কুমিল্লার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে খাদি কাপড়। ঐতিহ্যের খাদি এখন ফ্যাশনে সময়ের চাহিদা মেটাচ্ছে। এশিয়ার বাইরে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে খাদি কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। সেসব দেশে খাদি কাপড়ের তৈরি পোশাক-পরিচ্ছদ রপ্তানি করা হয়। এ সুনাম অর্জিত হয়েছে বহু বছর ধরে অনেক কারিগর আর ব্যবসায়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমে।
এক সময় সংগ্রামী মানুষ আর গরিবের পোশাক হিসেবে পরিচিত ছিল কুমিল্লার খাদি। সেই খাদি এখন ফ্যাশনে সময়ের চাহিদা মেটাচ্ছে। ঈদ-পূজা কিংবা বিভিন্ন উৎসবে খাদির কাপড় ক্রয়ে আগ্রহী হচ্ছেন ক্রেতারা। কুমিল্লায় খাদি কাপড়ের দোকানে এখন প্রতিদিনই ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকছে। দিন দিন বাড়ছে কুমিল্লার খাদির কদর।
বর্তমানে কুমিল্লার খাদি পোশাকের মধ্যে পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ, ওড়না, বিছানার চাদর, গায়ের চাদরসহ ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীতে নজরকাড়া ডিজাইন আনা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদির সবধরনের পোশাকে আধুনিকতা এলেও খদ্দরের সেই মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি এখনো আগের জৌলুস ধরে রেখেছে। খাদির পোশাক যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি পরতে আরামদায়ক।
কুমিল্লা মহানগরীর মনোহরপুর ও লাকসাম রোডে খাদিপণ্য বিক্রির পুরনো দোকানগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য নতুন দোকান গড়ে উঠেছে। অন্যান্য জেলার লোকজন কুমিল্লায় বেড়াতে এলে স্মারক হিসেবে নিয়ে যান কুমিল্লার খাদি। কুমিল্লার খাদিপণ্য বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর চেতনাকে লালন করছে শতবর্ষ ধরে।
খাদি ব্যবসায়ীদের সূত্র জানায়, শতবর্ষের ঐতিহ্যের খাদি আলোচনায় আসে ১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সারা ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সে সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য ডাক ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সেই মোটা কাপড় এখন মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। কুমিল্লার খাদি এখন শৈল্পিকতার পরশে দেশ-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। খাদির কাপড় যাচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এই সুনাম অর্জিত হয়েছে বহু বছর ধরে অনেক কারিগর আর ব্যবসায়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমে। খাদি কাপড়ের সঙ্গে এখন কয়েকটি দিক জড়িত রয়েছে। তা হচ্ছে তাঁতি, সুতা কাটুনি, ব্লক কাটার ও রঙের কারিগর। সবাই মিলে তৈরি করেন নান্দনিক খাদি কাপড়। বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় দেড় হাজার পরিবার এই পেশায় জড়িত। মহানগরে খাদি কাপড়ের দোকান রয়েছে দুই শতাধিক।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুমিল্লা শাখা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হলে খাদি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে খাদি শিল্পের এ বিপর্যয় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫২ সালে সমবায় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নূনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
কুমিল্লা মহানগরের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘অভয় আশ্রম’-এর কর্মীদের প্রচেষ্টায় কুমিল্লার আশ-পাশের গ্রামগুলোতে হাতে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। বিশেষ করে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া। দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, সাইতলা, বাখরাবাদ, বেলাশ্বর, ভানী, হারং, গুনঞ্জর। দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর। মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, ময়নামতি, জালালপুর, মইনপুর এলাকায় হস্তচালিত তাঁত শিল্পের প্রসার ঘটে। এই তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে বারেরা, রামচন্দ্রপুর, জাফরাবাজ, সাইকট, বাবিরচড়, কুটুম্বপুর, কলাগাঁও, সোনাপুর, সাইতলা, ভানী, ফুলতলী, দোবাইরা, গনিপুর প্রভৃতি গ্রামের মানুষ হাতে সুতা কাটার পেশায় জড়িয়ে পড়ে।
খাদি শিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন কুমিল্লা মহানগরের খাদি ঘরের তরুণী মোহন রাহা, খাদি কুটির শিল্পের শংকর সাহা, খাদি ভবনের দীনেশ দাশ, বিশু খদ্দরের মনমোহন দত্ত, রাম নারায়ণ স্টোরের কৃষ্ণ সাহা। তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা গ্রামের গ্রামীণ খদ্দর ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী রঞ্জিত দেবনাথ বলেন, বাপ-দাদার ঐতিহ্যের পেশা হিসেবে এখনো কাপড় বুনছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা ক্রেতা এইচ এম সিরাজ বলেন, খাদির পণ্য আরামদায়ক এবং দামও কম। কুমিল্লায় এলে খাদির জামা না কিনে ফিরি না। পরিবারের জন্যও খাদির কাপড় কিনে নিই।
কুমিল্লা মহানগরীর প্রবীণ খাদি কাপড়ের ব্যবসায়ী খাদিঘরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, একসময় খাদি কাপড় অনেক ভারী ছিল। এখন ওই কাপড় প্রতিনিয়ত মিহি করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম এখন খদ্দর নিয়ে ভাবছে, গবেষণা করছে। এদের হাত ধরেই খাদি কাপড় এবং এ কাপড়ের পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার নকশায় বৈচিত্র্য আসছে। প্রদীপ রাহা আরও বলেন, বর্তমানে সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খদ্দরের কাপড়ের চাহিদা থাকায় বর্তমানে খাদি শিল্পে অনেক নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে। কারণ ১৯২১ সালের প্রেক্ষাপট ও চাহিদা এক নয়। কুমিল্লা খাদি শিল্পের একটা শক্ত ভিত আছে। শতবর্ষের খাদিপণ্য তার গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে প্রতিযোগিতার বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে। খাদির পোশাক যেমন দৃষ্টিনন্দন, পরতে আরামদায়ক এবং দামে সাশ্রয়ী। পৃথিবীর যেখানে বাঙালি কমিউনিটি আছে সেখানে খাদি কাপড়ের প্রসার ঘটেছে। সূত্র: বাসস