দীর্ঘ সাত বছর আইনি লড়াই শেষে অবশেষে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন পেল গ্রামীণফোন এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন (জিপিইইউ)। শ্রম অধিদপ্তরের শ্রম মহাপরিচালক শিবনাথ রায় বৃহস্পতিবার দুপুরে সংগঠনটির কাছে এই নিবন্ধনপত্র হস্তান্তর করেন। এসময় ইউনিয়নটির প্রতিষ্ঠাতা নেতা মো. ওমর ফারুক, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলুল হক, সাধারণ সম্পাদক মিয়া মো. শফিকুর রহমান মাসুদসহ সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
২০১২ সালে রেজিস্ট্রেশনের আবেদন দাখিলের পর শ্রম অধিদপ্তর তা প্রত্যাখ্যান করলে শুরু হয় আইনি লড়াই। শ্রম আদালত, শ্রম ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্টের আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত বৃহস্পতিবার শ্রম মহাপরিচালক কর্তৃক স্বাক্ষরিত রেজিস্ট্রেশনের কপি ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন জিপিইইউ সাধারণ সম্পাদক মিয়া মাসুদ। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার শ্রম মহাপরিচালক শিবনাথ রায় রেজিষ্ট্রেশনের কপি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। তিনি জানান, রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর ইউনিয়ন নেতারা গ্রামীণফোন সদর দপ্তরে সভা করে।
সভায় গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলি নরওয়ে থেকে এক ভিডিও বার্তায় ইউনিয়নের সদস্যদের অভিনন্দন জানান এবং একসঙ্গে কাজ করার আহবান জানান এবং ডেপুটি সিইও ইয়াসির আজমান বলেন, ইউনিয়ন ও ম্যানেজমেন্ট একসঙ্গে কাজ করলে কোম্পানির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি বাড়বে।
জিপিইইউর রেজিস্ট্রেশন প্রদানকে সরকারের নীতিগত ঐতিহাসিক সাহসী সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে সংগঠনটির নেতারা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানসহ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়। নেতৃবৃন্দ শ্রম মহাপরিচালকসহ শ্রম অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের মে মাসে অন্তত ২৫০ কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গ্রামীণফোন। তখন এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে এর কর্মীরা। আর সে সময়ই জন্ম হয় জিপিইইউ নামে এই সংগঠনের। জিপিইইউ গঠন হয় ২০১২ সালের ১৪ জুন। ২৩ জুন নিবন্ধনের জন্য শ্রম পরিচালকের কাছে আবেদন করে সংগঠনটি। রেজিস্ট্রেশনের দরখাস্ত দাখিলের পর শ্রম অধিদফতর তা প্রত্যাখ্যান করলে শুরু হয় আইনি লড়াই।
শ্রম পরিচালক আবেদন বাতিল করে দেন ২৯ জুলাই। এর বিরুদ্ধে একই বছরের ২৬ আগস্ট ২ নং শ্রম আদালতে আপিল করে ইউনিয়ন। এরপর আপিলের শুনানীতে বিব্রত বোধ করায় ২০১৪ সালের শেষে নাগাদ বিচারক মামলাটি শ্রম আপিল ট্রাইবুনালের পঠিয়ে দেন। সেখানে আবেদন করা হয় শুনানীরর জন্য।
২০১৫ সালের শুরুরে দিকে ইউনিয়ন নিজেদের পক্ষে রায় পায়। এতে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ ১৫ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্ট তা আবার ট্রাইবুনালে অন্য বিচারকের আদালতে ফেরত পাঠায়। ট্রাইবুনাল হতে এটি যায় ১ নং শ্রম আদালতে। সেখানে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষের পক্ষে রায় দেন শ্রম আদালত। এরপর এই রায় নিয়ে ইউনিয়ন আপিল ট্রাইবুনালে আবেদন করে।
মামলাটিতে জিপিইইউ-এর পক্ষে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মিয়া মাসুদ এবং বিপক্ষ শ্রম পরিচালক। গ্রামীণফোন আপীল মামলা নং- ৪৩/২০১৫।২০১৬ সালের জুনে গ্রামীণফোন এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের (জিপিইইউ) নিবন্ধনের আপিল মঞ্জুর করেন শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দ্বৈত বেঞ্চের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুল হুদা এবং সদস্য বিচারক গোলাম রব্বানি জিপিইইউ-এর পক্ষে রায় দেন।
আদালত ইউনিয়নের নিবন্ধন চাওয়ার আবেদন গ্রহণ করে শ্রম পরিচালককে নিবন্ধন দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এই রায়ের নকল পেতে তাদের প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় লেগে যায়। রায়ের সার্টিফাইড কপি পেতে জিপিইইউয়ের পক্ষে ৬ বারের বেশি আবেদন করলেও তারা কোনো কপি পাননি।
শেষে জিপিইইউয়ের পক্ষে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয় (১৭১৯৭/২০১৭)। রিটের শুনানি শেষে আদালত এক মাসের মধ্যে রায়ের কপি প্রদানের জন্য শ্রম আপিল ট্রাইবুনালকে নির্দেশ দেন। অবশেষে ২০১৮ সালের ৯ জানুয়রি রায়ের কপি মেলে। এরপর ১০ জানুয়ারি রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়নের কাছে রেজিস্ট্রেশন প্রদানের জন্য আবেদন করে সংগঠনটি।
এরপর ৭ দিনের মধ্যে নিবন্ধন সার্টিফিকেট দিতে আদালতের রায় থাকা প্রায় এক মাস সময় গেলেও শ্রম অধিদপ্তর হতে নিবন্ধন পাচ্ছিল না তারা। এবার অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে শ্রম আপিল ট্রাইবুনালে আদালত অবমাননার মামলা (১/২০১৮) করেন তারা। অবশেষে সাত বছর ধরে শ্রম আদালত, শ্রম ট্রাইবুনাল এবং হাইকোর্টের আইনি প্রক্রিয়া শেষে ৭ মার্চ ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন হাতে পায় জিপিইইউ।
উল্লেখ্য, শ্রম আইন অনুয়ায়ী কোম্পানির লভ্যাংশ হতে ৫ শতাংশ করে কর্মীদের প্রদানের দাবি আদায় সংগঠনটির অন্যতম সফলতা। ২০১৩ সালে ইউনি গ্লোবাল ইউনিয়নের ফ্রিডম ফ্রম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পায় সংগঠনটি। ২০১৫ সালে সংগঠনের অগ্রগতি ও সদস্যদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে ইউরোপভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউনি গ্লোবাল ইউনিয়নের বেস্ট অর্গানাজিং অ্যাওয়ার্ডও পায় জিপিইইউ।