ই-কমার্স বর্তমান সময়ের সব থেকে পরিচিত একটি নাম। নামটি শুনলেই আমরা বুঝে নেই যে অনলাইনে পণ্য কেনা-বেচা করার নাম ই-কমার্স। উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন আর সাবলম্বী হওয়ার সহজ একটি মাধ্যম এই ই-কমার্স।
কিন্তু উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের যাত্রা অনেক উৎসাহ আর উদ্দীপনার সঙ্গে শুরু করেও কেন আমরা এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারি না? হয়তো উত্তরটা আমরা জানি না অথবা আমরা কারণটা কখনও খুঁজে পাই না, অথবা সঠিক গাইড লাইনের অভাবে আমাদের এই করুণ পরিণতি। তাই আজ ই-কমার্স নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করা।
ই- কমার্স কি?
ইলেকট্রনিক কমার্স বা ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্য এমন একটি মাধ্যম যেখানে কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেম (ইন্টারনেট বা অন্য কোনো কম্পিউটার নেটওয়ার্ক) এর মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয়/বিক্রয় হয়ে থাকে। সহজ কথায় বলতে পারি ইন্টারনেট ব্যবহার করে কোনো কিছু বিক্রয় করাকেই আমরা ই–কমার্স বলতে পারি।
ই- কমার্স এর কিছু প্রকারভেদ রয়েছে
ব্যবসা-থেকে-ব্যবসা (B2B): সাধারণত এটি সম্পাদিত হয় ব্যবসা-থেকে-ব্যবসা অথবা একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। আমাদের দেশে শতকরা ৮০ শতাংশের মতো ইলেকট্রনিক কমার্স ব্যবসা-থেকে-ব্যবসা এর অন্তর্ভুক্ত।
ব্যবসা-থেকে-গ্রাহক/ভোক্তা (B2C): এই প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকের মধ্যে অর্থাৎ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যখন তার পণ্য সেবা কোনো গ্রাহক বা ভোক্তাকে পৌঁছে দেয় তখন আমরা একে ব্যবসা-থেকে-গ্রাহক/ভোক্তা বলে থাকি।
ব্যবসা-থেকে-সরকার (B2G): ব্যবসা-থেকে-সরকার ইলেকট্রনিক কমার্স সম্পাদিত হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় খাতের মধ্যে। এটি সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় কেনা/বেচা, লাইসেন্স সংক্রান্ত কার্যাবলী, কর প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
গ্রাহক-থেকে-গ্রাহক (C2C): গ্রাহক-থেকে-গ্রাহক অথবা একাধিক ব্যক্তি ও গ্রাহকের মধ্যে যখন কোনো ইলেকট্রনিক বাণিজ্য সম্পাদিত হয় আমরা তাকে গ্রাহক-থেকে-গ্রাহক (C2C) বলে থাকি। ইলেকট্রনিক কমার্স ও অনলাইন নিলামের মাধ্যমে সাধারণত এই ধরনের বাণিজ্য হয়।
মোবাইল কমার্স (m-commerce): তারবিহীন যন্ত্রের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান অথবা অর্থ প্রেরণ ও গ্রহণকে বোঝায়। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ধরনের বাণিজ্য জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
গ্রাহক থেকে সরকার (C2G): কখনো সরাসরি জনগণের কাছ থেকে সরকার বিভিন্ন সেবার বিনিময় ফি বা কর নিয়ে থাকে। ডিজিটাল গভর্নেন্স-এর আওতার এ ধরনের সেবা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সফল ই-কমার্স ব্যবসা পরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিৎ
পরিকল্পনা: যেকোনো ব্যবসা শুরুর আগে অবশ্যই সেই ব্যবসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা আবশ্যক। যে ব্যবসা আমরা শুরু করতে চাই সেই ব্যবসা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি, ব্যবসা করার জন্য যে মূলধন প্রয়োজন সেই পরিমাণ মূলধন আমাদের আছে কিনা এবং আমাদের পার্টনার, কর্মচারী সবার কাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কে কোন কাজ সম্পাদন করবে সেটি আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে। কারণ ই-কমার্স ব্যবসা এমন যে, একা একা করা সম্ভব নয়, সবাই মিলে এবং সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আবশ্যক।
