ক্রেতা রিভিউ হল বিজনেসের প্রাণ। স্পেশালি অনলাইন বা ই-কমার্স নির্ভর বিজনেসের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। অনলাইন শপিং এর প্রধান অন্তরায় হল- দূরত্ব। যে কোনো অনলাইন বিজনেসের ক্ষেত্রেই তাই ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারে ক্রেতাদের থেকে প্রাপ্ত রিভিউ। রিভিউ বিজনেসের সাথে সম্ভাব্য ক্রেতাদের একটা সেতুবন্ধন তৈরী করতে পারে।
যেহেতু অনলাইন শপিং এ অনেক সময় সাশ্রয় হচ্ছে ক্রেতার, পাশাপাশি কোভিড-১৯ পেন্ডেমিকেও ঘরে বসেই সব পণ্য সেবা গ্রহণের এক প্রকার অভ্যস্ততা তৈরী হয়ে গিয়েছে সবার মাঝে, তাই প্রতিদিন বাড়ছে অনলাইন শপিং এর জনপ্রিয়তা। তারপরও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত অনলাইন শপিং এর ক্ষেত্রে ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে শক্তিশালী আস্থা-বিশ্বাসের সম্পর্কে বিশাল দূরত্ব রয়ে গেছে। এখনো প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ অনলাইনে কিছু অর্ডার করার আগে দ্বিধান্বিত থাকে সঠিক পণ্যটা সঠিক সময়ে পাবে কিনা এ নিয়ে।
এছাড়াও যদি শুধু আমাদের দেশীয় পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রীর কথা বলি, এক্ষেত্রে দু’বছর আগেও প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বিদেশী পণ্যের সাথে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা। বাংলাদেশে বিদেশী পণ্যের এতো বেশি আধিক্য ছিল যে, ফেইসবুক টাইমলাইন জুড়ে থাকত শুধু বিদেশী পণ্যের লাইভ আর দামী সব বিদেশী পণ্য গায়ে জড়ানো ক্রেতাদের গর্বিত ছবি! ফলাও করে প্রচার করা হত তখন, বিদেশী পণ্য মানেই ভালো, আর দেশী মানেই কোয়ালিটি ভালো না।
গত দু’বছরে এই পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। আমাদের দেশীয় পোশাকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে এই ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তাদের প্রচারের মাধ্যমে, ফেইসবুকে ছোট বড় অনেক গ্রুপ তৈরী হয়েছে, যারা শুধু দেশীয় পণ্যের প্রচারে কাজ করছে। তবে এখনো এই ইন্ডাস্ট্রীর সমৃদ্ধিতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেহেতু বিদেশী পণ্যের সুগঠিত বিশাল বাজারের সাথে প্রতিযোগীতা করতে হচ্ছে, তাই দেশি পণ্যের প্রচার এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে আরও মনযোগী হতে হবে। নতুন এই দেশীয় পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রীকে শক্তিশালী একটা অবস্থানে নিতে হলে অবশ্যই এই ইন্ডাস্ট্রির ক্রেতাদের রিভিউ এর উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
আর এজন্য দেশীয় পণ্যের আলাদা একটা রিভিউ সাইট তৈরী করা যায়, যেখানে বিভিন্ন দেশীয় পণ্যের ক্রেতাদের রিভিউগুলো গল্প আকারে শেয়ার করা হবে, ক্রেতাদের ফীডব্যাক, সাজেশন ইত্যাদি থাকবে। এ ধরণের রিভিউ সাইট সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে প্রবাসী ক্রেতাদেরকে। কারণ প্রবাসি ক্রেতারা দেশে তাদের প্রিয়জনদেরকে উপহার পাঠানোর জন্য গুগলে বিভিন্ন অথেনটিক পেইজ আর ওয়েবসাইটের অনুসন্ধান করে থাকে। প্রবাসি ক্রেতা ছাড়াও অনেক আধুনিক ক্রেতারা এখন গুগল সার্চ করে ওয়েবসাইট খুঁজে কেনাকাটার সুবিধার্থে। এ ধরণের ক্রেতাদেরকে দেশি পণ্যের সমৃদ্ধ রিভিউ সাইট অনেক বেশি সাহায্য করতে পারবে অনলাইনে বিশ্বাসযোগ্য দেশীয় পণ্যের বিজনেসগুলোকে খুঁজে পেতে।
