলনায় অনেকটাই ভালো তবে পর্যাপ্ত নয়। তবে আশার বিষয় এই যে, নারীরাও আগের চাইতে বেশী কর্মমূখী হচ্ছে। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। যেখানে পৃথিবীর জনসংখ্যার ৪৯.৬ ভাগ নারী সেখানে নারীর উন্নয়ন ছাড়া সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব।
নারী দিবসে চারজন নারী উদ্যোক্তার অভিব্যাক্তি তুলে ধরছি-
রওনক জাহানের উদ্যোগের নাম “Assufa”। চাকুরী ছেড়ে কয়েকজন বন্ধুর সাথে একত্রে এই উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। দেশীয় শাড়িতে নিজস্ব ডিজাইনে ব্লক, এমব্রয়ডারি দিয়ে সেটিকে ভিন্ন আংগিক এ উপস্থাপন করা টাই তাদের পেইজ এর মূল উদ্দেশ্য। সাথে দেশীয় কুর্তি এবং সালোয়ার কামিজ ও যোগ হবে তাদের কালেকশনে। এ নিয়ে তাদের বেশ কিছু পরিকল্পনাও রয়েছে। একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পথ চলতে গিয়ে রওনক জাহান পরিবার পরিজনদের থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছেন বলে দ্রুত এগিয়ে যেতে পেরেছেন। নারী দিবস সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “নারী মানে আমার কাছে এক ই সাথে সাহস, নির্ভীক আবার কোমল, শান্তিময় রূপ। একটা নারী তার অবস্থান অনুযায়ী চাকরি, সংসার, ও ভিন্ন ভিন্ন কাজে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়ে আমাদের চারপাশে অবদান রেখে যাচ্ছে। তাই নারী দিবস আমার কাছে সেই সব নারীর অবদান সেলিব্রেট করার একটি দিন।”
মৌরী মনিকা কস্তার উদ্যোগের নাম “পুতুলা”। দেশীয় পোশাক, গয়না ও ঘর সাজানোর পণ্যের উপর হ্যান্ডপেইন্ট করাই মূলত তার কাজ উদ্যোক্তা-আত্মকর্মসংস্থান এই শব্দগুলোর প্রতি ভালোলাগা ও আগ্রহ থেকেই তার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা। নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তেমন কোনো বাধার মুখে তিনি এখনো পরেন নি। নারী দিবসে তিনি সকল নারীর নিষ্টন্টক পথচলার প্রত্যাশা করে বলেন, “নারী দিবস আমার কাছে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি দিন। আমি চাই নারীদেরকে নারী হিসেবে আলাদা না করে বরং মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হোক। পরিবারে, সমাজের ও দেশের একজন অংশীদার হিসেবেই বিবেচনা করা হোক তাহলেই নারী তার অধিকার ও সম্মান নিয়ে বীরদর্পে নিজের গুণাবলী বিকাশ করতে পারবে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে পারবে।”
সকল ধরনের কেক এবং বেকারি আইটেম নিয়ে অনলাইন বেইজড কাজ করছেন তানজিমা কাউসারী। তার উদ্যোগ এর নাম “CakeShop By Titly”/”কেকশপ বাই তিতলী”। বিশ্ববিদ্যালয়ের হন্ডি পেরিয়ে বিসিএস পরিক্ষার প্রস্তুতি নিতে নিতেও আর সেদিকে যাওয়া হয়নি তার। বেকিং এর প্রতি ভালোবাসা থেকেই এইদিকে ক্যারিয়ার গড়েন তিনি। নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যে সকল বাধার সম্মুখীন তিনি হচ্ছেন তা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন নিরাপত্তার অভাবে কাঁচামালের জন্য একা অনেক যায়গায় যেতে না পারা এবং খাবার ডেলিভারি চ্যালেঞ্জ এর কথা। নারী দিবসে সকল নারীর প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশ এবং সমাজের প্রতি শুধু ৮ মার্চ নারী দিবসেই নয় বরং ৩৬৫ দিনই নারীর জন্য নিরাপদ কর্মস্হল,তাকে শ্রদ্ধা,সম্মান এবং তার কাজকে সমর্থন দেওয়া হোক এটাই আমার প্রত্যাশা। পৃথিবীর সকল নারীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।”
সুবর্ণলতা নামের উদ্যোগ নিয়ে পথচলা সুবর্ণা রানী দাস এর। তিনি কাজ করছেন দুধের প্যাড়া সন্দেশ, নারিকেলের নাড়ু এবং মুরালি বা গজা নিয়ে। ছোট থেকেই বাবা ভাই কে নিজেদের দোকানে কাজ করতে দেখে তিনিও আগ্রহী হন নিজে কিছু করার। তিনি মূলত বেশি বাধা পেয়েছন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে। বিভিন্ন সমযয়ের কটাক্ষ করে বলা কথা উপেক্ষা করে তিনি কাজ করে গেছেন, এগিয়ে গেছেন প্রতিনিয়ত। নারী দিবসে নারীদের সম্মনের সাথে এবং সফলতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ” নারীকে যদি ঘর এবং ঘরের বাহিরে সাহায্য করা হয় তাহলে নারীরা অনেকে এগিয়ে যাবে এবং সেটা দেশ এবং পরিবার দুটির জন্যই অনেক সাফল্য বয়ে নিয়ে আসবে। একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আমি সবসময় এমন একটা সমাজের ই স্বপ্ন দেখি।”
নারী দিবস শুধু ৮ই মার্চ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এর উদ্দেশ্য সকলের মাঝে ইতিবাচকভাবে ছড়িয়ে পড়ুক, সুখী সমৃদ্ধ হোক আগামী দিনগুলো।