বহুল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন শুধু যোগাযোগ মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তা বহুমুখী মাধ্যমে রূপান্তর হয়েছে। দেড় দশক আগেও ফেসবুক ছিল কেবল নিজের আবেগ অনুভূতি অন্যদের সাথে বিনিময় করা মাধ্যম, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার জনপ্রিয় ও কার্যকরী মাধ্যম। বর্তমানে ফেসবুক আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নোটিফিকেশন কিংবা মেসেজ চেক করা থেকে শুরু করে খবর, বিনোদন, কেনাকাটা, লেখাপড়া, গেইম খেলা, ভিডিও দেখা, পুরাতন স্মৃতি খুঁজে পাওয়া সহ রাতে ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকে ফেসবুক। বলা যায়, বর্তমানে ফেসবুকের মতো অন্য কোথাও বা কাউকে তত সময় দেওয়া হয় না নিয়মিত। তা হবে না কেন? ফেসবুকে আমরা যতটা আনন্দ নিয়ে সময় কাটাতে পারি তা অন্য আর কিসে পারা যায়?
জরিপ করলে দেখা যাবে দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে লেখাপড়া একটি বিরক্তিকর বিষয়। শিক্ষার্থীদের অনেকে মনে করে কোনভাবে এক ক্লাস করে শেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ইতি টানতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। এসব শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ কোনভাবে লেখাপড়া শেষ করার পর আগ্রহ নিয়ে বছরে একটাও বই শেষ করে না। তা গল্প কিংবা আত্ম উন্নয়ন বই। লেখাপড়ার সাথে তাদের সখ্যতা গড়ে না উঠলেও প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় ফেসবুক স্ক্রল করে। সেখানে তারা অসংখ্য পোস্টে চোখ বুলায়, সংবাদ শিরোনাম পড়ে, অন্যদের পোস্টে কমেন্ট করে, রিপ্লাই দেয় কিংবা মেসেজ আদান প্রাদান করে। অথচ তাদের কেউ কেউ খাতায় সারাদিনে এক কলমও লিখে না। যেহেতু ফেসবুকে তারা কম-বেশি পড়ে এবং লিখে তাই লেখাপড়া আনন্দদায়ক করার জন্য ফেসবুক হতে পারে কার্যকরী মাধ্যম।
এখন থেকে ৫ বছর আগেও ফেসবুক নিউজফিড থাকতো বাংলিশ (ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা) পোস্টে ভরপুর। তখন বাংলা বর্ণের পোস্ট চোখেই পড়তো না। সারা দিনে ১-২টি পোস্ট বাংলায় পেলেও দেখা যেতো কপি পেস্ট করে শেয়ার করেছে। ৫ বছর পরে এসে চিত্রটা পুরাই বদলে গেছে। এখন বাংলিশ পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায় না, বাংলা পোস্টে ভীড়ে। আমার নিউজ ফিডে প্রতিদিন শত শত পোস্ট দেখি ও পড়ি যা অন্তত ১০০ শব্দের। কোন কোন পোস্ট ৫০০-৬০০ শব্দেরও দেখি, পড়ি এবং লিখি। কমেন্টগুলো হয় গঠনমূলক। কারো থেকে কেউ কপি করে না। নিজের মতো করে লিখেন, নিজের কি-বোর্ড দিয়ে। এই আমুল পরিবর্তনের পিছনে অবদান রেখেছে ১০ মিনিট রাইটিং পোস্ট ও আরিফা মডেল। যারাই এই টপিকগুলো অনুসরণ করেছে তারাই বাংলা লেখা ও পড়ায় উন্নতি করেছে।
ফেসবুক কেবল বাংলা লেখা ও পড়ার উন্নতি করে তাই নয়, জীবনের প্রয়োজনীয় সব দিকেই লেখাপড়ার করার মতো ফেসবুকে সোর্স রয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কেউ যদি প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করতে চায়, ব্যবসায় জ্ঞান বাড়াতে চায়, ইংরেজি শিখতে চায় কিংবা গান-কবিতা চর্চা করতে চায় এর জন্য ফেসবুক কয়েকটি কারণে ভালো মাধ্যম। প্রথমত ফেসবুকে যারাই কোন কিছু লিখেন তারা সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। যার কারণের আগ্রহের সাথে তা শেষ করতে পারেন ফেসবুক ব্যবহারকারী পাঠক। অন্য একটি কারণ হচ্ছে সমমনা লোক সহজে পাওয়া যায় ফেসবুকে। যেমন, ইংরেজি না পারা বাংলাদেশের জন্য বিশাল একটি সমস্যা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে অন্তত ১২ বছর ইংরেজি পড়লেও দক্ষতা অর্জন হয়নি, বরং ভয় ভীতি আর লজ্জা বাসা বেঁধেছে। সার্চ ইংলিশ গ্রুপের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার বিভিন্ন বয়সী মানুষ নিজের মতো করে নিজের সময়ে ইংরেজি চর্চা করছে। একজনের ভিডিও করা দেখে অন্য জন উৎসাহীত হয়ে নিজে নিজে ইংরেজি কথা বলার ভিডিও তৈরি করছে এবং সার্চ ইংলিশে আপলোড করছে। তাদের সকলের উদ্দেশ্য একই হওয়ার কারণে কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না, ভুল ধরছে না। শুধু চর্চা করছে। তারা নিজেদের উন্নতি দেখতে পাওয়ার কারণে সুযোগ পেলেই সার্চ ইংলিশে চর্চা করে। অনেক সময় দেখা যায় জমিতে ধান কাটতে গিয়ে কেউ কেউ ভিডিও তৈরি করছে এবং আপলোড করছে। অর্থাৎ ইংরেজি চর্চার প্রতি তার একটা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে, আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে এবং নিজের মধ্যে একটা তাড়না তৈরি হয়েছে।
তেমনি যারা নিজের বেসিক ডেভেলপ করতে চায়, প্রযুক্তি, ব্যবসা সহ যেকোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ গ্রুপে চর্চা করছে। বহু মানুষ পোস্ট কমেন্টে বলছে তারা এই বয়সে এসে যতটা আগ্রহ আর আন্তরিকতার সাথে চর্চা করছে, শিক্ষা জীবনে ততটা আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে চর্চা করেনি। এভাবে নানা বিষয় নিয়ে সমমনা মানুষের সাথে ফেসবুকে বিনামূল্যে চর্চা করা যায় জীবনের যেকোন বয়সে এবং যে কোন স্থান থেকে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ফেসবুকে লেখাপড়া করার ক্ষেত্রে কোন রকম মুখস্থ করতে কিংবা পরিক্ষা দিতে হয় না। এরপরও মানুষ চর্চা করছে এবং নিজেদের উন্নতি টের পেয়ে তাদের চর্চার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফেসবুকের কারণে বিনামূল্যে এভাবে হাজার হাজার মানুষের লেখাপড়ার গল্প পরিবর্তন হয়েছে।
এছাড়া ফেসবুকে সহজেই নিজের পছন্দ ও আগ্রহের শিক্ষার উৎসাহ খুঁজে বের করা যায়। তাই শহর কিংবা গ্রাম যেকোন জায়গা থেকে যেকোন লেভেলের জ্ঞান অর্জন করা যায়। অর্থাৎ ফেসবুক লেখাপড়া হয়েছে উঠেছে বাস্তবমুখী লেখাপড়া করার অন্যতম একটি মাধ্যম।
লেখক, জেনিস ফারজানা তানিয়া। স্বত্বাধিকারি: আলিয়া’স কালেকশন।