রিভিউ সাইট ক্রেতাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, যেখানে ক্রেতারা নিজেরাই লগ ইন করে তাদের কেনাকাটার অভিজ্ঞতা সরাসরি শেয়ার করতে পারবে পেইজ, ওয়েবসাইট বা উদ্যোগের নাম এবং লিঙ্ক দেয়া সহ। ক্রেতাদের পজিটিভ, নেগেটিভ সব ধরণের মতামত দেয়ার সুযোগ থাকবে এবং বিজনেস বা উদ্যোক্তারা নেগেটিভ ইস্যুগুলোকে কিভাবে সমাধান করছে, সেই ব্যাপারগুলোও উঠে আসবে। এর মাধ্যমে রিভিউ সাইটে যারা আসবে তাদের মাঝে এক ধরণের ভরসা তৈরী হবে যে, এই ওয়েবসাইটের সাথে যে সব বিজনেস বা উদ্যোগ কানেক্টেড আছে তারা ক্রেতাদের গুরুত্ব দেয়, ভালো পণ্য সেবা দেয় এবং কোনো সমস্যা হলেও তাদের কাছ থেকে সমাধান পাওয়ার সুযোগ আছে।
রিভিউ সাইটে ইংরেজি অংশ রাখতে পারলে ভাল হয়। তাহলে অন্য ভাষার সম্ভাব্য কাস্টমাররাও বাংলাদেশী পণ্য নিয়ে জানতে আগ্রহী হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল আমরা নিজেরাও জানি না কত রকম দেশি পণ্য আছে। ঘুরেফিরে ২০-৩০ রকমের পণ্য নিয়েই জানি। অথচ এ দেশে কম করে হলেও ১ হাজার পণ্য আছে তাতে সন্দেহ নেই। সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হবে।
রিভিউ সাইটে ফেইক বা নকল রিভিউ আসবে- এই সমস্যা থাকবেই। অ্যামাজনেও তা হয়। এ নিয়ে টেনশন না করে আসল বা সত্যিকারের রিভিউগুলোকে কিভাবে সামনে এগিয়ে আনা যায় সেই পদ্ধতি আর কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। এ নিয়ে অনেক কাহিনী হবে সন্দেহ নেই কিন্তু তাতে দমে গেলে চলবে না। তাছাড়া অনেক উদ্যোক্তা চাইবেন তাদের কথা, তাদের ছবি যাক এমন রিভিউ সাইটে। এটিও মাথায় রাখতে হবে।
আর প্রতিটি পণ্যের রিভিউ এর সাথে সাথে যদি তার উপর কোন ভিডিও ইউটিউবে দিয়ে ওয়েবসাইটে এমবেড করা যায় তা হলে অনেক বেশি কাজের ও আকর্ষণীয় হবে। প্রথম ধাপে ভিডিওগুলো বাংলাতে হবে হয় তো, তবে ধীরে ধীরে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভিডিও করতে পারলে দারুন হবে। ভিডিও নিয়ে আমাদের আসলেই সিরিয়াস হতে হবে, কারন অনেক দেশি পণ্যের ভিডিও একদম নেই। দেশি পণ্যকে অনলাইনে উপস্থাপনাতে আমরা আসলেই অনেক পিছিয়ে আছি এখনো।
রিভিউ এর মূল কাজ হল, কোন পণ্য সম্পর্কে ভাল আর খারাপ দুই দিক তুলে ধরে তা কাস্টমার কে কেনার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা। কোন পণ্য খুব ভাল হলেও তা হয়তো আমার জন্য অত দরকারি না- রিভিউ এর মাধ্যমে তা বুঝা যায় সহজে। এজন্য দেশি পণ্যের এক না বরং অনেকগুলো রিভিউ ওয়েবসাইট তৈরি করা দরকার। যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করা দরকার।
লেখকঃ রাজিব আহমেদ, সাবেক এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং খাতুনে জান্নাত আশা, স্বত্বাধিকারী – পিয়াসী।