গত ২৭ নভেম্বর (শনিবার) সন্ধ্যায় পরিধান শৈলী গ্রুপে (ফেসবুক) লাইভে এসে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি হয় রাজিব আহমেদ ১-৭ ডিসেম্বর অনলাইনে দেশি শাড়ির ওয়েভ করার ঘোষণা দেন। ইতিমধ্যে ২৩৫ টি ফেসবুক গ্রুপের এডমিনরা তাদের গ্রুপে এ ওয়েভ শুরু করেছেন। এছাড়াও নিজ নিজ ফেসবুক প্রোফাইল থেকেও এই ওয়েভে যোগ দিয়েছেন বিশেষ ব্যক্তিরা। তাদের একজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। তিনি দেশি শাড়ির বিভিন্ন দিক নিয়ে নাহিদ সুলতানার সাথে সাক্ষাৎকার দেন।
নাহিদ সুলতানা : আপনাকে তো আমরা মঞ্চ, টেলিভিশন সহ সব জায়গাতে দেশি শাড়িতে দেখি, এর পিছনে কি কোন বিশেষ কারন আছে?
কনকচাঁপা : মায়ের শাড়ি পরা দেখে সত্যিকার অর্থে শাড়ির প্রেমে পড়ি। সেটা কৈশোরেই অন্তরে গেঁথে গিয়েছে। বাইরে বেরুনোর সময় মা অবশ্যই পরিপাটি হয়ে বের হতেন। কিন্তু রোজকার সাংসারিক রুটিনে দুপুরের রান্না শেষে অতিশয় রূপবান মা যখন গোসল শেষে মাজা ছাপানো চুল গামছায় ঝাড়ার পরে তিব্বত স্নো মাখতেন তখন কল্পনা প্রবন আমি ভাবতাম, এই মানুষটি মা হলেও আসলে আকাশ থেকে নেমে আসা পরি। টকটকে ফর্সা আমার মা যখন গোলাপি, কমলা, গমরংয়ের পাবনা বিটি শাড়ির সুতাপাড় বা ডুরে শাড়ি এক প্যাচ করে পড়ে সামনে দাঁড়াতেন তখন আমার সত্যিই মাকে ফুলপরি মনে হতো। তখন থেকেই আমি দেশি এবং সুতি শাড়ির প্রেমে পড়ি। মাড় দিয়ে টানটান করে শুকোতে দেয়া কাপড় পরার পরে মনে হতো ইস্ত্রি করা। যত ফুলছাপা, নানা ডিজাইনের শাড়িই হোক না কেন এই পরিনত বয়সেও আমার ওই রকম পাড় ওয়ালা এক রঙের সুতি শাড়িকেই “মৌলিক শাড়ি” বলে মনে হয়।
আমি আমার পছন্দের বাইরে গিয়ে যুগের সাথে কখনও তাল মিলাইনা। এসব ক্ষেত্রে আমি একরোখা বটে। এই রকম শাড়ি ভাবনা থেকেই আমার শাড়ি বাছাই করা। আর দেশের শাড়ি বলে তো আলাদা একটা গর্ব কাজ করেই।
নাহিদ সুলতানা : দেশি সব শাড়িই কি পছন্দ নাকি বিশেষ কোন ক্যাটাগরির শাড়ি?
কনকচাঁপা : দেশি সব শাড়িই পছন্দ। টাঙ্গাইলের হালকা সুতার কাজ করা সুতির শাড়ি বেশি পছন্দ। তবে উৎসব বা মঞ্চের আমেজের ব্যাপারে মসলিন পরি। তবে সচ্ছতার জন্য একটু অস্বস্তি বোধ করি বিধায় অনেক গুলো সেফটিপিন লাগাতে হয়। আর সারাক্ষণ শাড়ি ছিড়ে যাওয়ার ভয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে সফট কাতানও পছন্দ। কিন্তু দ্বৈত চরিত্রের শাড়ি আমার অপছন্দ। যেমন কাতানের উপর আবার আঠা দিয়ে জরিচুমকি বসালে শাড়ির বংশপরিচয় বলে কিছুই থাকেনা।
নাহিদ সুলতানা : কাউকে উপহার দেওয়ার জন্য কি দেশি শাড়ি বেছে নেন?
কনকচাঁপা : অবশ্যই। নিজে যা ব্যবহার করিনা তা কখনও অন্যকে দেয়া উচিত নয়। দেশি শাড়িতেই আমার ভালোলাগা। তাই উপহারেও দেশি শাড়িই দেই। সেক্ষেত্রে যাকে দেব তার গায়ের রঙ বয়স এবং তার পছন্দ বুঝার চেষ্টা করি। এতে আন্দাজ করতে সুবিধা হয় কোন রঙের বা প্রকারের শাড়ি ভালো মানাবে।
নাহিদ সুলতানা : দেশি শাড়ির ওয়েভ নিয়ে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট দেওয়ার কারণ কি?
