ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ‘ফসল ডট কম’ এর প্রতিষ্ঠাতা সাকিব হোসাইন এখন ভোল পাল্টে নতুন রূপে অন্তবর্তী সরকারের ‘সহযোগী’ হওয়ার চেষ্টায় আছেন। একসময় পলকের আশীর্বাদে সরকারের নানান সুবিধা নেওয়া সাকিবকে দেখা যাচ্ছে নতুন সরকারের নানান কার্যক্রমে।
আগের সরকারের বিশ্বস্ত কিছু সরকারি আমলার মদদে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সাথে ট্রাকে করে ‘ফসলে’র কৃষিপণ্য বিক্রির নামে সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সাথে সখ্যতার চেষ্টা করছেন এই সাকিব। অথচ গত জুনেই পলকের সহধর্মিণী আরিফা জেসমিন কণিকার উদ্যোগ ‘সেফ’ এর সাথে যুক্ত হয়ে পলকের নির্বাচনী আসনে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় ফসলের ‘ফারমার্স সেন্টার’ চালু করেছিলেন সাকিব।
গত এপ্রিলে পলকের সফরসঙ্গী হয়ে ভ্রমণ করেছিলেন সিঙ্গাপুর। পলকের প্রভাবে ডাক বিভাগের স্পেস ভাড়া নিয়েছেন। সেই সাকিব এখন ফসলের মাধ্যমে অন্তবর্তী সরকারের সাথে ‘সুসম্পর্ক’ তৈরিতে মরিয়া। সূত্র জানায়, বিশ্ব দরবারে অন্তবর্তী সরকারের সাথে সুসম্পর্কের ওপর ভর করে বিনিয়োগ বাগানোই উদ্দেশ্য সাকিবের।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে অনলাইনে কৃষিপণ্য বিক্রির মাধ্যমে ফসল ডট কম শুরু করেন সাকিব হোসাইন। তখন দ্রুত আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ করে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠ হতে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতাকে ফসলের বিনিয়োগকারী বানান সাকিব। এরপর দ্রুতই পলকের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। চলতি বছরের জুনে নাটোরে পলকের নির্বাচনী এলাকা সিংড়ায় ফসলের ফারমার্স সেন্টার চালু করেন সাকিব। এই কাজে তার অংশীজন ছিলেন পলকের সহধর্মিণী আরিফা জেসমিন কণিকা। কৃষকদের উন্নয়নে কাজ করার দাবি করে ‘সেফ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়েছিলেন পলক পত্নী। সেসময় নাটোর, রাজশাহী এবং বগুড়া জেলায় কণিকাকে সাথে নিয়ে ফসলের ফারমার্স সেন্টারগুলো উদ্বোধন করেন সাকিব।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে কণিকা বলেছিলেন, ফসলের সঙ্গে ‘সেফ’ যুক্ত হয়ে কৃষিতে কৃষকের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। এসব ফসল সেন্টার থেকে কৃষকরা সব রকম সুবিধা নিতে পারবে। পাশাপাশি ফসলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, কৃষি প্রযুক্তিভিত্তিক বাংলাদেশি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ‘ফসল ডটকম লিমিটেড’ ও ‘সেফ’ একসঙ্গে যুক্ত হয়ে এবার কৃষকের পণ্য বিক্রির সমস্যা সমাধানে বরেন্দ্র অঞ্চলের নাটোর, রাজশাহী ও বগুড়া জেলায় তিনটি ফারমার্স সেন্টার চালু করেছে।
শুধু তাই নয়, পলকের সফরসঙ্গী হয়ে সিঙ্গাপুরও ভ্রমণ করেন সাকিব। