“নরসমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে,প্রাণকে শোষন করে।” কবি গুরুর কথার জের ধরেই বলতে হয় একজন নারী হলেন মা,মেয়ে,স্ত্রী। প্রতিটি রূপেই তারা সহজ ও সাবলীল।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ এর জন্য নিউইয়র্কের রাস্তা থেকে শুরু হওয়া প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকেই সারাবিশ্বে এই দিনটিতে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
একজন নারীকে পরিবর্তন শুরু করতে হবে নিজের দিক থেকেই। তিনি যখন নিজেই নিজেকে সম্মান, ভরসা এবং বিশ্বাস করবেন তখন তার চারপাশের মানুষও তার উপর আস্থা ও সম্মান করবে। তারা নিজেরাই নিজেদের সফলতার পথে বাঁধা, নিজেদের দুর্বল মনে করেন পুরুষের কাছে।এর ফলে তারা নিজেদের যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, জ্ঞানার্জন,চাওয়া পাওয়া সকল কিছু থেকে পিছিয়ে পরেন।নিজেদের স্বাধীনতা তুলে দেন অন্যের হাতে,মনে করেন এটাই যেন এক অলিখিত নিয়ম।ফলে সমাজ এবং পরিবারে তারা অবহেলিত এবং নির্যাতিত। কিন্তু এখন সময় এসেছে এই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার।
করোনা পরিস্থিতিতে আমরা দেখেছি অনেক পরিবারের স্বামীর চাকরি হারিয়েছেন,বাবা গৃহহীন হয়ে পরেছেন তখন কিন্তু একজন নারী সংসারের হাল ধরেছেন, এর পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এফ-কমার্স এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসা করে নিজেদের স্বাবলম্বী করছেন।এই সময়ে কেউ হাতে তৈরী পোশাক,গয়না, খাবার সহ নানা ধরনের দেশীয় পণ্য বিক্রি করে নিজেরা এগিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের উদ্যোগকে। হয়েছেন অনেকেই সফল। তেমনই একজন হলেন কাকলি’স এ্যাটেয়ারের স্বতাধিকারী কাকলি তালুকদার। তিনি কাজ করছেন আমাদের দেশের ঐতিহ্য জামদানী নিয়ে। তিনি বলেন- “আমাদের দেশের নারী উদ্যোক্তাদের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে সম্ভাবনা ব্যাপক । কারন তারা এই সেক্টরে ঘরে বসে নিজেদের প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারছে এবং সেই সাথে পরিবারকেও আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে পারছেন। নারীদের অনলাইনের মাধ্যমে বিজনেস করার এই উদ্যোগ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভুমিকা ফেলবে। এবং এতে করে মাথাপিছু আয় আরও বৃদ্ধি পাবে।
একজন নারী উদ্যোক্তা সে অনলাইন হোক বা অফলাইন তাকে অবশ্যই টেকনলোজিতে দক্ষ হতে হবে। কারন যত দিন যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি সংযুক্ত হচ্ছে এবং সামনে তা আরও চ্যালেঞ্জিং হবে। সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার জন্য প্রতি মূহুর্তে একজন উদ্যোক্তাকে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার শিখতে হবে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পদ্ধতি ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সংযুক্ত হচ্ছে তাই একজন উদ্যোক্তাকে সব সময় আপডেট থাকতে হবে প্রযুক্তি সম্পর্কে নয়তো নিজের হাতে গড়া কষ্টের উদ্যোগটি ডিজিটাল জ্ঞানের অভাবে মার্কেট থেকে হারিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আমি যদি উদাহরণ দেই তাহলে বলতে হয় ডোমেইনের কথা । শুধুমাত্র এই বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারনে কয়েক বছর ধরে গড়া একটি ব্যবসার নাম অন্য কেউ নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের অনেকেরি জানা নেই । যদি এসব বিষয় জানতে হয় তাহলে একজন উদ্যোক্তার ডিজিটাল স্কিল থাকা আব্যশক।
এখানে আমি আরো উল্লেখ করতে চাই যে,নারী উদ্যোক্তারা ফেসবুকে খুব ভাল করছে এবং বিশেষ করে নারীদের পোশাক, গহনা, খাবার এসব দিকে অনেকে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তাছাড়া ঐতিহ্যবাহি পণ্য, কুটির শিল্পে তৈরি পণ্য এসবকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতেও তাদের ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে।”
আরেকজন সফল উদ্যোক্তা নিগার ফাতেমা।যিনি কাজ করছেন টাঙ্গাইলের খেশ শাড়ি নিয়ে।তার উদ্যোগ আরিয়া’স কালেকশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দুর্বার গতিতে। তিনি মনে করেন- “ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি তে নারী উদ্যোক্তার সম্ভাবনা অসীম। বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষিত এবং দক্ষতা থাকার সত্বেও পারিবারিক ও সামাজিক কারনে পিছিয়ে থাকেন কিন্তু তারপরেও ই-কমার্সের মাধ্যমে অল্প পুজিতে শুরু করতে পারেন তাদের স্বপ্নযাত্রা। অফিস বা দোকান ছাড়াই ঘরে বসে শুরু করতে পারে তার উদ্যোগ এর কাজ। নিজের দেশের পণ্য নিয়ে কাজ করলে খুব সহজে সোর্সিং করা যায়। শুধু তাই নয় বর্তমানে নারীদের জন্য সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো এগিয়ে আসছে।
নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।একজন ই কমার্স নারী উদ্যোক্তার টেকনিক্যাল এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান থাকা খুব প্রয়োজন।
একজন নারীর উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকা অনেক। পরিবারের উৎসাহ একজন নারী অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে।পরিবারের থেকে সর্বত্র সহযোগিতা পেলে একজন নারী পরিবারের গৌরব নিয়ে আসতে পারে।”
নারীরা শুধু ব্যবসাতেই সফল নন তারা হলেন দশভুজা,অনন্যা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মাহমুদা আফরোজ লাকি,তিনি সবসময়ই চেয়েছিলেন নিজেকে সেরা প্রমান করতে, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে। সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছরের ট্রেনিংয়ে নারী পুরুষ মিলিয়ে সব ব্যাচমেটদের মধ্যে প্রথম হন৷ কর্মক্ষেত্রেও পুরুষদের সাথে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি টেকজুমকে বলেন- “আন্তর্জাতিক নারী দিবসে টেকজুম নিউজের সকল পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীকে জানাই প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ৷ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ই- কমার্স উদ্যোক্তাদের ভূমিকা ব্যাপক ৷ আর নারী ই- কমার্স উদ্যোক্তারা অত্যন্ত ইতিবাচক একটি ই- বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তারা আসলে নীরবে কাজ করে চলেছে কিন্তু বিশাল প্রভাব ফেলছে দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে ৷ বিশ্বে কোভিড অতিমারিতে যখন অনেক বড় বড় ব্যাবসায়ী বা ব্র্যান্ড পড়ে গেছে তখন কিন্তু নিজ পরিবারকে বাচিয়ে রেখেছে এই ই- কমার্স নারী উদ্যোক্তারা৷ শুধু নিজ পরিবার নয় এভাবে তারা জীবিত এবং সচল রেখেছে দেশের বাজার কেও৷
অনেক নারীকে পরিবার ও সন্তানের জন্য নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বা ক্যারিয়ার ত্যাগ করতে হয় ৷ কিন্তু ই-কর্মাসের বদৌলতে আজ তারা ভাল আয় করতে পারছে, পরিবারের মধ্যে থেকেই, সন্তান সন্ততিকে সময় দিয়েই ৷ তৈরি করতে পারছে নিজের একটা পরিচয় ৷
তবে হ্যা, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অসাধু বা নীতিহীন কাজকর্মের জন্য আমাদের আলাইন ক্রেতাদের মধ্যে একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। যেহেতু প্রোডাক্ট সবই ভার্চুয়াল বাজারে দেখা হয় তাই ক্রেতাদের একমানের প্রোডাক্ট দেখিয়ে নিম্নমানের প্রোডাক্ট দিয়ে উচ্চ মুনাফা লাভ করতে ব্যস্ত এসব ব্যবসায়ী ৷ তাই ভাল মানের প্রোডাক্ট দিতে গিয়ে মূল্য বেশি বলেও অনেক ভাল ব্যবসায়ী অনেক সময় প্রশ্নের সম্মুখীন হন ৷ ক্রেতার আস্থা অর্জন করতে তাকে অনেক বেশি শ্রম ও সময় দিতে হয়। এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা, ব্যবসার ক্ষেত্রে চালান আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি। ঋণ পাওয়ার সহজ প্রক্রিয়া ও সহজলভ্যতা এবং ই- কমার্স আইনের সঠিক প্রয়োগ দ্বারা এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মেধা, মনন আর সততা নিয়ে লেগে থাকতে হবে, ক্রেতাদের মনে আস্থা গড়ে তুলতে হবে।তবেই একসময় ব্যবসায় সুফল লাভ করা যাবে।”
ই-কমার্সে আজকে নারীদের যে জয়যাত্রা তার বীজ বপন হয়েছিল ই কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ ( ই-ক্যাব) এর প্রতিষ্ঠা এবং সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ এর হাতেই। নারীদের জন্য তিনি নিঃস্বার্থ ভাবে এগিয়ে আসার কারনেই আজকে নারীরা উৎসাহ, সাহস এবং আত্নবিশ্বাসের সাথে কাজ করতে পারছেন। আজকের এই বিশেষ দিনে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
নিজেদের সেরা প্রমান করতে হলে নারীদের প্রথমেই প্রয়োজন দক্ষতা বৃদ্ধি করা, যেকোন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার মানষিকতা তৈরী করা, কোন কাজে নিয়মিত থাকা,আইটি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা।
আজকের নারী দিবসে চাওয়া শুধু একটি দিন নয় বরং বছরের প্রতিটি দিন হোক নারীদের জন্য নিরাপদ, সম্মানের এবং শ্রদ্ধার।