কোমর তাত কি? কোমরের সাথে দড়ি বেধে কাপড় তৈরী করা হয় বলে এই শিল্প কর্মকে নাম দেয়া হয়েছে কোমর তাত। তবে পার্বত্য এলাকার সম্প্রদায়ভিত্তিক কোমর তাতের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। চাকমা সম্প্রদায়ের সজপদর ও বেইন, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বিখান দৈ, মারমা সম্প্রদায়ের রাখেং নামে পাহাড়ে কোমর তাতের রয়েছে আলাদা পরিচিতি।
সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য এলাকার প্রতিটি ঘরেই রয়েছে কোমর তাত। সাধারণত বর্ষাকালে জুমে কাজসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে কোমর তাতে তাদের কাপড় বুনা হয়না তেমন একটা। তার জন্য শীতকালীন সময়টাকে বেছে নেয় তারা।
পিনন হাদি কি? চাকমা সম্প্রদায়ের রমনীরা তাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে পিনন খাদি পোষাক পরিধান করে থাকেন। পিনন ও হাদি দুটি অংশ।
চাকমা সম্প্রদায়ের রমনীরা তাদের যে ঐতিহ্যবাহী পোষাক পড়ে তার নীচের অংশটাকে বলে ‘পিনন’ যা সমতলের অনেকটা লুংগির মত। সেলাইবিহীন এই অংশটা দৈর্ঘ্য ৪.৫ হাত আর প্রস্থ ২.৫ হাত হয় সাধারণত। পিননের একদিকে নকশাসমৃদ্ধ আচল থাকে যাকে বলে চাবুকী। চাকমা সম্প্রদায়ের পিননের জমিন সাধারণত কালো, উপরে ও নীচে চওড়া রংগিন পাড় থাকে। পিনন পড়ার সময়ে চাবুকী বা দিকে থাকে।
চাকমা সম্প্রদায়ের রমনীদের উপরের অংশের পোষাকের নাম হাদি। দৈর্ঘ্য ৩.৫ হাত আর প্রস্থ ২.৫ হাত সাধারণত। হাদি দুই ধরনের হয়- রাংগাহাদি এবং চিবিকটানা হাদি। রাংগাহাদিতে বিভিন্ন নকশা করা হয়। এই ধরনের হাদি সাধারণত কম বয়সী নারীরা পরিধান করে। বয়স্ক নারীরা চিবিকটানা হাদি ব্যবহার করেন যাতে কোন নকশা হয়না। আধুনিক নারীরা হাদির সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ পরিধান করেন।
পিনন হাদি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বর্তমানে পিনন হাদির ফিউশন এনে অনেক পন্য তৈরী হচ্ছে। ছোটদের বিভিন্ন জামা, থ্রি পিস, ফ্লোর ম্যাট, পর্দা, ডিনার ম্যাট, ব্যাগ ইত্যাদি।
পিনন হাদি ঘরে বসে কোমর তাতে তৈরী করা যায়। কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়না। নারীরা অবসর সময়টাকে কাজে লাগানোর আর নিজেদের জন্য আগে থেকে পিনন হাদি তৈরী করলেও বর্তমানে বানিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরী করছেন। কিন্তু যে পরিমান শ্রম দেয়া হয় সেই তুলনায় রিটার্ন পায়না।
কথা হয় রাংগামাটির মল্লিকা চাকমা, লাবী চাকমা, লক্ষী রানী চাকমা, কালাবী চাকমা, মংগলা চাকমা, পুস্প রানী চাকমার সাথে এবং তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় একটা পিনন হাদি তৈরী করতে ডিজাইনভেদে ১ থেকে ৩মাস। এই সময়ে তাদের বিভিন্ন কাচামাল নিজেদের সংগ্রহ করতে হয়। দিন দিন সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের লাভ থাকেনা বললেই চলে। তাদের কথা একটাই স্বল্প মুল্যে কাচামালের যোগান অর্থাৎ সূতা যদি তারা ন্যায্যমূল্যে পায় তাহলে তাদের সুবিধা হয়।
রাংগামাটির ৬নং ওয়ার্ডের তাতী সমিতির সভাপতি বাবু সজীব চাকমা বলেন ‘সূতা যদি সহজলভ্য আর ন্যায্যমূল্যে তাতীরা পান তাহলে এই শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। রাংগামাটিতে একটি প্রশিক্ষন কেন্দ্র প্রয়োজন। ঋনের পরিমান বাড়ালে আর সেইসাথে ঋন অনুমোদনের প্রক্রিয়ার যে সময় সেটা যদি কমানো যায় তাহলে তাতীরা উপকৃত হবে।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ তাত বোর্ডের লিয়াজো অফিসার জনাব এবাদত হোসেন জানান যে ‘ তাতীদের সুবিধার জন্য পার্বত্য এলাকায় সেল সেন্টার কাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে, তাদেরকে স্বল্প সুদে সমতির মাধ্যমে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে, সূতা যাতে ন্যায্যমূল্যে পায় সেই চেস্টা অব্যাহত আছে’।
এই ঐতিহ্যবাহী কোমর তাত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই তাতীদেরকে স্বল্পমুল্যে কাচামাল নিশ্চিত করতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, এক্ষেত্রে সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এগিয়ে আসেন তাহলে প্রান্তিক কোমর তাতীরা উপকৃত হবে।
শিরীন সুলতানা অরুনা
রাংগামাটি