বাংলাদেশে হোমমেইড ফুডের পথ চলা খুব বেশি দিনের নয়। হোমমেইড ফুডের যাত্রাটা শুরুটাই হয়েছিল প্রয়োজনের খাতিরে। যখন পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সব কিছু অচল অবস্থায় ছিলো তখন হোমমেইড ফুড সবার প্রয়োজনে একটু একটু করে নিজের অবস্থান তৈরি করছিল। চারিদিকে লকডাউন, রেস্টুরেন্ট, হোটেল বন্ধ, বাজার যাওয়াটাও তখন বিপদজনক, বাসায় হেল্পিং হ্যান্ডের প্রবেশ ছিলো নিষিদ্ধ। কারণ বাহির থেকে বাসায় কাউকে ঢুকতে দেওয়াটাই ছিল বিপদজনক। কিন্তু আমাদের তো খাবার খেয়েই বেচে থাকতে হয়। বাসার সবাই অসুস্থ। রান্না করার মানুষ পর্যন্ত নেই। ঐ সময় ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ স্যারের প্রচারণার কারণে হোমমেইড ফুড একটু একটু করে আগাচ্ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবাই বুঝতে পারে হোমমেইড ফুড কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
পেন্ডামিক পরিস্থিতিতে যখন বাসার সবাই অসুস্থ ছিলো তখন হোমমেইড ফুডের উদ্যোক্তারা পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কখনও রাইডাররা, কখনও উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিয়ে বাসার রান্না করা খাবার পৌছে দিয়েছেন ক্রেতাদের কাছে। ঐ সময় থেকেই মানুষ উপলব্ধি করতে পারে হোমমেইড ফুডের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে।
আমরা জানি আমাদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম শিল্পের বা পর্যটন শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনার দেশ। এখন হোমমেইড ফুড ইন্ডাস্ট্রি এতটাই বিস্তৃত হয়ে গেছে যে আমরা বুঝতে পারি পর্যটন শিল্পের সাথে হোমমেইড ফুড জড়িয়ে পরেছে। পর্যটকরা যখন দেশের বিভিন্ন বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করে তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঐ স্থানের বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী খাবার সম্পর্কে জানতে চান এবং তার স্বাদ গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়। আবার এমন সব ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলো বেশির ভাগই হোমমেইড ফুড। যেমন বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা, বিভিন্ন ধরনের খাবারের মেনু যেমন চট্টগ্রামের মেজবান, বরগুনার চুইয়া পিঠা, জয়পুরহাটের চটপটি, সিলেটের সাতকরার আচার, শরীয়তপুরের বিরিয়ানি পিঠা এমন বিভিন্ন জেলার শত শত বিখ্যাত হোমমেইড ফুড রয়েছে যা ঐসব জেলার পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
পর্যটকরা যখন ভ্রমনের উদ্দেশ্যে বা প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন স্থানে যান তখন তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সুস্থ থাকার জন্য। অচেনা জায়গায় এবং নতুন পরিবেশে সুস্থ থাকাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হোমমেইড ফুড তখন সেই স্থানের ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি পর্যটকদের যেকোন ধরনের হোমমেইড ফুডের চাহিদা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে যা পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। শুধু তাই নয়, পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টোমাইজড করার সুযোগ রয়েছে হোমমেইড ফুডের।
আমরা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারি পর্যটন শিল্পের সাথে হোমমেইড ফুডের সম্ভবনা কতটা গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে। যেহেতু হোমমেইড ফুডের উদ্যোক্তারা শিক্ষিত এবং দক্ষতার ও যত্নের সাথে নিজেদের উদ্যোগ পরিচালনা করে আসছেন, তাই পর্যটক ক্রেতাদের খাবারের চাহিদা পূরণেও হোমমেইড ফুডের উদ্যোক্তারা ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ।
দেশের পর্যটন শিল্পের সাথে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি জড়িত । একই ভাবে দেশের পর্যটন শিল্পের সাথে হোমমেইড ফুড ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনাও জড়িত। তাই সব দিক থেকেই হোমমেইড ফুড আলাদা একটি ইন্ডাস্ট্রির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। হোমমেইড ফুড ট্যুরিজমে ব্যাপক অবদান রাখতে পার ।
আমরা যদি একটু ভাল ভাবে চিন্তা করি তাহলেই বুঝতে পারবো হোমমেইড ফুড ট্যুরিজমে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। পর্যটন এলাকা হিসেবে ঢাকা অন্যতম একটি স্থান। কারণ ঢাকা দেশের রাজধানী। সেদিক থেকে দেশের কেন্দ্র। তাই পর্যটকদের আগে ঢাকাতেই আগমন ঘটে। এছাড়াও পুরান ঢাকা পুরোটাই একটা পর্যটন এলাকা। তাই এদিকে অর্থ্যাৎ ট্যুরিজমে হোমমেইড ফুড ব্যাপক অবদান রাখে পারে বিশেষ করে হোমমেইড ফুডের উদ্যোক্তারা।
ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে অসংখ্য হোমমেইড ফুড উদ্যোক্তা। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। কেউ পৈত্রিক সুত্রে আবার কেউ বৈবাহিক সুত্রে আবার কেউ কাজের তাগিদে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা হোমমেইড ফুড উদ্যোক্তারা নিজ জেলার বা বৈবাহিক সম্পর্কিত জেলার বিখ্যাত খাবার রান্না করেন এবং তা তাদের উদ্যোগের পণ্য হিসেবে প্রচার করেন। যেমন চাঁপাই নবাবগঞ্জের কালাই রুটি, চট্টগ্রামের আখনি, কালাভূনা, ঢাকার বিরিয়ানি, শরীয়তপুরের বিবিখানা পিঠা, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার তালে বড়া এমন অসংখ্য জেলার বিখ্যাত সব ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে ঢাকার হোমমেইড ফুড উদ্যোক্তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
ঢাকাকে কেন্দ্র করে যেহেতু পর্যটন শিল্পের সম্ভবনা অনেক বেশি তাই পর্যটকদের বিভিন্ন জেলার বিখ্যাত খাবারের স্বাদ দিতে ঢাকার হোমমেইড ফুড উদ্যোক্তাদের উপরে নির্ভর করতে হবে। একজন পর্যটক ঢাকাতে থেকেই চাঁপাই নবাবগঞ্জের কালাইয়ের রুটি বা চট্টগ্রামের মেজবান এর স্বাদ নিতে পারবেন হোমমেইড ফুড উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। এটাকে বলা হয় ট্যুরিজম অব ফুড। একটি স্থানে অবস্থান করে অন্য কোন স্থানের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করাকে ট্যুরিজম অব ফুড বলা হয়।
ট্যুরিজম অব ফুড এর সাথে যেহেতু হোমমেইড ফুডের সম্ভবনা অনেক বেশি তাই এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ। পর্যটকদের কাছ থেকে অর্ডার নেওয়া এবং অর্ডার টি প্লেস করে ডেলিভারী করা পর্যন্ত রাইডার থেকে শুরু করে ডেলিভারী কোম্পানি গুলো, প্যাকেজিং এর ক্ষুদ্র শিল্প পুরো চেইনের ভাল করার সুযোগ রয়েছে। স্থানীয় বাজারের উপরে তথা কৃষি শিল্পেরের উপরে এর প্রভাব পরবে যা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে সরাসরি। তাই সেদিক থেকে হোমমেইড ফুডের এমন সেবামূলক কাজের সাথে সাথে এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্প।
খাবার শুধুমাত্র মৌলিক চাহিদার একটি উপাদান নয়। খাবারের টেস্ট মানুষকে এমন ভাবে আকৃষ্ট করে যা মানুষকে বারবার ফিরে আসতেও উদ্বুদ্ধ করে। দেশের বিভিন্ন ধরনের বিখ্যাত হোমমেইড ফুডের স্বাদ পর্যটকদের আকৃষ্ট করলে তা যেমন পর্যটকদের জন্য পুষ্টিগত দিক থেকে সমৃদ্ধ করবে এবং তারা স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের স্বাদটাও গ্রহণ করতে পারবেন। হোমমেইড ফুড পর্যটকদের স্বাস্থ্যসেবার দিকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
একারণে হোমমেইড ফুড বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। যখন সামনের দিনে হোমমেইড ফুড আলাদা একটি ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনাও মর্যাদা পাবে তখন আমরা হয়তো এই বিষয় গুলোই দেখতে পাবো। হোমমেইড ফুড সব দেখেই বিস্তার লাভ করবে ব্যপক হারে। কারন মানুষ বেঁচে থাকা ছাড়াও খাবার তাদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের সাথে জড়িয়ে আছে।
লেখক: সৈয়দা ক্যামেলিয়া রহমান, স্বত্বাধিকারি: সহজসাধ্য।