চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় বহুল প্রত্যাশিত ক্রস বর্ডার (আন্তঃসীমান্ত) ডিজিটাল বাণিজ্য নীতিমালা-২০২৪। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশে পণ্য ও সেবা আমদানি-রপ্তানি সহজ করার পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্যই এ নীতিমালা প্রস্তাব করা হয়েছে।
নীতিমালাটি দেশের ডিজিটাল বাণিজ্য কাঠামোকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বর্তমানে এটি বাণিজ্য উপদেষ্টার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তার অনুমোদন পাবার পর খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।
প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালায় বেশ কয়েকটি অগ্রগামী পদক্ষেপ উঠে এসেছে, যার মধ্যে অন্যতম— দেশের বিদ্যমান আর্থিক অবকাঠামোর সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেমেন্ট সিস্টেম সংযুক্ত করা, যা ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট সহজ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে চালু হবে একটি ক্রস-বর্ডার এসক্রো সেবা, যা লেনদেনকে আরও নিরাপদ করবে। এছাড়া রপ্তানি আয়ের প্রত্যাবাসন ও নিবন্ধিত ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের আমদানি ব্যয় পেমেন্টের সুবিধার্থে থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা। বিদেশি আয় দেশে আনার জন্যও রয়েছে বিভিন্ন প্রণোদনা।
এছাড়া প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালায় পরিচালনাগত স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আমদানি চালানে ক্রেতার তথ্যের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মার্কেটপ্লেস বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নাম উল্লেখ বাধ্যতামূলক হবে। এ বিষয়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৭-অনুসারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নীতিমালা আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী বাণিজ্য পরিচালনার সুযোগ দেবে, যা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এটি সামগ্রিকভাবে বড় পরিসরে আমদানি-রপ্তানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে উদ্যোক্তাদের বিদেশি বাজারে ব্যবসার সুযোগ বাড়াবে।
নীতিমালাটি একটি সুগঠিত কর ব্যবস্থার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে, যা ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। এর ফলে যেমন বাণিজ্য ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা থাকবে এবং জনগণের বিদেশি পণ্যের চাহিদা সম্পর্কেও সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকবে। আর এসব তথ্যের মাধ্যমে দেশের বাজারের প্রয়োজন মেটাতে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে।
ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্যের জটিলতা নিরসনে খসড়ায় একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এই কমিটিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) প্রতিনিধিরা থাকবেন। তবে নীতিমালায় নিষিদ্ধ পণ্য, অনলাইন জুয়া এবং বাজি সংক্রান্ত লেনদেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) জন্য বিশেষ সহায়তা ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে— সহজ রপ্তানি নীতি, ছোট পার্সেল রপ্তানির জন্য নির্দেশিকা ও ডিজিটাল কমার্স রপ্তানির জন্য আর্থিক প্রণোদনা। এছাড়াও থাকছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রসেসিং সেন্টার ও গুদাম স্থাপনের জন্য নীতিগত সহায়তা, ড্রপ-শিপিং সেবা সহায়তা, বন্দর-সংলগ্ন এলাকায় ডিজিটাল কমার্স এক্সপোর্ট জোন তৈরি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
শিল্প বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই নীতিমালা ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করবে। দারাজ বাংলাদেশের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস রুশো জোর দিয়ে বলছেন, এই নীতিমালা ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্য সহজ করা এবং এটি উদ্যোক্তা-বান্ধব করার ক্ষেত্রে প্রথম কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
দারাজ বাংলাদেশের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার বলছেন, ‘এই নীতিমালাটি সব সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দেবে না, তবে এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য পথ প্রশস্ত করবে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য পেমেন্ট সংক্রান্ত নীতি এবং এনবিআরের জন্য কর সংক্রান্ত নীতি তৈরির পথ সুগম হবে।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, দারাজ আগে ক্রস-বর্ডার পরিষেবার মাধ্যমে সরাসরি চীনা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে বাংলাদেশি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিত। তবে পেমেন্ট সমস্যার কারণে বর্তমানে এই পরিষেবা স্থগিত। তার মতে, নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে বাংলাদেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা সহজেই পণ্য রপ্তানি করতে এবং পেমেন্ট গ্রহণ করতে পারবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের উপসচিব মো. সাঈদ আলী জানিয়েছেন, নীতিমালাটি জানুয়ারিতে চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও কিছুটা দেরি হচ্ছে। এটি জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টার অনুমোদন পেলে খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। আমরা আশা করছি, চলতি ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা যাবে।’
তিনি উল্লেখ করেন, যেহেতু স্টেকহোল্ডাররা খসড়া তৈরির সময় ইতোমধ্যেই নিজেদের মতামত ও পরামর্শ দিয়েছেন তাই নীতিমালাটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা হবে না বলে তিনি আশাবাদী।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা তাই সরকারের প্রতি দ্রুত ক্রস বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্য নীতিমালা অনুমোদনের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশে ক্রস-বর্ডার ডিজিটাল বাণিজ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে এই নীতিমালা। অর্থনৈতিক দক্ষতা, ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি এবং ডাটা-চালিত নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে এটি একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ, যা দ্রুত অনুমোদন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে।