রঙ তুলিতে স্বপ্ন আঁকা যায়,ক্যানভাসে ছড়িয়ে দেওয়া যায় নিজের মনের সব কথা।শখ যখন ক্যানভাসের বদলে দেশি কাপড়ে রঙ তুলির আঁচড় ফেলতে চায় তখন কি আর মনকে আটকানো যায়? একদম না।তাইতো ফেনীর সায়মা জাহিদ নীতি শখ থেকে স্বপ্ন আর স্বপ্ন থেকে উদ্যোগ নিয়েছেন হাতে আঁকা দেশি পন্যের।নীতির উদ্যোগের নাম নবনীতি যা হাতে আঁকা দেশি পোশাক ও বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করছে বর্তমানে। সায়মা জাহিদ নীতি বর্তমানে পড়াশোনা করছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে এবং ৩য় বর্ষে আছেন তিনি।জন্মসূত্রে ফেনীর মেয়ে এবং বর্তমানে পড়াশোনার সূত্রে ঢাকায় বসবাসরত।চলুন আজ আমরা নীতির রঙিন স্বপ্নের গল্প জেনে নিই।
টেকজুমঃ নবনীতির জন্ম কিভাবে হয়েছিল?
সায়মা জাহিদ নীতিঃ ছোট বেলা থেকে পেইন্টিং -ড্রইং শিখতে শিখতে বড় হয়েছি। আঁকিবুকি এ ক্ষেত্রে আমার শখ,ভালোবাসা,ভালো লাগা সব। ২০১৯ সালে ক্যানভাস পেইন্টিং করছিলাম,আমার রুমের জন্য, হঠাৎ ই মনে হল আমি তো ফেব্রিকেও করতে পারি। সেই বার প্রথম আমার একটা টি-শার্ট এ এঁকেছিলাম। এরপর রঙ,ফেব্রিক সব কিছু নিয়ে রিসার্চ করতে করতে ২০২০ এর ২১ শে নবনীতির যাত্রা শুরু হয়। কিছুদিন বসে ছিলাম। এরপর কোয়ারান্টাইন এ মনে হল যে কিছু করি। বাসায় বসে আছি। এই সময় টা অনেকেই কাজে লাগিয়েছে কিন্তু টিকে থাকাটা অনেক কষ্টের।আমি নবনীতিকে নিয়ে আস্তে আস্তে অনেকটা এগিয়েছি। হ্যান্ডপেইন্ট যে এত সাড়া পাবে বুঝতেই পারিনি।আমার সেঞ্চুরি পাতার পাঞ্জাবি সব চেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছে এবং এখনও পাচ্ছে।
টেকজুমঃ ই-কমার্সে কেন এলেন এবং কি সুবিধা রয়েছে এর?
সায়মা জাহিদ নীতিঃ বাইরে গিয়ে কাজ করা প্রথমত এখন আমার পক্ষে অসম্ভব।আমি বিজনেস করি অনেক কষ্ট করে, পড়াশোনার দিকে চাপ বেশি আমার কারণ অ্যাসাইনমেন্ট,প্রেজেন্টেশন,পরীক্ষা সব সামলে আবার সিজিপিএ মেইনটেইন করতে হয়।ডিপার্টমেন্ট এ এখন পর্যন্ত টপার আমি।একটু এদিক ওদিক হলে ফলাফল খারাপ হবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা কাজ করে। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই হাল ছেড়ে দিতো।আমি নিজের আইডেন্টিটি এখন থেকেই গড়তে চাই তাই এত কষ্ট করা।পড়াশোনা শেষ করে জীবন গড়ার সময় পাবো না তাছাড়া সময় ও কম।তখন টিকে থাকার লড়াই করতে হবে এবং আমার স্বপ্ন বিসিএস পরীক্ষা দিব ইনশাআল্লাহ।পড়াশোনা শেষ করে প্রিপারেশন নিতে হবে।তাই ভাবলাম যে এখন অনলাইনে কিছু করি। আগে থেকেই আমি দেশিপণ্যের এখন পর্যন্ত সেরা জায়গা উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম(উই) প্ল্যাটফর্মে আছি।সে সুবাদে উইতে নিজের জ্ঞানচর্চা শুরু করলাম। অনেক কিছু শিখলাম। তার চেয়ে বড় কথা আমি এখনও ছাত্র ফলে আমার কোনো বাড়তি বিনিয়োগ এর জন্য অর্থায়ন নেই যে আমি শোরুম দিব,অনেক প্রোডাক্ট স্টক করবো। নিজস্ব বিনিয়োগে শুরু এবং তাতেই সীমাবদ্ধ। প্রয়োজনে পরিবার সাথে আছে এই তো অনেক।