ফেসবুকে তিনি ‘রিথিন’ নামেই বেশি পরিচিত। তার উদ্যোগের নাম ‘শারলা’। দেশি পণ্যকে তুলে ধরার প্রয়াস তার। তার পুরো নাম রাফিয়া ইসলাম রিথিন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড়। অনার্স করেছেন ফার্মেসী ডিপার্টমেন্ট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে। বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ এ মাস্টার্স করছেন। করোনাকালীনে ঘরে বসে সময়কে কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে? সেই ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। ভেবেছিলেন নিজ উদ্যোগে কিছু একটা করবেন। তিনি মনে করেন প্রত্যেক মেয়ের ই আর্থিক ভাবে সাবলম্বি হওয়ার মাধ্যমে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করা উচিত। সে থেকেই নিজের মুক্তির বার্তা দিতেই নাম দিলাম শারলা। লোগোর শুরটাও একটা নারীর আদলে করেছেন।
টেকজুমঃ আপনার উদ্যোগের শুরুর গল্প কি?
রিথিন: উদ্যোগের শুরুর আসলে গল্প নেই। এটা কে কি বলবো জানিনা তবে আমার দুইটা সমস্যা ছিলো। এক,আমি বাবার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা পেতাম। দুই, আমি নিজে কিছু করতে চাইতাম। আমার বরাবরের ইচ্ছা আমার সমস্ত বিলাসিতার বস্তু গুলো আমি বাবার নয় বরং নিজের টাকায় কিনবো। সেই ইচ্ছা থেকেই ২০১৭ সাল থেকে টুকটাক ক্রাফটিং, ক্রাফট এর টাকায় আবার ছোট একটা অনলাইন কাজের উদ্যোগ শুরু করলাম। তবে সেখানে আমার বেশ কিছু ভুল ছিলো। যেমন- পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং এর অভাব, যথাযথ প্ল্যানিং এর অভাব৷ এই জিনিসগুলো যখন অনুধাবন করলাম তখন একটাব্বড় গ্যাপ নেয়ার কথা ভাবি আমি কি চাই আর তা কিভাবে করবো এটা ভাবার জন্য। ২০২০ সালের পুরোটাই ভেবেছি, ডিএসবি তে শিখেছি, পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং টা স্ট্রং করেছি। আমি কি চাই, কেন চাই আর আসলেই চাই কিনা তা নিয়ে ভেবেছি টানা ৮মাস। এই ভাবতে ভাবতেই খেশ আর জামদানীর মায়ায় জড়িয়ে পরি। আস্তে আস্তে সোর্সিং আরম্ভ করি। আমি বরাবর ই কুর্তি তে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি।
ছোটবেলায় নিজে ডিজাইন দিয়ে জামা বানাতে পারতাম না এই আক্ষেপ আমার এখনো মনে চাপা কষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে। সেই কষ্টই এখন শারলার কুর্তি গুলো ডিজাইন করে লাঘব করি। মূলত খেশ আর জামদানী কে একসাথে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। সে অনুযায়ী বেশ কয়েকটা কুর্তি বানিয়েছি। এছাড়াও শুধু খেশ অথবা শুধু জামদানী কুর্তি ও বানিয়েছি বেশ কয়েকটা।
টেকজুমঃ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছিঃ
রিথিন: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কারিগর। ৪ মাসের উদ্যোক্তা জীবনে ১মাস আমার পুরো কাজই অফ রাখতে হয়েছিলো হঠাৎ করে কারিগরের কারনে। এরপরে আবার নতুন করে কারিগর খোঁজা, তার আকাশচুম্বী মজুরি তে বেশ ভালো রকমেই নাস্তানাবুদ হয়েছি ওই একমাস। এরপরের সমস্যা টা হলো আমাকে হেল্প করার কেউ নেই। কাপড় এর সোর্সিং,সেখান থেকে কাপড় আনানো থেকে শুরু করে টেইলরিং করতে দেয়া, তা বাসায় এনে, ফটোশেসন এর সব ব্যবস্থা করা, ছবি তোলা এবং নিজেই পোজ দেয়া সব একা হাতে সামলাই। হ্যা, শারলার প্রতিটি ছবির মডেল যেমন আমি, ছবিগুলো তোলাও আমার হাতেই। আমার ভরসা কেবল আমার ফোন এবং একটা ট্রাইপড।
এছাড়াও ছোটখাটো চ্যালেঞ্জ তো আছেই। যেমন- ইদানীং একটা কথা খুব শুনি। ফার্মেসী পড়ে কাপড় কেন? আমি তাদের উত্তর টা ঠিক এভাবে দেই যে আপনি যেটা কাপড় হিসেবে দেখছেন সেটা আমার স্বপ্ন, আমার আয়ের মাধ্যম। আমি ধরেই নিয়েছি উদ্যোক্তা মানেই আমার প্রতিটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষমতা থাকতেই হবে। এর বিকল্প নেই। তাই ম্যানেজ করে নেই কষ্ট হলেও।
টেকজুমঃ আপনার সফলতার পেছনে অনুপ্রেরণা কি?
রিথিন:সেই সকল নারী উদ্যোক্তারা যাদের কোনো বাঁধাই আটকে রাখতে পারেনি। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে যাচ্ছেন। আর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা। যিনি উদ্যোক্তা নন। তবে তার প্রতিটা লড়াই কাছ থেকে দেখে যুদ্ধ করাটা রপ্ত করে নিয়েছি। ডিএসবি এবং রাজিব আহমেদ স্যার ছাড়া আমি নিজেকে তৈরি করতে পারতাম না ।
টেকজুমঃ ‘শারলা’কে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেন?
রিথিন:স্বপ্ন শারলা একদিন অনেক বড় হবে। লাখ লাখ টাকার আগে আমি চাই শারলা কে লাখ লাখ মানুষ চিনবে,ভরসা করুক, ভালোবাসুক। আমার বাবা মা কে আমি এখনো জানাইনি। নিজের কাছে প্রমিস করেছি যেদিন আমার মনে হবে এবার আমি কিছুটা হলেও সফল সেদিন ‘শারলা’ কে বাবা মায়ের সামনে দাঁড় করাবো। এর আগে না। আর সব উদ্যোক্তার মতো আমিও চাই শারলা বিদেশের মাটিতে পা রাখুক। খেশ আর জামদানীর মিশেলে তৈরি হওয়া কুর্তি আরো গ্রহনযোগ্যতা পাক।
টেকজুমঃ দেশি পোশাক নিয়ে কাজ করতে গেলে কি কি বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিৎ?
রিথিন:বিষয়ের আগে আমার মনে হয় দেশী পোশাক কে ভালোবাসা উচিত। কারণ আমি যা নিয়ে কাজ করবো তাকে যদি আমি ভালোই না বাসতে পারি তাহলে আমি কাজ করতে পারবোনা। আর কাজ করলেও তা খুব বেশিদূর যাবে না। তাই সবার আগে ভালোবাসা টা জরুরি। এছাড়াও, পণ্য নিয়ে অন্তত ছয়মাস পড়াশোনা করে তার খুঁটিনাটি গুলো বুঝতে হবে। তাহলে যেকোনো কাজ খুব সহজ হবে। এখন আমি যদি এটাই না জানতাম।যে জামদানী কতটা সেন্সিটিভ তাহলে আমি আমার কারিগর কে সেভাবে ইন্সট্রাকশন দিতে পারতাম না কিংবা গ্রাহককেও এটা সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা দিতে পারতাম না। যা এখন আমি সহজেই পারি।
টেকজুমঃ আগামী দিনের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন কি?
রিথিন:জামদানী আর খেশ এর আরো কম্বাইন্ড কাজ করতে চাই, জামদানী আর খেশ এর পাশাপাশি আরো অনেকগুলো কমাইন্ড ওয়ার্ক করার ইচ্ছা আছে। পাশাপাশি খেশ নিয়েও অনেকগুলো ভাবনা ভেবে রেখেছি। যদি আল্লাহ চায় এবং স্বার দোয়া থাকে তাহলে এ বছরের মধ্যেই শারলার আরো অনেকগুলো কাজ সামনে আনবো।
টেকজুমঃ ধন্যবাদ আমাদের কে সময় দেওয়ার জন্য ।
রিথিন: আপনাকে এবং টেকজুম.টিভি কে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদের উদ্যোক্তা এবং দেশী পণ্যের পাশে থাকার জন্য।