পার্বত্য এলাকার এক সময় নাম ছিলো কার্পাস মহল। কারন এই পাহাড়ী এলাকায় জুমে প্রচুর পরিমান তুলা উৎপাদন হতো। কথিত আছে এক সময় এই এলাকার প্রজারা রাজা বাহাদুরের খাজনা আদায় করতেন এই তুলা দিয়ে।
একটা সময় ছিলো যখন পার্বত্য এলাকার প্রতিটি ঘরে কোমর তাত ছিলো। নারীরা জুম থেকে তুলা সংগ্রহ করে সেই তুলা থেকে সুতা তৈরী করত। সেই সূতায় রং লাগিয়ে রোদে শুকিয়ে নিতো।
সেই সুতা দিয়েই নিজেরা তৈরী করত নিজেদের সব ধরনের পরিধেয় বস্র। তার মধ্যে তাদের পিনন হাদি, বিভিন্ন রকম শাল সব কিছুই নিজেরাই করত। এই তূলা থেকে সূতা তৈরী, সূতায় রং করা তারপর তার থেকে কাপড় তৈরীর যে পদ্ধতি তা এখনো দেখা যায় চাকমা এবং মারমা সম্প্রদায়ের পবিত্র কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে। সেখানে তুলা থেকে সূতা, সুতা রঙ করা, কাপড় তৈরী পুরো প্রক্রিয়া শেষ করা হয় মাত্র ২৪ঘন্টায়।
এক সময় এমনও ছিলো পাত্র পক্ষ কনে দেখার সময় জানতে চাইতো পাত্রী হাতের কাজ জানে কিনা? আর অবস্থা সম্পন্ন ঘরের মেয়েদের যখন ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যেতো তখন তাদের নানীরা পাত্রীর সাথে তার শ্বশুরবাড়ী চলে আসতেন নাতনীকে হাতের কাজ শিখানোর জন্য।
জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে জীবন জীবিকার জন্য তুলা চাষ বন্ধ করে অন্যান্য ফসলের চাষ শুরু হয়। তাতে তুলার চাষ কমে যায় অনেক। তখন পাহাড়ী নারীরা পুরানো সোয়েটার সংগ্রহ করে তার থেকে উল খুলে শাল বানানো শুরু করে। এখনো কিছু কিছু এলাকায় এই পদ্ধতি দেখতে পাওয়া যায়।
বর্তমানে উলেন সুতা অনেক সহজলভ্য হওয়ায় নতুন সুতা কিনে সেই সুতা দিয়েই তৈরী করা হয় শালগুলো যার জন্য রং থাকে ঝকঝকে। আমরা যে শালগুলো এখন দেখি সেগুলো বংশ পরম্পরায় বুনে আসছেন পাহাড়ী নারীরা।
তাতীদের সাথে কথা বলে আর সরেজমিনে গিয়ে যা জানলাম এনা মারমা জানান “একটা শাল বুনতে একজন যদি সারাদিন অন্য কোন কাজ না করে শুধু শালই বুনে তাহলেও কমপক্ষে ৩/৪ দিন সময় লাগে।”
এলটি চাকমা বলেন “শালের দামটা যদি বেশী পেতাম তাহলে আমরা আরও উৎসাহবোধ করতাম।”
রানু চাকমা জানান “আগে যারা শাল বুনতো সেটা ছিলো খুব নিখুঁত এবং সেই বুননে সময় লাগে অনেক বেশী কিন্তু সেই তুলনায় সঠিক মূল্য পায়না। তাই এখন হালকা কাজের দিকে সবার ঝোক বেশী। তাতীরা যদি তাদের শ্রমের ন্যুনতম মূল্য পায় তাহলে আবারও এই কোমর তাত শিল্প চাংগা হয়ে উঠবে।”
জিংপারময় বম জানান “আমরা যারা প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করি এখানে প্রয়োজনের সময় শাল বুনার জন্য পর্যাপ্ত সূতা পাইনা তাই আমাদের অনেক দূর থেকে সূতা এবং অন্যান্য উপকরন সংগ্রহ করতে হয় তাই আমাদের খরচ বেশী পড়ে যায়।”
এই যে ৩/৪দিন সময় একজন তাতী একটা শাল বুনার পিছনে ব্যয় করে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা এই শ্রমের মূল্যটুকু ধরেনা। তারা শুধু কত খরচ হলো নগদ সেটা হিসাব করে মূল্য নির্ধারন করে থাকে।
বর্তমান যে পরিস্থিতি চলছে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে যা দেখেছি Women e-Commerce Forum উই এর যে দেশী শালের ওয়েভ চলছে সেটি শুরু না হলে তাতীদের এত শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে যে শালগুলো তারা তৈরী করেছিলো সেগুলো তারা যেই টাকায় সুতা কিনেছিলো সেই টাকাও উঠে আসতো না। কারন অন্যান্য বছরের তুলনায় টুরিস্ট নাই এই সময়ে। তাই অনলাইনেই বিক্রি অনেক অনেক বেশী।
উই এর দেশী শালের ওয়েভের কারনে পাহাড়ী নারী তাতীদের সব শাল বিক্রিতো হয়েছেই এবং অগ্রিম টাকা দিয়ে অর্ডার করতে হচ্ছে। আমি এই নারীদের সাথে মিশে তাদের সহজ সরল হাসিমাখা মুখগুলো যখন দেখি তখন মনের অজান্তেই বলে উঠি জয় হউক উই এর। ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি উই এর প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার নিশা আপুর এবং এই দেশী শাল ওয়েভের যিনি প্রবক্তা আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় রাজীব আহমেদ স্যারের প্রতি।
শিরীন সুলতানা অরুনা
রাংগামাটি থেকে