ই-কমার্সে প্রতারিতদের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি খাতটির স্থিতিশীলতা ফেরাতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে ফের আস্থা ফিরে পাচ্ছে গ্রাহক। এ কারণে বাড়ছে লেনদেনও। এক বছরের ব্যবধানে ই-কমার্সে লেনদেন বেড়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এর আগে ই-অরেঞ্জ, কিউকম, ধামাকা শপিং, দালাল প্লাসসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে এই সেবার প্রতি গ্রাহকের আস্থা প্রায় উঠে গিয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবরে ই-কমার্সে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। আর সেপ্টেম্বরের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে ১৩৭ কোটি টাকা। ওই মাসে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা।
মুন্সিব্জি ডটকমের হাত ধরে ২০০০ সালে দেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু। ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবিধা শহর থেকে গ্রামে বিস্তৃত হলে ই-কমার্সের সম্প্রসারণ হয়। এ সময় সেলবাজার ডটকম, এখানেই ডটকমসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে অনলাইন কেনাবেচায় যুক্ত হয়। কিন্তু ইন্টারনেটের গতি কম থাকাসহ নানা কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সালে বিক্রয় ডটকম ও ২০১৪ সালে দারাজের মতো প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। এসব প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই দেশে ই-কমার্স ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটে।
২০২০ সালে করোনাকালে মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছিল। আর তখনই ই-কমার্সের ব্যবসার পালে হাওয়া লাগে। তখন মানুষ এক রকম বাধ্য হয়েই ই-কমার্সে ঝুঁকে পড়ে। এতে দ্রুতই খাতটির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এ সময় ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম, ধামাকা শপিং ও দালাল প্লাসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অস্বাভাবিক ছাড়ে পণ্য বিক্রি শুরু করে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কেনাকাটা বাড়ে কয়েক গুণ। প্রথম দিকে তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্রাহককে অনেক কম দামে পণ্য দিলেও এক সময় প্রতারণা শুরু করে। বেশি ক্রয়াদেশ নিয়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হয় প্রতিষ্ঠানগুলো। আর আস্থা হারাতে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার হস্তক্ষেপ করে। গ্রেপ্তার হতে থাকেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। আর জনপ্রিয়তা হারায় ই-কমার্স খাত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের জুনে ই-কমার্সে লেনদেন বেড়ে রেকর্ড ১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা হয়েছিল। কিন্তু প্রতারণার প্রভাবে এক মাসের ব্যবধানে তা কমে দাঁড়ায় ৭৪২ কোটি টাকায়। এরপর প্রতি মাসেই কমেছে লেনদেন। তবে ডিজিটাল কমার্স আইন ২০২১ প্রণয়নের পর ২০২২ সালের এপ্রিলে আবার হাজার কোটির মাইলফলক স্পর্শ করে এই খাতে বেচাকেনা। এরপর থেকে হাজার কোটির ঘরেই আছে এই লেনদেন। অর্থাৎ ধীরে ধীরে প্রতারণার প্রভাব কমে এ খাতের আবার গ্রাহকের আস্থা ফিরছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-কমার্সে সরকারের বিশেষ নজরের কারণে প্রতারণা অনেকটাই কমে এসেছে। এ ছাড়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা অর্থ নিজস্ব সেটেলমেন্ট হিসেবে নেওয়াসহ নানা নীতির কারণে এই খাতে আস্থা ফিরছে মানুষের। গ্রাহকদের আগ্রহ বাড়তে থাকলে এই খাত আরও বড় হবে বলেও ধারণা তাদের।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি এই ই-কমার্স খাত নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সিপিডি বলেছে, আগামী চার বছরে ই-কমার্সের বাজার আরও প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বাড়বে। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে ই-কমার্সের বাজারের আকার ছিল ৬৬০ কোটি ডলার। ২০২৬ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলারে। বর্তমান বাজারদরে এর পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
২০২১ সালে ই-কমার্স খাতে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এলে এই খাতে গ্রাহকদের আস্থাহীনতা তৈরি হয়। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অগ্রিম টাকা নিয়ে দীর্ঘদিনে পণ্য বা সেবা সরবরাহ করছিল না। এ নিয়ে নানা বিতর্কের মুখে ওই বছরের জুনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশিকা জারি করে। ওই নির্দেশনার আলোকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, পরিশোধ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ নিজস্ব সেটেলমেন্ট হিসেবে ধারণ করবে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহের পর দাম পাবে। লেনদেন নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যাংক, এমএফএস বা ই-ওয়ালেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারবে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো এসব নির্দেশনা মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারিত গ্রাহকরা নিজেদের পাওনা টাকা ফেরত পাচ্ছেন। তবে ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া একটু ধীরগতির। ২৭ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকরা পান ৫২৫ কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি পাওনা আদায় করতে পারলেও এখনো অনেকে টাকা ফেরত পাননি।