বিশ্বে উৎপাদিত ৪০ হাজার রকমের চালের মধ্যে বিশেষ কদর ধরে রেখেছে সুগন্ধি যুক্ত চালগুলো। বাংলাদেশে বেশিরভাগ সুগন্ধি চালের উৎপাদন হয় আমন মৌসুমে। দেশে নতুন পুরাতন বহুরকমের সুগন্ধি চাল উৎপাদন হলেও আজকের আলোচ্য বিষয় জনপ্রিয় ৫ প্রকার দেশি সুগন্ধি চাল নিয়ে। যা সারাদেশে পরিচিত এবং ব্যবহৃত।
তুলশীমালা চাল
তুলশীমালা চাল শেরপুরের একটি জেলা ব্র্যান্ডিং পণ্য। সম্প্রতি এটি জিআই স্বীকৃতি অর্জন করেছে। শতবর্ষের বেশি সময় ধরে শেরপুরের কৃষকরা তুলশীমালা চালের চাষ করে আসছে। তাদের কাছে রয়েছে তুলশীমালার বিশেষ কদর। পিঠা পায়েস থেকে শুরু করে সবধরনের বিশেষ খাবার তৈরিতে তারা ব্যবহার করেন তুলশীমালা চাল। নতুন ধান উঠলে উপহার হিসেবে পাঠান আত্মীয় বাড়িতে। কথিত আছে এই উপহার দেওয়ার মাধ্যমে কর্তাদের মন জয় করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতো শেরপুরের মানুষ। কালের পরিক্রমায়। ই-কমার্সের কারণে তুলশীমালা চাল এখন পাওয়া যায় সারাদেশে।
কালিজিরা চাল
ধানের খোসা কালো রঙের হওয়ার কারণে ধানের নাম হয়েছে কালিজিরা। তবে চাল হয় সাদা রঙের এবং সুগন্ধী যুক্তি। এই চালের প্রধান উৎপাদন এলাকা ময়মনসিংহ হলেও সারাদেশে চাষ করা হয় কালিজিরা ধানের। এটি দিয়ে পোলাও, পায়েস রান্না করা যায়। বিশেষত্বের কারণে বলা হয়, চালের রাজা কালিজিরা। জমির পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যায় কালিজিরা ধানের ঘ্রাণ।
কাটরিভোগ চাল
দিনাজপুর অঞ্চলের বিখ্যাত চালের নাম কাটারিভোগ। এটি দিনাজপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। তবে দিনাজপুর ছাড়া অন্য অঞ্চরে চাষ করলে কাটারিভোগের সুগন্ধ হারিয়ে যায়। এই চালের আকৃতি হয় চিকন। পোলাও পায়েসের জন্য বিখ্যাত কাটারিভোগ চাল। এটি দিনাজপুরের ঐতিহ্য। প্রাচীনকাল থেকে উৎপাদন হয়ে আসছে দিনাজপুরে। আমন মৌসুমে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি জমিতে চাষ করা হয় কাটারিভোগ। সব কৃষকই কম বেশি কাটারিভোগ চাষ করেন নিজের জমিতে। তা বিক্রির পাশাপাশি উপহার দেন নিকটাত্মীয়দের। কাটারিভোগ একটি জিআই স্বীকৃতি অর্জনকারী চাল।
বাদশাভোগ চাল
দিনাজপুর অঞ্চলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চালের নাম বাদশাভোগ। এটির ফলন তুলনামূলক ভালো হাওয়ার কারণে কৃষকের আগ্রহ রয়েছে বাদশাভোগ চাষে। পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে সারাদেশের পাইকারি বাজারেও পাওয়া যায় খুব সহজে। পোলাও বা খিচুড়ি রান্নার সময় চাল সিদ্ধ হয়ে আসলে ঘ্রাণ ছড়ায় বাদশাভোগ চাল। নামরকরণ নিয়ে কিছু জানা না গেলেও মনে করা হয় রাজা বাদশাদের পছন্দের খাদ্য পণ্য হওয়ার কারণেই নামকরণ হয়েছে বাদশাভোগ। এই চালের খাবার খুব সহজে হজম হয়ে যায়।
ব্রি ধান৩৪
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত একটি জাতের নাম ব্রি ধান৩৪। এটি আমন মৌসুমে উৎপাদন হয়। ১৯৯৭ সালের দিকে যশোর অঞ্চলের একটি ধান থেকে প্রক্রিয়াজত করে উদ্ভাবন করা হয়েছি সুগন্ধি ব্রি ধান৩৪ এর। কৃষকের জন্য লাভজনক ও সুস্বাদু হওয়ার কারণে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ব্রি ধান৩৪। এটি এখন সারাদেশেই উৎপাদন ও বিক্রি হয়।
জনপ্রিয় এই ৫ প্রকারের দেশি সুগন্ধ চাল সারাদেশেই পাওয়া যায়। এগুলোর রয়েছে বাণিজ্যিক কদর ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি। উপরে আমরা আলোচনা করেছি শেরপুরের তুলশীমালা চাল ও দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল আত্মীয়দের উপহর দেওয়া হয়। এটি এখন দুই অঞ্চলের কৃষকের কাছে অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। নতুন ধান বাড়িতে আসার পর মেয়ে বাড়ি কিংবা নাতি নাতনিদের জন্য না পাঠিয়ে কৃষকের মনে সায় দেয় না খাওয়ার জন্য। আবার বাদশাভোগ চাল যে রাজা বাদশাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে ছিল তা নামেই সাক্ষ্য দেয়। অন্য দিকে বিশেষত্বের কারণে চালের রাজার খ্যাতি অর্জন করে রেখেছে কালিজিরা চাল। তবে এই চার প্রকারের ধানের উৎপাদন খুবই কম। সর প্রয়োগ করলে এসব ধান থেকে প্রাপ্ত চালের ঘ্রাণ কমে যায়।
অন্য দিকে ফলম দ্বিগুণ হওয়ার কারণে খুবই অল্প সময়ে সারাদেশের কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ব্রি ধান৩৪। বিশেষভাবে উল্লেখ্য কালিজিরা, তুলশীমালা কিংবা কাটারিভোগ ধান নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভালো ফলন হয়। দেশের অন্যত্র আবাদ করা হলে তা হারায় গুণাগুণ। কিন্তু ব্রি ধান৩৪ তার ব্যতীক্রম। এর ফলন যেমন দ্বিগুণ তা উৎপাদন হয় সারাদেশে। সারা প্রয়োগেও তেমন অসুবিধা নেই। তাই দ্রুতই জনপ্রিয় সুগন্ধি চালের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
তবে বলে রাখা ভালো, ৫ প্রকার দেশি সুগন্ধি চালের তৈরি খাবারে স্বাদ, গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র। তাই এই ৫ প্রকার দেশি সুগন্ধি চালের আলোচনা করা হয়েছে এই আর্টিকেলে।