সঠিক পণ্য নির্বাচন: ই-কমার্স ব্যবসার জন্য পণ্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ আপনি কোন ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করতে চান সেটি আপনি নিজে ঠিক করুন। যে পণ্যগুলো সম্পর্কে আপনি ভালো জানেন এবং বোঝেন সেই পণ্যগুলো নিয়েই কাজ করা উচিৎ। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে যে এমন পণ্য নির্বাচন করতে হবে যে পণ্যগুলো মানুষের চাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পণ্যগুলোর উৎস: আপনি যে পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করতে চান সেই পণ্যগুলো আপনি কিভাবে পাবেন এবং ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবেন সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে আপনার পণ্য সরবরাহ যদি সঠিকভাবে করতে না পারেন তাহলে আপনার ব্যবসার উপর একটা খারাপ প্রভাব পড়বে, পরবর্তীতে ওই ক্রেতা আর ওই পণ্যটি অর্ডার করবেন না। তাই পণ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
বাজার বিশ্লেষণ: চাহিদার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সবসময় কাজ করা উচিৎ। বাজারে যে পণ্যগুলোর চাহিদা সব থেকে বেশি সেই পণ্যগুলো নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। এছাড়া নতুন নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করতে পারেন। এজন্য অবশ্যই মানুষের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন নতুন কোনো ইলেক্ট্রনিক পণ্য, হাতের তৈরি গহনা, হাতের কাজ, প্রসাধনী, দেশের বিভিন্ন স্থানের বিখ্যাত খাবার, পোশাক নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
পণ্য ও গুণগতমান: একটা সফল ব্যবসা নির্ভর করে পণ্য এবং তার গুণগতমান এবং সেবার উপর। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে আমি যে পণ্যটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি সেই পণ্যটির গুণগতমান কেমন এবং ক্রেতা যে পণ্যটি অর্ডার করেছে সঠিক পণ্যটিই আপনি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা: যেকোনো ব্যবসায় প্রতিযোগিতা থাকবেই, কারণ কোনো ব্যবসায়ই আপনি একা একা করতে পারবেন না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকবে যাদের সঙ্গে আপনার ব্যবসার মিল থাকবে এবং তাদের সঙ্গেই আপনার প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে নিজের পণ্যগুলোর মান কমিয়ে বা মূল্য কমিয়ে বা বাড়িয়ে ব্যবসার ক্ষতি করা যাবে না। এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করবেন না যেন মার্কেট নষ্ট হয়। আপনার যেমন অধিকার আছে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার তেমনি প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অন্য কারো ক্ষতি করা যাবে না এই বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা জরুরি।
বিজ্ঞাপন এবং বিক্রয়: মার্কেটিং বা বিজ্ঞাপন একটি ব্যবসাকে প্রসারের জন্য অপরিহার্য বিষয়, কারণ আপনি অবশ্যই চাইবেন যে আপনার পণ্য সম্পর্কে সবাই অবগত হোক। আপনাকে এবং আপনার ব্যবসা সম্পর্ক সবাইকে অবহিত করা অপরিহার্য। মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন মাধ্যম এবং কৌশল রয়েছে যা সম্পর্কে আপনার অবহিত থাকতে হবে। আপনার প্রোডাক্টগুলোর সঠিক বিজ্ঞাপন/মার্কেটিং আপনার ব্যবসাকে সফল করবে এবং মুনাফা বাড়বে। মার্কেটিংয়ের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম আছে যেমন বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ, সংবাদপত্র, টিভিসহ আরো অনেক মাধ্যমে আপনার পণ্য এবং ব্যবসা সবাইকে অবহিত করা সম্ভব, কারণ আপনার যদি ক্রেতা না থাকে তাহলে আপনার পণ্য বিক্রি হবে না।
সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচন: ই-কমার্স বিজনেস করতে গেলে সবার প্রথম যে বিষয়টি মাথায় আসে তা হলো একটি ওয়েবসাইট, যা ব্যবহার করে সবাই কেনাকাটা করতে পারবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্লাটফর্ম এবং সঠিক প্রযুক্তি নির্বাচন করা। প্রযুক্তির ব্যবহার সঠিকভাবে জানতে এবং করতে হবে। ই- কমার্স বিজনেস মূলত নির্ভর করে প্লাটফর্ম এবং আপনার ওয়েবসাইট কতটুকু সুসজ্জিত তার উপর।
মনে করুন আপনার একটি দোকান আছে যেখানে অনেক ধরনের পণ্য আছে। কিন্তু আপনি আপনার পণ্যগুলোকে যদি সুসজ্জিত করে সাজিয়ে না রাখেন তাহলে ক্রেতা আপনার পণ্যটি খুঁজে পাবেন না। সেক্ষেত্রে আপনার বিক্রি কম হবে। ই-কমার্স বিজনেস ঠিক তেমনই আপনি আপনার দোকানটিকে যেভাবে সাজিয়ে রাখেন ঠিক তেমন করে আপনার ই-কমার্স ওয়েবসাইটকে সাজিয়ে রাখতে হবে যেন একজন ক্রেতা আপনার ওয়েবসাইট এ প্রবেশ করলে কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি খুঁজে পায়।