ফেসবুকে দেশি শাড়ির ওয়েভ হচ্ছে দেখে অনেক ভালো লাগছে। আমার ভেরত টা নাড়া দিয়েছে। আমি সবসময় ই দেশি শাড়ির ভক্ত। ওয়েভ দেখে মনে হচ্ছে আমার মতো দেশি শাড়ি প্রেমী আরও অনেকে আছে। তাই আবেগ থেকে পোস্ট দিয়েছি। যেন আমার ফেসবুক বন্ধুদের নজরে আসে এবং তারাও উৎসাহীত হয় দেশি শাড়ির প্রচার ও ব্যবহারে। আমার বন্ধু তালিকার সবাইকে আহ্বান জানিয়েছি #দেশীশাড়িরওয়েভ হ্যাশট্যাগ দিয়ে দেশী শাড়ি পরা ছবি দিয়ে পোস্ট দিতে পারেন।
আমি আশির মধ্যদশকে পেশাদার ভাবে গান শুরু করি। দেশি শাড়ি পরা নিয়ে রীতিমতো আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তখন অন্য শিল্পীরা প্রায় সবাই জরি চুমকি বসানো সচ্ছ শিফন জর্জেট, সচ্ছ ঝলমলে শাড়ি পরতেন। বলাইবাহুল্য সেগুলো পাকিস্তানি বা ভারতীয় অথবা অন্য দেশি। যা আমাদের পলিমাটির এই আবহাওয়ায় একদমই যায়না। আমি প্রথম থেকেই নিয়মিত দেশী শাড়ি পরতাম। আড়ালে ও সামনে দেশী শাড়ি পরার জন্য আমার সহকর্মী শিল্পীদের কাছ থেকে ক্ষ্যাত উপাধি পেয়েছিলাম। আমি একদমই তোয়াক্কা করিনি।
আমি বিশ্বাস করি এই ওয়েভ দেশের শাড়ি সার্বিক ভাবেই সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার ছোট একটি প্রয়াস!
নাহিদ সুলতানা : দেশি শাড়ি ব্যবহার করতে সবার উদ্দেশ্য কি বলবেন?
কনকচাঁপা : উপদেশ দিয়ে দেশি শাড়ি ব্যবহার বাড়ানো খুব একটা সম্ভব না। আমার মা বোনেদের ভেতর থেকে এই অনুভব আসতে হবে। তারা যেমন নির্বিকার ভাবে নির্বিচারে বিজাতীয় ভাষার সিরিয়ালে মত্ত, তেমনি বিজাতীয় শাড়িতেও অন্ধ! আমি তাদের (কারো কারো) ভাবনার বৈরাগী দেখে দুঃখে নিমজ্জিত হই।
এক শ্রেণীর মা খালা আছেন জ্বর থেকে সেরে ওঠার উপলক্ষে ও ভারতে যান শাড়ি কিনতে। তাদের জন্য আমার করুনা হয়। আর ফেসবুক তো আছেই। সেই শাড়িগুলোর অবাধ প্রদর্শনী আমাকে ব্যথিত করে। কিন্তু অত ব্যথিত না হয়ে আস্তে করে আমি আনফ্রেন্ড করে দেই। এ ধরনের কথা শুনতে খুব ভালো না লাগলেও আসলেই আমি এটা করি। কারণ আমার দেশ আমার মা আমার নিজস্ব সবকিছুর জন্য আমি খুব স্বার্থপর।
আমার মা কে যেমন ভালোবাসি তেমন ভালোবাসি- আমার দেশের শাড়ি, আমার দেশের মানুষ, আমার বাংলা ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি সহ সবকিছু। আমি কখনো কথার কথা বলিনা। যা বলি মন থেকেই বলি।
আমি বিষেশ করে মায়েদের বলবো, নিজেরা দেশি শাড়ি ব্যবহার করুন এবং সন্তানদেরও পরতে দিন। তা করতে পারলে বিদেশি শাড়ির আগ্রাসন একদম বন্ধ না হলেও কমে আসবে ইনশা আল্লাহ। একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন। আরব, ইংল্যান্ড, চীন ও ইতালীয় অভিজাত পরিবারে ব্যবহার করা হতো আমার দেশের তাঁতের শাড়ি।
মা বোন খালামনি আর কন্যারা—– নিজ আদর্শে জেগে ওঠো। দেশকে ভালোবাসা দেবার এটাই সময়।
নাহিদ সুলতানা : দেশি শাড়ি নিয়ে এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ?
কনকচাঁপা : আপনাকেও ধন্যবাদ।