এই খাতে সুবিধা অনেক।তবে বুঝতে হবে কিভাবে নিজের উন্নতি করতে হয়। টেকনলোজির যুগ তাই ইন্টারনেট এর সঠিক ব্যবহার জানতে হবে,স্কিল থাকতে হবে না হয় এই খাতে টিকে থাকা কষ্টের।আমি বিজনেস এর প্রায় সব কিছু ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্মটি থেকে শিখেছি।আমার মতে নিজেকে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরায় ই-কমার্সের কোনো জুড়ি নেই।আমি শোরুম দিলে আমার কাছ থেকে প্রোডাক্ট নিত নির্দিষ্ট জোন বা এরিয়ার লোকজন বা শুধু বাংলাদেশীরা। কিন্তু ই-কমার্সের মাধ্যমে উইয়ের কারণে আমার প্রোডাক্ট এখন অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাতেও পৌঁছাতে পারছি। সুতরাং এই খাতে সুবিধা অনেক,তবে পথ অমসৃণ।
টেকজুমঃ হ্যান্ডপেইন্টিং এর উদ্যোগে সফল হওয়ার উপায় কি?
সায়মা জাহিদ নীতিঃ সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। হ্যান্ডপেইন্ট এমন একটা কাজ যা মন থেকে করতে হয়। বাজারে এখন অনেক হ্যান্ডপেইন্টেড কাজ পাওয়া যায় ফলে সবাই সৎ থাকতে পারেনা। হ্যান্ড পেইন্টের ক্ষেত্রে রঙ আর ফেব্রিক একে অন্যের পরিপূরক বলা চলে। কারন এর ব্যবহার জানা অনেক প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান থাকাটা জরুরি তার মানে এই না যে আপনাকে এই বিষয়ে ডিগ্রি নিতে হবে। কিন্তু ট্রেনিং থাকা প্রয়োজন।আমার দিক থেকে ভাবলে আমি ছোটকাল থেকে শিখে আসলেও আমি স্নাতক ইংরেজিতে করছি।আমার মতে কাজের মধ্যে নিজস্বতা থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কপি জিনিসটা হ্যান্ডপেইন্টে অনেক বেশি হয়। বিজনেসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কপি করার অভ্যাস ত্যাগ করা আবশ্যক।কারন মানুষ সৃজনশীল কাজ পছন্দ করে। আমি মনে করি সবার সিগনেচার প্রোডাক্ট থাকা উচিত, যা দেখলেই সবাই বলে দিতে পারে কার প্রোডাক্ট এতে বিজনেসের ব্র্যান্ডিংও হয়, কাজের সম্মানও পাওয়া যায়।যেমন আমার সিগনেচার প্রোডাক্ট সেঞ্চুরি পাতা বা ম্যাপল লিফের পাঞ্জাবি।
টেকজুমঃ নবনীতিকে নিয়ে স্বপ্ন কি?
সায়মা জাহিদ নীতিঃ আমার পুরো উদ্যোগই দেশিপণ্য নিয়ে।আমি চাই আমার উদ্যোগ সম্পর্কে জানুক সবাই। আমার জেলাতে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে। এখনও সবাই হ্যান্ডপেইন্ট ঠিকমতো চেনে না।আর পাঁচজন থেকে আমার উদ্যোগ যেন আলাদা হয় তা নিয়ে ভাবি। নতুনত্ব নিয়ে আসার চেষ্টা করি কাজে। দেশিপণ্যের ভিত তৈরি হয়ে গিয়েছে; অন্যান্য দেশিপণ্যের ভিড়ে যখন দেখি হ্যান্ডপেইন্টও উঠে এসেছে তখন মনে হয় আমার কষ্ট কিছুটা সফল।ব্র্যান্ড হিসেবে তো অবশ্যই চাই তবে আমার আরো একটা ইচ্ছে আছে তা হলো সব পরিবারে প্রত্যেক নারীদের কাছে একটি করে হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি যদি থাকে এতে জামদানী, মসলিনের মতো হ্যান্ডপেইন্টেড শাড়িও এগিয়ে যাবে অনেকদূর দেশিপণ্য হিসেবে।
টেকজুমঃ উদ্যোগের চ্যালেঞ্জ গুলো কি এবং এর প্রতিকারের উপায় কি?