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে সিঙ্গাপুর সফরকালে পলকের সাথে ছিলেন তিনি। সমসাময়িক সময়ে ১০ কোটি টাকার বিনিয়োগ পায় ফসল। গত নির্বাচনের পর পুরো ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর ডাক বিভাগের স্থাপনা ব্যবহারের সুযোগও পায় ফসল তথা সাকিব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘দেশে প্রথমবারের মত’ এমন অজুহাতে বিনা টেন্ডারে ডাক বিভাগের ‘ওয়াক ইন চিলার’ এবং ওয়্যারহাউজ ভাড়া নেয় ফসল। অথচ সরকারি স্থাপনা কাউকে ভাড়া দিতে হলে সাধারণত টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়। তবে গত ১ জুলাই শুধু সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ডাক বিভাগের স্পেস বরাদ্দ পায় ফসল। অভিযোগ আছে, বরাদ্দকৃত স্থানের তুলনায় বেশি স্থান ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে ডাক বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (হিসাব ও সংস্থাপন) এস এম হারুনুর রশীদ বলেন, ফসল চিলার রুমে পণ্য রাখার জন্য ভাড়া প্রদান করে। পাশাপাশি তেজগাও মেইল প্রসেসিং সেন্টারে চিলার রুমের পণ্য লোডিং আনলোডিং এর জন্য প্রয়োজনীয় স্পেসের পাশাপাশি ব্যতীত অতিরিক্ত আরও ৩ হাজার বর্গফুট স্থান ভাড়া ভাড়া নিয়েছে। এজন্য প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ২৫ টাকা। তাছাড়া চিলার রুম চালানোর জন্য যে বিদ্যুৎ খরচ হয় তার বিল ফসল পরিশোধ করে। দেশে এধরনের চিলার প্রথমবারের মত দিচ্ছি আমরা।
অবশ্য পলকের এমন আশীর্বাদপুষ্ট সাকিব এখন অন্তবর্তীকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর ট্রাকে কৃষিপণ্য বিক্রির কার্যক্রম চালু করে টিসিবি। টিসিবি’র সাথে এই কার্যক্রমের অংশীদার ছিল ফসল। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা প্রধান অতিথি হিসেবে এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এই কর্মসূচির পর নতুন সরকারের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করছেন সাকিব।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক সূত্র বলেন, ই-ক্যাবের আগের কমিটির কয়েকজন নেতার মাধ্যমে পলকের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন সাকিব। যে কারণেই পলক পত্নীর সাথে একত্রিত হয়ে তাদেরই এলাকায় ফারমার্স সেন্টার চালু করে সাকিব। পলকের সাথে বিদেশ সফরও করে। এছাড়াও পলক পরবর্তীতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ দায়িত্ব পেলে, পলকের প্রভাবে বেশ কয়েক ধরনের সুবিধা এবং বিনিয়োগ বাগিয়ে নেয়। এখন সেই সাকিব আর ফসল নিজেদের নিরাপদ রাখতে নতুন সরকারের সাথে মিলে কৃষিপণ্য বিক্রির অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। আগের সরকারের সাথে ফসল এবং সাকিবের ঘনিষ্ঠতার তথ্য বর্তমান কিছু সরকারি আমলা উপদেষ্টাদের থেকে গোপন রেখে সাকিবকে সাহায্য করে থাকতে পারে।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ফসলের প্রতিষ্ঠাতা সাকিব হোসাইন বলেন, ৩ মাসের জন্য ডাক বিভাগের থেকে স্থান পেয়েছি। মহাখালীতে এমনিতেও আমাদের ওয়্য্যারহাউজ আছে। ডাক বিভাগের স্পেস স্থায়ীভাবে নিবো কিনা এখনও নিশ্চিত না। তবে ডাক বিভাগের স্থানে ভাড়া বাইরের তুলনায় কম লাগে। আর চিলার সেন্টার অন্য কোথাও না থাকায় ডাক বিভাগের থেকে নেওয়া হয়েছে। চিলার সেন্টারের সামনে অনেক জায়গা খালি থাকে। রাতে পণ্য লোডিং আনলোডিং এর জন্য ৩-৪ ঘণ্টা ব্যবহার করি, জায়গা খালি থাকে তাই ব্যবহার করি। ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলে পলক পত্নীর ‘সেফ’ এর সাথে মিলে ফারমার্স সেন্টার চালু করে উল্লেখ করে সাকিব আরও বলেন, ওনার (কণিকা) মাধ্যমে নাটোরে ফারমার্স সেন্টার করলে, কোন সিন্ডিকেট আমার কিছু করতে পারবে না। এজন্যই আমি আগ্রহী ছিলাম।