জামদানি শালের গল্প জানতে আপনাকে পাহাড়ে যেতে হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে জামদানি শাল শুনলেই মাথায় সবার আগে আসে নিশ্চিত জামদানী শাড়ির মতন বুঝি কিছু একটা। কিন্তু মোটেও তেমনটা না। জামদানী শাল বানানো হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে আর শাল তৈরির কারিগর হচ্ছেন চাকমা মেয়েরা।
দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন সনদ পেয়েছে জামদানি। কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
জামদানী শাল তৈরি হয় উল দিয়ে। এই শাল তৈরির সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাম। বাংলাদেশের নৃ গোষ্ঠীর রয়েছে সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি। আপনাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করবে তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৪৫টি। আর তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চাকমারা। তাদের শিল্প, সংস্কৃতি আর মননশীলতা বাঙালিদেরও মুগ্ধ করে। তাদের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতার চিত্র ফুটে ওঠে তাদের পোশাকেও।
এই যেমন শীত শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে তারা শীতের প্রস্তুতি নেয়। কারণ পাহাড়ে শীতটা একটু আগে পরে সমতলের তুলনায়।
আমরা জানি জামদানী শাল তৈরি কারিগর মূলত চাকমারা। চাকমা মেয়েরা তাদের নিত্যদিনের কাজের পর অবসরে তৈরি করেন এই শাল। কয়েক বছর আগেও আদিবাসী বস্ত্রশিল্পের উপাদান যেমন তুলা জুম ক্ষেতে উৎপাদিত তুলা ও প্রাকৃতিক উপকরণ থেকে পাওয়া যেত। এখন নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাংলাদেশের সমতলে অবস্থিত বাঙালিরা তাদের কোমড় তাঁতে তৈরি এই ঐতিহ্যবাহী শালগুলো পছন্দ করেন, তাই তারা বাজার থেকে কেনা মিলের সুতো আর রঙ কিনে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রস্তুত করে নিজেরদের কাজের উপযোগী করে তৈরি করতে।
জামদানী শাল তৈরিতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগে। প্রথমে বাজার থেকে উল কিনে সেই উলে রঙ করা হয় তারপর শুকিয়ে মাড় দেয়া হয়। অতঃপর কোমড় তাঁত যেটাকে চাকমা মেয়েরা “বেইন” বলে; তাতে সুনির্দিষ্ট সুতার কাউন্টের মাধ্যমে শালটির পাড়ে থাকে ১৪০কাউন্ট আর জমিনে থাকে ৩০০ কাউন্ট এর সুতো। শালের এপিঠ ওপিঠ এর বুনোন একই রকম শুধু জামদানীর নকশাটা একদিকে থাকে। পাড়ে জামদানীর নকশা আর জমিনে ছিটা থাকে চতুর্ভূজ ডিজাইনের। সেটাও মূলত দেখতে জামদানী মোটিফের মতনই মনে হবে আপনার।
জামদানী যেমন বাঙালিদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের একটা অংশ তেমন আমাদের দেশের আদিবাসীরা সেই ঐতিহ্যের অংশটাকে তাদের ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে চমৎকার একটা শাল উপস্থাপন করেছেন।
লেখক, জান্নাতুন নাহার লিয়া
সত্ত্বাধিকারী
নৃ বাংলাদেশ
নৃ বাংলাদেশ ফ্রেম,
নৃ বাংলাদেশ পরিব্রাজক