বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বাড়ছে নারীদের পদচারণা। কোন দিক থেকেই নারীরা পিছিয়ে নেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনালগ্নে তারা নানা খাতে দেশ ও দেশের বাইরে কাজ করে সাফল্য বয়ে আনছেন। উদ্যোক্তা খাতেও নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে অন্যান্য উন্নত অনেক রাষ্ট্রের তুলনায় নারী ব্যবসায় মালিকানা বাংলাদেশে বেশি। নারী উদ্যোক্তাদের বৈশ্বিক সূচকের হিসেবে বর্তমানে ৩৬.১৪ শতাংশ নারী দেশের শ্রমবাজারে কর্মরত। আনুষ্ঠানিক খাতে ৯ শতাংশ এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন প্রায় ৯১ শতাংশ নারী। একই সাথে দেশিপণ্যের প্রতি নারীদের আগ্রহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ব্যাপক হারে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আরেক বড় অগ্রগতি এনেছে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করা। এছাড়া ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাত দেশে প্রসারিত হচ্ছে। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। বেসরকারি সমীক্ষা বলছে, দেশে ব্যবহারকারী ৩ কোটি ৫৮ লাখেরও বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে। গড়ে উঠেছে এফ-কমার্স বা ফেসবুকভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসা।
স্বামী, সংসার, সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশিও উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব সঠিক নিয়মানুবর্তিতা এবং সদিচ্ছা থাকলে। তেমনই একজন হলেন কাকলী’স অ্যাটায়ারের স্বত্বাধিকারী-কাকলী রাসেল তালুকদার। বাংলাদেশের বিখ্যাত পণ্য জামদানী নিয়ে কাজ করছেন তিনি এবং জামদানীশিল্পকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, “আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের মনে রাখা উচিত যে কোনো উদ্যোগ বা ব্যবসা আর সব কাজের মতোই একটি সিরিয়াস বিষয়, শখের কাজ নয়। তাই আমাদের সময় দিতে হবে প্রতিদিন এবং এদিকে যতটা সম্ভব শেখার দিকে মন দিতে হবে। এটি সাময়িক কোন কাজ নয় বরং লম্বা সময় টিকে থাকার মানসিকতা থাকতে হবে। অল্পতে হতাশ হলে হবে না। যতটা সম্ভব এ বিষয়ে জানতে হবে শিখতে হবে এবং সাহসীকতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে।”
২০২০ সালে করোনাকালীন ই-কমার্স উদ্যোক্তা বেড়েছে। বেড়েছে দেশিপণ্যের প্রতি মানুষের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আকর্ষণ। ফলে ই-কমার্স-ভিত্তিক উদ্যোগে আগ্রহী হচ্ছেন নারীরা। এই আগ্রহের কারণ দেশিপণ্যের কাঁচামাল সহজলভ্য, জেলা ব্র্যান্ডিং পণ্যগুলো নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়ার সুযোগ, অর্থনীতিতে পরোক্ষ/প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখার সুযোগ ইত্যাদি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে চলা পণ্য। টাঙ্গাইলের খেশ, ঢাকাই জামদানী, সাতক্ষীরার মাদুর, রংপুরের শতরঞ্জি, সিলেটের শীতলপাটি, মুক্তাগাছার মন্ডা, পাবনার ঘি, শেরপুরের তুলসীমালা চালসহ হাজার রকমের পণ্য নিয়ে কাজ করছেন বর্তমানের নারী উদ্যোক্তারা।
বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এবং বেশিরভাগের কাছেই নতুন এমন দেশিপণ্য নিয়েও কাজ করছেন দেশের নারীরা। যেমন আরিয়া’স কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নিগার ফাতেমা। তিনি দেশের টাঙ্গাইল জেলার বিখ্যাত খেশপণ্য নিয়ে কাজ করছেন এবং খেশের বিভিন্ন ফিউশন-ভিত্তিক কাজও করছেন। তিনি বলেন, “আমি একজন দেশিপণ্যের উদ্যোক্তা হিসেবে বলতে চাই, বাংলাদেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে দেশিপণ্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং নারী উদ্যোক্তারাই পারবে দেশিপণ্যকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। স্বামী, ঘর, সংসার সামলে নারী উদ্যোক্তারা পরিশ্রম করে যাচ্ছে এবং আয় করছে। সংসার ও অর্থনীতির হাল ধরছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু চাকরির বাজারে নয়, বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন”