সায়মা জাহিদ নীতিঃ উদ্যোগের প্রথম অন্তরায় হচ্ছে কাস্টমার এর প্রশ্নের সম্মুখিন হওয়া।জামদানী,মসলিন সম্পর্কে সবাই টুকটাক জানে। কিন্তু হ্যান্ডপেইন্ট পণ্য কি তা সম্পর্কে এখনো সবাই জানে না। কিভাবে ব্যবহার করতে হয় জানেন না অনেকে।আবার ব্লক ভাবেন অনেকে।একবার হাতে পেলে কাস্টমার অনেক খুশি থাকে কিন্তু প্রথমে এটি কি তা বোঝাতে কষ্ট হয়। ডেলিভারি সিস্টেম টাও একটা বড় সমস্যা,কারন অনেক ফ্রড সিস্টেম আছে এখন। আবার অনেক সময় প্রোডাক্ট হারিয়ে ফেলছে এমনও হচ্ছে।কাঁচামালের অধিক মূল্য সহ সব কিছু মিলিয়ে বাধা আছেই। বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতেই হবে কারন এর নাম সফলতা।
টেকজুমঃ সফল নীতির অনুপ্রেরণা কে এবং কেন?
সায়মা জাহিদ নীতিঃ আমি সবার আগে বলব ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ ভাইয়ার কথা যিনি আমার মেন্টর। আমাদের সবাইকে এগিয়ে নেওয়ার অনুপ্রেরণা। আমি প্রায়ই পোস্ট দিতে দিতে হতাশ হয়ে যেতাম তখন দেখতাম ভাইয়া আমাদের সাহস দিয়ে গিয়েছেন। ভাইয়ার প্রত্যেকটা কথা আমি মেনেছি আর আমার সাকসেস এর পেছনে সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব আমি উনাকেই দিব। আমরা লাইফে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী পাই কিন্তু একজন ভালো উপদেষ্টা পাই না।রাজিব ভাইয়ারা সব সময় জন্মায় না। আমি নিজেকে ধন্য মনে করি তার অনুগত একজন ছাত্রী হিসেবে। আমি কৃতজ্ঞ ভাইয়ার প্রতি।আমার বাবা,মা এবং আমার স্বামী স্বাক্ষর,এই তিনজন না থাকলে আমার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া পুরোপুরি অসম্ভব ছিলো। প্রথম দিকে বাবা রাজি ছিলেন না, কারণ তিনি নিযে একজন ব্যবসায়ী ফলে লাভ, লস হলে আমি নিতে পারবো কিনা তাই নিয়ে ভেবে চিন্তিত ছিলেন।কিন্তু পরবর্তীতে আমার এগিয়ে যাওয়া দেখে শুধু রাজিই নন,বরং আমাকে পরামর্শ দেন কিভাবে এগিয়ে যেতে হবে।আমি যখন কাজ একা হাতে সামলাতে পারিনা আমার অলরাউন্ডার মা আমাকে হেল্প করে। আমার মা অলরাউন্ডার কারন তিনি পারেন না এমন কাজ নেই বললেই চলে।সেলাই,রান্না,ব্লক,বাটিক, হ্যান্ডপেইন্ট,ক্রাফট আইটেম সব পারেন কখনো কিছু করে উঠতে পারেননি ফলে তিনি চান আমি এগিয়ে যাই। আর আমার স্বামী কখনো কোনো কৃতিত্ব নিতে চান না কিন্তু আমার যখন হঠাৎ অর্ডার আসে হেল্পিং হ্যান্ড অসময়ে আসে না ঠিক তখন রাত জেগে কাজ করে, আমাকে হেল্প করেন।পাশে বসে নিজের সাধ্যমতো যা সম্ভব করে দেন তিনি।আলহামদুলিল্লাহ আমি সব কিছু মিলিয়ে আমি অনেক ভাগ্যবতী।
টেকজুমঃ চমৎকার নীতি, এভাবেই এগিয়ে যান এবং খুশি থাকুন দেশিপণ্য নিয়ে।ধন্যবাদ।
সায়মা জাহিদ নীতিঃ ধন্যবাদ টেকজুমের প্রতিও।