কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থানার চান্দিশকরা গ্রামের মেয়ে নুসরাত জাহান। জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে উঠা,লেখাপড়া সবই কুমিল্লায়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধিনে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন ২০১৬ তে। সংসার জীবন শুরু হয় ২০১৩ তে। ২০১৪ তে প্রথম মা হন তিনি। মা হবার ঠিক ৪ মাস আগে তার বাবা দেশের বাহিরে মারা যান। বাবাকে হারিয়ে ভীষণ একা হয়ে পরেন তিনি । একটা সময় যে মানুষ গুলো সমালোচনা করেছে আজ তারাই এখন পরিচয় দিচ্ছে খুবই গর্বের সাথে। আর্থ-সামাজিক স্বচ্ছলতা উদ্যোক্তা হওয়ার পথে একজনের যাত্রাকে সহজ করে দেয়। তবে কোনো ধরনের সমর্থন ছাড়াও যে কেউ উদ্যোক্তা হতে পারেন বলে মনে করেন নুসরাত কিচেন এর ত্বাধিকারী ও তরুণ উদ্যোক্তা নুসরাত জাহান । “একজনের অর্থনৈতিক-সামাজিক স্বচ্ছলতা না থাকতে পারে, কিন্তু যখন তার একটা বড় স্বপ্ন আছে, তিনিও সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সমান সম্ভাবনা রাখেন।”
টেকজুম: উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু কিভাবে?
নুসরাতঃ ২০১৪ তে বাবা মারা যায় আর সেই থেকেই অনেক একা লাগতো। ছেলে হবার পর সারাদিন সংসারের কাজ শেষে একা একা বসে থাকতাম। সেই সময় চিন্তা করতাম অবসর সময়কে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। সেই সময় কুমিল্লা গুটি কয়েকজন উদ্যোক্তা অনলাইনে শাড়ি, ড্রেস,জুয়েলারি নিয়ে কাজ করতো। আমি দেখলাম খাবার ছাড়া প্রায় সব কিছুই আছে। আর তাই আমি ২০১৭ সালের মার্চে আমি অফলাইনে নুসরাত কিচেনের কাজ শুরু করি।
টেকজুমঃ ক্যারিয়ারে ই-কমার্স কেন বেছে নিলেন?
নুসরাতঃ আমি চাইতাম এমন কিছু করবো যাতে করে আমার বাচ্চা সংসার সব ঠিক থাকে। আর তাই ই-কমার্স কে বেছে নিয়েছি। আমি চাকরী করলে বের হতে হবে তাই চাকরির পক্ষে ছিলাম না কখনই। আর ই-কমার্স বিজনেসের ফলে ঘরে বসেই বাচ্চা সামলিয়ে কাজ করা যায়।
টেকজুম: কি কি পণ্য বিক্রি করেন?
নুসরাতঃ আমি হোম মেইড খাবার নিয়ে কাজ করি। কুমিল্লাতে আমিই প্রথম অনলাইন ক্যাটারিং চালু করি। আমার মেন্যুতে বিরিয়ানি, কেক, ডেজার্ট, স্ন্যাকস, ফ্রোজেন ফুড, পিঠা সহ সব রকমের খাবার পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কুমিল্লায় হোম মেইড ফুডের অফলাইন আউটলেট দেই আমি।
টেকজুম: নুসরাত কিচেন কে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেন?
নুসরাতঃ আমি আমার উদ্যোগ শুরু করি নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে। অনেক কিছুই নতুন ছিলো আমার কাছে। কেও ছিলোনা সাপোর্ট করার মতো। সবাই উপহাস করতো। আমি তাই স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতে নুসরাত কিচেনের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা তৈরী হবে।যারা সুযোগের অভাবে কিছু করতে পারবেনা তাদের পাশে দাঁড়াবে নুসরাত কিচেন। কুমিল্লার বিভিন্ন পয়েন্টে নুসরাত কিচেনের আউটলেট থাকবে। একসময় ব্র্যান্ড হয়ে যাবে আমার নুসরাত কিচেন। আর সেখানে কাজ করে নিজের পরিবার চালাবে সুবিধাবঞ্চিত নারীরা।
টেকজুম: নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছিঃ
নুসরাত : উদ্যোক্তা কথাটা ছোট হলেও এর পেছনে ঘটে যাওয়া ঘটনা অনেক বড়, অনেক ত্যাগের,কষ্টের। ২০১৭ সালে যখন আমি খাবার নিয়ে কাজ করি আমার বোন ছাড়া কেও আমার সাপোর্টে ছিলোনা। একদিন মেন্যু কার্ড বানাতে গিয়ে ৩ ঘন্টা বসিয়ে রেখেছিল। অন্যদিকে আমার ছোট বাচ্চা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ত বোনের কাছে। বাজার করা,কাটাকাটি করা, রান্না,প্যাকিং,হোম ডেলিভারি সব আমি একাই করতাম কেও পাশে ছিলোনা। কুমিল্লা শহরের রেস্টুরেন্ট বিজনেস তখন খুবই রমরমা ছিলো। আর কুমিল্লার খাবারের গ্রুপ ফুডিস গসিপে নুসরাত কিচেনের পজেটিভ রিভিউ পড়তো কয়েকজন রেস্টুরেন্ট মালিক আমার কিচেনের পোস্ট এপ্রুভ না করার হুমকি দেয়। আমাকে নানা ভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। এমনকি ইচ্ছে করে আমার খাবার অন্যদের দিয়ে নিয়ে খাবারের বাজে রিভিউ দেয়া হতো। তখন আমাকে সাপোর্ট করেছে কুমিল্লার দুই গার্লস গ্রুপের এডমিন ভাবনা ও মিতু।
কুমিল্লা শহরের অলিতে গলিতে হেটে হেটে নিজের প্রচারণা করতাম। মা,ভাই সবাই অনেক ঝামেলা করেছে এই উদ্যোগের জন্য। হাসবেন্ড তো বলেই দিয়েছে সংসার করতে হলে নুসরাত কিচেনের কাজ ছেড়ে দিতে হবে। আমি রাত দিন খেটেছি তাকে বুঝানোর জন্য যে আমি যে পথে হাটছি তাতে কোন ভুল নেই। আমি সংসার মেইনটেইন করে বিজনেস করতে পারবো ইনশাআল্লাহ। নিজের পরিবারের সবার একটাই কথা ছিলো এতো লেখাপড়া করে শেষমেশ পিঠা বিক্রি করছি কেনো। আমার উদ্যোগ শুরু করার কিছুদিন পরেই আমার ২য় ছেলে দুনিয়ায় আসে। নিজের মাঝে তাকে রেখেই আমি কাজ করে যাই। থেমে যাইনি সমাজ নামক ভাইরাসের কালো থাবার জন্য। নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস ছিলো যে আমি পারবো ইনশাআল্লাহ তাই আজ আমি কুমিল্লা পেরিয়ে বাংলাদেশের প্রায় জেলায় নিজের উদ্যোগকে তুলে ধরতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ।
টেকজুমঃউদ্যোক্তা জীবনে আপনার প্রাপ্তি গুলো কি কি ?
নুসরাতঃ একটা সময় যে মানুষ গুলো আমাকে নিয়ে সসমালোচনা করেছে আজ তারাই আমার পরিচয় দিচ্ছে খুবই গর্বের সাথে। আমার পুরো পরিবারে আমিই প্রথম উদ্যোক্তা জীবন বেছে নিয়েছি, এখন আলহামদুলিল্লাহ আমার পরিবারে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়েছে আমাকে দেখে। ২০১৮ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ আমাকে কুমিল্লার সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন। ২০১৯সালে নিবেদিতা গ্রুপের মাধ্যমে উইমেন সামিটে আমাকে কুমিল্লার প্রথম অনলাইন ক্যাটারিং এর স্বত্বাধিকারী হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন। এবং কুমিল্লার বিভিন্ন গ্রুপ থেকে আমাকে আমার উদ্যোগের জন্য সম্মাননা দিয়েছেন। আমার এই সকল প্রাপ্তির জন্য আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতে নুসরাত কিচেনে কাজ করবে অনেক সুবিধাবঞ্চিত নারীরা। তাদের নিয়েই আমি আমার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। বর্তমানে আমার সাথে প্রায় ৬-৭ জন কর্মী কাজ করেন।এদের প্রায়ই আমার পরিবারের সদস্য।
টেকজুমঃ উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) কিভাবে আপনার উদ্যোগে ভূমিকা রেখেছে ?
নুসরাতঃ আমি বিজনেস করি আজ প্রায় ৪ বছর উইতে আছি দেড় বছরের মতো। কিন্তু আমার আফসোস কেনো আমি উইকে আর উইয়ের মেন্টর রাজীব স্যারকে আমার উদ্যোগের প্রথমেই পেলাম না। আমি ভাবতাম অনলাইন বিজনেস মানেই একটা পেইজ খোলা আর অর্ডার নেয়া। কিন্তু না বিজনেস কিন্তু সেটা না।কাস্টমার খাতির করা,পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে নিজের পন্যের ব্র্যান্ডিং করা,নিজেকে অন্য জেলার উদ্যোক্তাদের কাছে পরিচিত করে তোলা এইসব আমি শিখেছি উই থেকে।করোনাকালীন সময়ে উইতে সময় দেয়ার ফলে আমার বাংলায় টাইপিং খুব বেশী ভালো হয়েছে,ব্যবসায়িক জ্ঞান বেড়েছে অনেক বেশী। উইয়ের জন্য আমাকে এখন কুমিল্লার বাহিরের প্রায় জেলার আপুরা চিনেছে। আর এইসব হয়েছে আল্লাহর রহমতে রাজীব স্যার ও নিশা আপুর জন্য। আমি রাজীব স্যার ও নিশা আপুর কাছে কৃতজ্ঞ আমাদের জন্য এতো সুন্দর একটা প্লাটফর্ম তৈরী করার জন্য।