নারী উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ গ্রহণে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়। মূলধন এখনও প্রধান প্রতিবন্ধকতা। সরকারিভাবে ব্যবসায়িক অনুমতি অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্স, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিন), ঋণসুবিধাসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টেশনের শর্ত পূরণে নানানভাবে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারী উদ্যোক্তাদের। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা ও প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আর্থিক সহায়তা-ঋণসুবিধা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ১০শতাংশ হারে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক। দেশিপণ্যের উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারিভাবে এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি পেলে এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আরো এগিয়ে যাবে নারী উদ্যোক্তারা। এগিয়ে যাবে দেশিপণ্য, সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন নারী শুধু চাকরির বাজারে নয়, বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারহানা এ রহমান বলেন, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আরো সামনে এগিয়ে নিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বেসিস। তারই ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বলেই ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। আমি আশা করছি আগামীতে নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এভাবেই আস্তে আস্তে স্বাবলম্বী হবে নারীরা।
অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগে বস্ত্র, গয়না, সাংসারিক পণ্য, শিশুখাদ্য, প্রসাধনীর আধিক্য দেখা গেলেও সীমিতসংখ্যক সেবা ও প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। এই মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক বেশি উপস্থিতি লক্ষণীয়। একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায় যে সামাজিক, পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বলে অনলাইন উদ্যোগে নারীদের এই স্বচ্ছন্দ পদচারণা।
বাংলাদেশে গত ক’বছর ধরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ফেসবুকভিত্তিক অনেক পাতা তৈরি হয়েছে, যেখানে নানা ধরনের পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে। এসব পণ্য ক্রেতা-বিক্রেতাদের বেশিরভাগই নারী এবং যাদের অনেকে ছাত্রী বা গৃহবধূ।
করোনা মহামারী পরিস্থিতির কারণে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে আমাদের দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবন। ভাইরাসটির ভয়াল থাবায় স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে প্রায় বছরজুড়ে। যদিও অনলাইনের মাধ্যমে একাডেমিক কার্যক্রম চলছে তবুও সেশন জট নিয়ে উদ্বিগ্ন বেশিরভাগ অনার্স, মাস্টার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে উদ্বিগ্ন ভবিষ্যত কর্মজীবন নিয়ে। আর তাই সময়কে কাজে লাগিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি এখন অনেকেই নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সেই প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখছে ই-কমার্সের হাত ধরে। পুরো দেশে এখন সেই সফলতার হাতছানি। শুধু কি শিক্ষার্থী? না, একজন গৃহিনীও স্বামী, সংসার, বাচ্চা সামলে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে দৃঢ় মনোবল নিয়ে। আর সেই মনোবল আরো বাড়িয়ে দিয়েছে নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। উই এর হাত ধরে বয়স এবং একইসঙ্গে নারী-পুরুষ ভেদাভেদের তোয়াক্কা না করে অসংখ্য আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী নারী বেছে নিয়েছেন উদ্যোক্তা জীবন। যার মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশ বড়।
ভেঞ্চাচার ক্যাপিটাল রিসার্চ ডেটাবেজ পিচবুক থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ একটি পরিসংখ্যান (২০১৯) বলে, পৃথিবীর মাত্র দুই শতাংশ নারীর কাছে তাদের ব্যবসা পরিচালনার মূলধনটি থাকে। যেখানে পুরো পৃথিবী দিচ্ছে প্রতি ১০০জনে ২জন উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পরিসংখ্যান, সেখানে বাংলাদেশের চিত্রটি আশার আলো দেখায়। বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ নারী। নারী উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধান বাধা হিসেবে যেটি বিবেচনা করা হয় তা হলো, আমাদের সংস্কৃতি। যেখানে আমরা নারীকে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায় দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু সময় পাল্টেছে, বাস্তবতা এখন ভিন্ন। ৩০ বছর আগের বাংলাদেশের অর্থনীতি আর ২০২০-এর অর্থনীতির হিসাব ভিন্ন। এখন পারিবারিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী তাঁর সত্তাকে এই সমাজে সফলভাবে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম।
বাংলাদেশ এখন ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাপড়, রূপসজ্জা বা গৃহসজ্জা ও বিভিন্ন পদের খাবারসহ নানা উপকরণ। নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের অনলাইন প্লাটফর্ম উই, যা এখন দেশের ৬৪ জেলার ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের অন্যতম ভরসার প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে। অনলাইন প্লাটফর্মটিতে দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে।
দেশীয় ঘরানার হাতে তৈরি গয়না নিয়ে কাজ করছেন “রূপস হ্যাভেন”-এর কর্ণধার মেহজাবীন রাখী। বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় একজনকে। প্রথমেই যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সেটি হলো প্রয়োজনীয় ও সঠিক ধারণা ও তথ্য পাওয়া। “আমি যখন শুরু করি তখন প্রধান সমস্যা ছিল প্রয়োজনীয় ও সঠিক তথ্য পাওয়া।”দেশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করতে বেছে নিতে পারেন দেশীয় গহনা ।
কাকলী রাসেল তালুকদারকে এখন অনেকেই চেনেন ‘জামদানি রানি’ হিসেবে । শুরুতে কাকলী রাসেল তালুকদারকে কেউ চিনতেন না। অনলাইন ব্যবসায়ে ব্র্যান্ডিংয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচিতর বিষয়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে জরুরি হলো একটি কাজের দক্ষতা এবং সে-বিষয়ক বিস্তর জ্ঞান। প্রতিদিন পড়তে হয় জানতে হয়। হঠাৎ ধারণা ছাড়া কোনো ব্যবসা নিয়ে নেমে গেলে সেখানে সফল হওয়া কঠিন, হতাশ হতে হয়। কাজ নিয়ে প্রচুর পড়াশুনার এবং নিজের দক্ষতা উন্নয়নের চেষ্টা করে চলেছি।
বগুড়ার মেয়ে জারিন তাসনিম। বিএসসি শেষ করেছে্ন কম্পিউটার সায়েন্স থেকে। পড়াশোনা চলাকালীনই ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পার্টনার ওয়ারেসা মোস্তফা জয়কে নিয়ে শুরু করেন নিজেদের উদ্যোগ জেএনজে। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রত্যয় ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। আর সেই প্রত্যয়েই পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের উদ্যোগ জেএনজেকে নিয়ে পথচলা শুরু। অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েও তারা কেউই পিছপা হননি। তাই আজ শুধু নিজেরাই স্বাবলম্বী নন। তাদের পাশাপাশি আরও ১০ জন মানুষকে তারা স্বাবলম্বী করেছেন। জারিন এবং জয় কাজ করছেন হোম ডেকর পণ্য এবং পোশাক নিয়ে। করোনাকালীন উই’কে পেয়ে তাদের অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। তারা দুজনেই সম্মিলিতভাবে লাখপতির খাতাতেও নাম লিখিয়েছেন।
লেখাপড়া শেষ করে ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও শারমিন সাঈদ অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে হয়েছেন উদ্যোক্তা। নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে ফেজবুকে চালু করেন ইনোভেটিক ফ্যাশন পেজ। বিক্রি করেন মুন্সিগঞ্জের ২০০ বছরের ঐতিহ্য পাতক্ষীর, ব্লকের শাড়ি, তাঁতের শাড়ি- থ্রি পিস, নিজের ডিজাইনার কুর্তি। মুন্সিগঞ্জ থেকে উদ্যোগ পরিচালনা করায় কাঁচামাল সংগ্রহ, কুরিয়ার জটিলতা এবং ব্যবসায় দিনের পর দিন লস দিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। তখন ফেসবুকে সন্ধান মিলে দেশিপণ্যের উদ্যোক্তাদের প্লাটফর্ম উই গ্রুপের। এখানে কোন প্রকার বুস্ট বা খরচ ছাড়া শুধু পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং দিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন তিনি।
বগুড়ার শিক্ষার্থী এবং উদ্যোক্তা সিরাজুম মনিরা স্নিগ্ধা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত। পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করার ইচ্ছা থেকেই ২০১৮ সালে ‘আটপৌরে’ নামে একটি পেজের মাধ্যমে বিদশি পোশাক বিক্রির মাধ্যমে নিজ উদ্যোগের যাত্রা শুরু। কিন্তু খুব বেশিদিন সেই পণ্য নিয়ে কাজ করতে পারেননি। দেশীয় পণ্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি কাজ শুরু করেন ব্লকের পোশাক নিয়ে। তবে বর্তমানে এর সাথে আরও যুক্ত হয়েছে কুশিকাটার পণ্যসহ, হাতের কাজের পোশাক। এই মুহূর্তে চার জন কর্মী রয়েছে তার। তিনি চান চাকরির বাজারে না ঘুরে সেই সময়টা নিজ উদ্যোগে দেওয়ার মাধ্যমে নিজের পাশাপাশি আরো কিছু পরিবারে স্বচ্ছলতা এনে দিতে।
২০০৮ সালে অর্থনীতিতে অনার্স শেষ করে উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেন আসমা হক কান্তা। প্রকৃতির খাঁটি জিনিস দেওয়ার নিশ্চয়তায় প্রতিষ্ঠা করেন ধবল। যার (ধবল) অর্থ সাদা, কালিমা নেই, সব শুদ্ধ। প্রথমে গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে শুরু হলেও পরে যোগ করে আচার, সরিষার তেল, ঘি, নারকেল তেল, পিঠা, স্ন্যাকস, মসলাসহ আরো কিছু দেশীয় পণ্য। করোনাকালীন ব্যবসার গতি কমলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেয়নি উই। কান্তা বলেন, নানান চড়াই-উৎরাই পার করে ১৫ জন মানুষের কর্মসংস্থান ও কাস্টমারের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। মেয়েদের ব্যবসা করতে আমাদের সমাজে অনেক বাঁধা। এর মধ্যে অন্যতম সাধারণ মানুষের মানসিকতা। মানুষরা সরাসরি বলে, ‘তুমি পারবে না। আর ব্যবসা মেয়েদের জন্য না।’ আমার মতে, নারীদের উদ্যোক্তা কাজে মানুষের সহযোগিতার হাত নাও থাকতে পারে, কিন্তু বাঁধা না দিক তাহলেই মেয়েরা এগিয়ে যাবে।
সামিরা, কাকলী, জারিন এবং শারমিনের মতো আরো হাজারো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারাদেশের আনাচে কানাচে। কেউ কাজ করছেন হাতে তৈরি গহনা নিয়ে আবার কেউ কাজ করছেন হ্যান্ড পেইন্টেড পোশাক নিয়ে। এছাড়া রান্না করা খাবার, মিষ্টান্ন, শিশু, নারীদের হাতের কাজের পোশাক, গৃস্থালীপণ্য প্রাধান্য পেয়েছে অনেকের উদ্যোক্তা জীবনে। নিজেদের ভাল লাগার কাজকে গুরুত্ব দিয়ে সেই কাজ সম্পর্কিত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলেছেন এসকল উদ্যক্তারা।
করোনা মহামারির শুরু থেকে অনেক বেশি নারী সম্পৃক্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোগ নিয়ে। আর দেশিপণ্যের উদ্যোক্তা এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় প্লাটফর্ম উই। উই গ্রুপের কল্যাণে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে হাজারো নারী। গ্রুপে দেশিপণ্য বিক্রি করে লাখোপতি হয়েছেন হাজারো নারী। এই ধরনের নারী উদ্যোক্তাদের সফল ব্যবসায়ী হতে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছে উই। এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের দিকে সম্মান, সহযোগিতার হাত যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি প্রশিক্ষণ, উত্তরোত্তর উন্নয়ন ইত্যাদির এক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের স্বকীয়তা আর পণ্যের মান।
উই বিষয়ে প্লাটফর্মটির উপদেষ্টা এবং ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ বলেন, উই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের বিশ্বস্ত একটি প্লাটফর্ম হলেও এর পরিধি আরো অনেক বেশি বিস্তৃত। কারণ তারা দেশিপণ্য বিক্রি করেন অনলাইনে। দেশিপণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির ভিত উইয়ের হাত ধরে খুব অল্প সময়ে দৃঢ় হয়ে উঠেছে। উই ই-কমার্সে জড়িত নারী উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় অনলাইন প্লাটফর্ম কোনো সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, গত ছয় বছরে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি যে মানসম্মত লেখাপড়া এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। উইয়ের মাধ্যমে দেশিপণ্য দেশের পাশাপাশি প্রবাসীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অনেক প্রবাসী এখন বাংলাদেশে থাকা তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে উইয়ের উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যের ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন।
উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এই তিন সফল ব্যবসায়ী সহায়ক হিসেবে পাশে পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম ‘উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম’ বা উই,। এইধরনের হাজারো নারী উদ্যোক্তাদের সফল ব্যবসায়ী হতে সহায়ক ভুমিকা রেখে চলেছে উই । দেশের অর্থনীতিতে নারীদের আর্থিক অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কাজ করা সংগঠন প্ল্যাটফর্ম ‘ওমেন অ্যান্ড ই কমার্স ফোরাম’(উই) এর সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, আমি প্রথমে সকল নারী উদ্যোক্তাদের শুভেচ্ছা ও অভিন্দন জানাতে চাই আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবসের । দেশের সকল নারী উদ্যোক্তাদের সামনে এগিয়ে আসার আহবান করছি । যে সৎ থেকে এবং ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেনা সে কখনোই সামনে এগোতে পারবে না এবং ধৈর্য অনেক বড় একটা গুণ যে ধৈর্যের সাথে এগিয়ে যাবে সেই সামনে সাকসেস হবে । এই ব্যাপারগুলো উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনে আসল বিষয় যেগুলো আমাদের নারীদের খেয়াল রাখতে হবে ।
তিনি আরো বলেন, আমি যে কাজ হাতে নেই, সেটার সাথে সততা থাকে, থাকে আন্তরিক চেষ্টা। যেটা আমি পারবো না, সেটা আমি কখনোই নেইনা এবং নিজের কাজ অন্যের উপর ও চাপিয়ে দেইনা। সব নারীদের জন্য এটাই আমার বার্তা। সৎ থাকুন, অন্যকে সৎ থাকতে সাহায্য করুন। আপনার একার জন্য সমগ্র নারী সমাজের নাম যেন খারাপ না হয় ।