যে বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক
ডোমেইন নির্বাচন: ব্যবসার সঙ্গে মিল রেখে নাম নির্বাচন করতে হবে। কারণ নাম আপনার ব্যবসার পরিচয় বহন করবে। আপনার ব্যবসার ধরনের সঙ্গে মিল রেখে ডোমেইন নির্বাচন করা উচিৎ। সঠিক নাম নির্বাচন ব্যবসার উপর ভালো এবং মন্দ প্রভাব ফেলে। খুব সহজে বোঝা যায় এমন নাম নির্বাচন করতে হবে, তাহলে সবাই নাম পরে বুঝতে পারবে যে আপনার ব্যবসার ধরন এবং পণ্য সম্পর্কে।
হোস্টিং নির্বাচন: ই-কমার্স ওয়েবসাইটের জন্য সঠিক হোস্টিং নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আপনি যে হোস্টিং ব্যবহার করবেন সেটি অবশ্যই ভালোমানের হওয়া জরুরি। হোস্টিং নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেমোরি, ডিস্ক স্পেস, ব্যান্ডউইথ এবং সাপোর্টের কথা মাথায় রেখে হোস্টিং নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার হোস্টিংয়ের মান যদি খারাপ হয় তাহলে আপনার ওয়েবসাইটের গতি কমে যাবে। সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীরা সমস্যার সম্মুখীন হবে, এটা আপনার ব্যবসার উপর একটা খারাপ প্রভাব ফেলবে।
প্লাটফর্ম নির্বাচন: ই-কমার্স বিজনেসের ক্ষেত্রে প্লাটফর্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে। কারণ একটি ওয়েবসাইটকে সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য আপনাকে যে কোনো একটি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আপনার ওয়েবসাইট তৈরি করতে হবে। ই- কমার্স ওয়েবসাইটের জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে থাকি। এই প্লাটফর্মগুলো বিভিন্ন ফিচারের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন প্লাটফর্ম এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করি।
জনপ্রিয় কয়েকটি প্লাটফর্ম হল- WordPress (Woocomerce), Magento, Open Cart, Zen Cart, Pestashop, X-Cart, OsCommerce
পেমেন্ট সিস্টেম: ই-কমার্স ওয়েবসাইটের জন্য পেমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যে কোনো পণ্য ক্রয় থেকে শুরু করে সেই পণ্যটির মূল্য কিভাবে গ্রহণ করবেন অথবা ক্রেতা কিভাবে সেই মূল্য পরিশোধ করবে সেটি আগেই ঠিক করে নিতে হবে। পেমেন্ট অনেক ধরনের হতে পারে। আমাদের দেশে ক্যাশ অন ডেলিভারির মাধমেই বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে আপনার ওয়েবসাইট অবশ্যই মূল্য পরিশোধের জন্য একাধিক মাধ্যম থাকা জরুরি। কারণ ক্রেতা যেন খুব সহজে যেন তার কোন মূল্য পরিশোধ করতে পারেন।
প্রোডাক্ট ডেলিভারি: যে কোনো পণ্য অর্ডার থেকে শুরু করে কতো সময়ের মধ্যে এবং কোন মাধ্যমে আপনি আপনার পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তা অবশ্যই পরিকল্পনা করে নিতে হবে। নিজেদের ডেলিভারি ব্যবস্থা না থাকলে বিভিন্ন ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে আপনি আপনার পণ্য সরবরাহ করতে পারেন। আপনি যদি আপনার পণ্যটি সঠিকভাবে এবং সঠিক সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে না পারেন তাহলে আপনার ব্যবসার উপর খারাপ প্রভাব পড়বে। ই-কমার্স ওয়েবসাইট থেকে মূলত ক্রেতারা পণ্য অর্ডার করে সঠিক সময়ে পণ্যটি হাতে পাওয়ার জন্য। তাই যে কোনো পণ্য সঠিকভাবে মান যাচাই করে তারপর ক্রেতার হাতে তুলে দিন। লক্ষ্য রাখুন যেন পণ্য সরবরাহে কোনো ভুল না হয় এবং সঠিক পণ্যটি ক্রেতার হাতে পৌঁছায়।
সেবা: ই-কমার্স ওয়েবসাইট প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের ফোন এবং জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়। পণ্য বিক্রয় পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে ক্রেতাকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা আবশ্যক। এমন অনেক পণ্য থাকে যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে সেক্ষেত্রে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন সঠিকভাবে হওয়া জরুরি। ক্রেতাকে ভুল কোনো তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না, এর ফলে ব্যবসার উপর একটা খারাপ প্রভাব পড়বে। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে মোবাইল, টেলিফোন, ই-মেইল অথবা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে।