চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই দেশের বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকের আটকে থাকা টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন গেটওয়েতে ১৩ ই-কমার্সের মোট ৩৪ হাজার ৬৯০ গ্রাহকের আটকে থাকা ৩০২ কোটি ৯৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭৭ টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। প্রতারক এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের এমন প্রায় ৫৬১ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে পড়ে, যা এখন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাওনাদাররা ফিরে পেতে শুরু করেছেন।
কেন্দ্রীয় ডিজিটাল ই-কমার্স সেলের তত্ত্বাবধানে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেওয়ার তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে—কিউকম, আলেশা মার্ট, দালাল প্লাস, বুমবুম, আনন্দের বাজার, থলে ডটকম, ধামাকা, শ্রেষ্ঠ ডটকম, আলিফ ওয়ার্ল্ড, বাংলাদেশ ডিল, সফেটিক, ৯৯-গ্লোবাল ও আদিয়ান মার্ট।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গ্রাহকের পাওনা অর্থ ফেরত দেওয়ার এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এতে নতুন তালিকায় যোগ হচ্ছে আরও তিন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো- ইভ্যালি, সিরাজগঞ্জ শপ ও আলাদীনের প্রদীপ। যদিও এ তিন প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া কবে থেকে শুরু হবে, তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এটি নির্ভর করবে গ্রাহকদের তালিকা পাওয়া এবং গেটওয়েতে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ সুনির্দিষ্টভাবে জানার ওপর। কারণ, ইভ্যালির ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। এ ছাড়া কত টাকা আটকে আছে, তা-ও জানা দরকার।
এদিকে ইভ্যালিসহ তিন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গেটওয়ে এবং ব্যাংক হিসাবে কী পরিমাণ নগদ অর্থ জমা আছে এবং গ্রাহক সংখ্যা কত, তা জানতে চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব প্রতারক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে টাকার সন্ধান পাওয়া গেলে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে গ্রাহদের ফিরিয়ে দেবে।
এ লক্ষ্যে গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (ডিজিটাল ই-কমার্স সেল) মোহাম্মদ সাঈদ আলী স্বাক্ষরিত তিনটি পৃথক চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে ব্যাংক হিসাব চাওয়ার পাশাপাশি তাদের কাছে কত গ্রাহক টাকা পায়, পাওনা টাকার মোট পরিমাণ এবং তার থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কী পরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়া হয়েছে, কী পরিমাণ গ্রাহকের পাওনা বাকি আছে, তার হালনাগাদ তথ্য দিতে বলা হয়েছে। ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব তথ্য পাঠাতে সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেলের প্রধান মোহাম্মদ সাঈদ আলী বলেন, ব্যাংকের হিসাবের তথ্য চাওয়ার মূল কারণ গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকে টাকা থাকলে ওই টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া সহজ হবে। নইলে ভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে হবে। আমরা চাই, ক্ষতিগ্রস্ত সব গ্রাহক তার পাওনা অর্থ ফিরে পাক।
এক প্রশ্নের জবাবে সাঈদ আলী বলেন, এখনো কোনো প্রতিষ্ঠান জবাব দেয়নি। তবে ইভ্যালি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আশা করছি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জানতে চাওয়া তথ্য পেয়ে যাব।
সূত্র জানায়, ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সিরাজগঞ্জ শপের বিরুদ্ধে ৪৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দেশব্যাপী প্রতারণার জাল বিছানো কোম্পানির নাম ‘আলাদীনের প্রদীপ।’ কোম্পানির মালিক মেহেদী হাসান মুন আলাদীনের প্রদীপ হাতে পেলেও আর্তনাদ করছেন টাকা দিয়ে পণ্যের অপেক্ষায় থাকা ক্রেতারা।
জানা যায়, ইভ্যালি থেকে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা এক টাকাও ফেরত পাননি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন জামিনে বেরিয়ে এসে নতুন করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করলেও পুরোনো গ্রাহকদের অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। টাকা ফেরতের বিষয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অবশ্যই আমাদের টাকা রিফান্ডের পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য আমাদের সার্ভার ওপেন করে দিতে হবে। সার্ভার ওপেন না করলে এটি সম্ভব হবে না। এজন্য আমাজনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের এমডি মোহাম্মদ রাসেল কারাগারে থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
ইভ্যালির ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। ফলে ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার পর ইভ্যালি থেকে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ইভ্যালির পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, তাদের ব্যাংক হিসাব জব্ধ আছে। এটি খুলে দেওয়া হলে ব্যাংক হিসাবের তথ্য সরবরাহ করতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিউকমের গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি অর্থ ফেরত পেয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী জামিনে বেরিয়ে আসার পর টাকা ফেরতের কার্যক্রম থেমে গেছে। একাধিকবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের তালিকা দেয়নি তারা। ফলে এসক্রো সার্ভিসে আটকে থাকা টাকাও গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।