কভিড-১৯ মহামারী বিশ্ববাসীকে স্মরণকালের সংকটে ফেলেছে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব অস্বাভাবিকভাবে ভিন্ন ও মৌলিক কিছু পরিবর্তন এনেছে। এমন পরিবর্তনের অংশ রিমোট ওয়ার্ক সংস্কৃতি ও অনলাইন শিক্ষার প্রচলন। বিশ্বজুড়ে রিমোট ওয়ার্ক ও অনলাইন শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে ভর করে গত বছর ল্যাপটপ ডিভাইস বাজার এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। গত বছরজুড়ে কম্পিউটিং ডিভাইস হিসেবে শুধু ল্যাপটপের সরবরাহ ১৭ কোটি ৩০ লাখ ইউনিটে পৌঁছেছে, যা ২০১৯ সালে সরবরাহকৃত ল্যাপটপের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। ডিভাইস বিক্রিমূল্য বিবেচনায় গত বছর বৈশ্বিক ল্যাপটপ বাজারের আকার ১৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বৈশ্বিক ল্যাপটপ বাজারের ৬৮ শতাংশই দখলে ছিল শীর্ষ তিন ভেন্ডর লেনোভো, হিউলেট প্যাকার্ড (এইচপি) এবং ডেলের দখলে। গত বছর ল্যাপটপ বাজারে ডিভাইস সরবরাহ এবং বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির ল্যাপটপ নির্মাতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে।
কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের বিশ্লেষক মেংমেং ঝ্যাং বলেন, চীনভিত্তিক তৃতীয় সারির ল্যাপটপ ব্র্যান্ড হুয়াওয়ে ও শাওমির উত্থানে দ্বিতীয় সারির ল্যাপটপ নির্মাতা অ্যাপল, আসুস ও এসারের বাজার দখল কমেছে। কভিড-১৯ মহামারী শুরুর প্রথম দিকে ল্যাপটপ বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন করপোরেট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন কার্যক্রম শুরু করলে আকস্মিক ল্যাপটপ ডিভাইসের চাহিদা বেড়ে যায়। চলতি ও আগামী বছরজুড়ে ল্যাপটপের বাড়তি চাহিদা বিদ্যমান থাকবে বলে মতামত দেন তিনি।
তিনি বলেন, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক ল্যাপটপ বাজারে চাহিদা কমতে শুরু করবে। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে চলমান মহামারীর ওপর। কভিড-১৯ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন বাজারজাত শুরু হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হবে। মহামারীর প্রকোপ কমতে শুরু করলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার গতানুগতিক কার্যক্রমে ফিরবে। তখন ল্যাপটপের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা কমবে।
২০১১ সালে বৈশ্বিক ল্যাপটপ বাজারে ডিভাইস সরবরাহ সর্বোচ্চসংখ্যক ইউনিটে পৌঁছায়। একই সময় বিকল্প কম্পিউটিং ডিভাইস হিসেবে স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট ডিভাইসের উত্থান ল্যাপটপ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে সরবরাহ ও বিক্রি কমতে থাকে ল্যাপটপ ডিভাইসের। তবে চীনা ব্র্যান্ড হুয়াওয়ে ও শাওমির উত্থান ল্যাপটপ বাজারে আশার সঞ্চার করে। সাশ্রয়ী দামের কারণে এসব ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ ক্রেতা আকৃষ্টে সক্ষম হয়।
২০১৬ সালে হুয়াওয়ে প্রথম মেটবুক উন্মোচন করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে লো-এন্ড ও হাই-এন্ড ক্যাটাগরির ল্যাপটপ উন্মোচন করে প্রতিষ্ঠানটি, যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। একই বছর শাওমি নিজেদের মি এয়ার ল্যাপটপ উন্মোচন করে।
কম্পিউটিং হার্ডওয়্যার শিল্পের নির্বাহী ও বিশ্লেষকরা বলেন, বর্তমানের পার্সোনাল কম্পিউটারের (পিসি) চাহিদা পূরণে প্রস্তুতকারকরা কয়েক মাস পেছনে রয়েছেন। এ বিষয়ে এসার ইনকরপোরেশনের সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গ্রেগ প্রেন্ডারগাস্ট বলেন, কম্পিউটিং ডিভাইসের পুরো সরবরাহ চেইন এর আগে কখনই এতটা চাপে পড়েনি।
বিশ্বজুড়ে পিসির (ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ) বার্ষিক সরবরাহ সবচেয়ে বেশি ছিল ২০০৮ সালে। সে বছর ৩০ কোটি ইউনিটের বিপরীতে গত বছরের জন্য প্রথমে ২৫ কোটি ইউনিট ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ সরবরাহের কথা বলা হয়েছিল। সুতরাং এ হিসেবে ২০০৮ সালের রেকর্ড ভাঙার আশা ছিল না। তবে কিছু বিশ্লেষক এখন আশা করছেন, গত বছর শেষে পিসির সরবরাহ ৩০ কোটি উইনিট ছাড়িয়েছে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ট্যাবলেটের চাহিদা আরো দ্রুত বাড়ছে।
চলতি বছর বিশ্বজুড়ে ইনস্টলড পিসি ও ট্যাবলেটের সংখ্যা ১৭৭ কোটি ইউনিটে পৌঁছে যাবে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ১৬৪ কোটি ইউনিট ছিল। কভিড-১৯ মহামারীর নতুন বাস্তবতায় পুরো বাড়ির জন্য একটি পিসির বদলে প্রতি শিক্ষার্থী, ভিডিও গেমার ও ঘরে বসে কাজ করা সদস্যদের জন্য একটি করে পিসি কিনতে বাধ্য করেছে।
আকস্মিক এ চাহিদা মেটানোর চাপ পড়েছে হাতেগোনা কয়েকটি পিসি প্রস্তুতকারক সংস্থার ওপর। সংস্থাগুলো সরবরাহ বাড়িয়েছে, শিপিংয়ে গতি বাড়িয়েছে এবং চলতি বছর আরো ভালো মডেল উৎপাদন এবং সরবরাহের প্রস্তুতি নিয়েছে। যদিও এগুলো যথেষ্ট ছিল না।
গ্রেগ প্রেন্ডারগাস্ট বলেন, এসার শিক্ষা খাতের গ্রাহকদের কাছে সরাসরি ল্যাপটপ পৌঁছে দিতে কাজ করছে। নৌ-পরিবহন ও ট্রেনের মাধ্যমে চালান পৌঁছাতে এক মাসের মতো সময় লাগবে। এছাড়া সংযোজনের অপেক্ষায় থাকার জন্য কিছু গ্রাহককে চালান পেতে চার মাস অপেক্ষা করতে হবে।