আজ ৬ ই মার্চ জাতীয় পাট দিবস। ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবছর ৬ ই মার্চ জাতীয় পাট দিবস পালন করার ঘোষণা দেন৷ এরপর প্রতিবছর এই দিনটা জাতীয় পাট দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। এ বছরও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পাট দিবস পালন করা হচ্ছে।
এবার জাতীয় পাট দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশ, স্মার্ট পাটশিল্পের বাংলাদেশ’। প্রতি বারের মতো এবারও জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য ১১ ক্যাটাগরিতে ১১ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা স্মারক দিচ্ছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।
১. পাটবীজ, পাট ও পাটজাত পণ্যের সেরা গবেষক/ বিজ্ঞানী/উদ্ভাবক
২. সেরা পাটবীজ উৎপাদনকারী চাষি
৩. সেরা পাট উৎপাদনকারী চাষি
৪. পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা পাটকল
৫. পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান
৬.পাটের সুতা উৎপাদনকারী সেরা পাটকল
৭. পাটের সুতা রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান
৮. বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা পাটকল
৯. বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক সেরা প্রতিষ্ঠান
১০. বহুমুখী পাটপণ্যের সেরা নারী উদ্যোক্তা
১১. বহুমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী সেরা পুরুষ উদ্যোক্তা পুরস্কার ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার দেওয়া হয়।
এ বছর পাট দিবসের মূল অনুষ্ঠান হবে আগামী ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।
প্রধানমন্ত্রী ঐদিন ইজারার জন্য নির্ধারিত বিজেএমসির ৬ টি মিলের বাণিজ্যিক উৎপাদন কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন।
এছাড়াও ১৪-১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী বহুমুখী পাটপণ্য প্রদর্শনী ও মেলা আয়োজন করা হয়েছে।
পাটকে বলা হয় সোনালী আঁশ। কেননা পাটের এই সোনালি আঁশের পরশে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল সোনার দেশ। স্বাধীনতাকালীন সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৯৭ শতাংশ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। বাকি ৩ শতাংশ অন্যান্য রপ্তানি পণ্য থেকে। অথচ এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। গত কয়েকবছর আগে পাট ও পাট জাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় হতো মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ এই পাট আমাদের একসময় পরিচয় বহন করত। একে একে জুটমিল গুলো বন্ধ হয়ে গেল।
তবে সোনালি সুদিন ফিরে আসছে আবার। যখন করোনাকালীন পরিস্থিতির জন্য রপ্তানিজাত পণ্য গুলো রপ্তানি করা যাচ্ছিল না তখন পাট রপ্তানি করে আয় হয়েছে আশানুরূপ। চামড়াজাত পণ্যের থেকে বেশি আয় হয়েছে পাট ও পাট জাতীয় পণ্য রপ্তানি করে গত অর্থ বছরগুলোতে। এটা নিঃসন্দেহে পাটের সোনালি সুদিন ফিরে আসার ইঙ্গিত। এখন প্রয়োজন শুধু যথাযথ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন।
সরকার ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের সহায়তায় পাট আবার ফিরে আসতে পারে তার স্বরূপে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৮৫ রকমের পাটপণ্য রয়েছে। খুব অবাক করা বিষয় হলো এখন পাট থেকে বিভিন্ন প্রসেসিং করে শাড়ি,ওড়না, পাঞ্জাবি সহ বিভিন্ন পোশাকও তৈরি হচ্ছে। আবার এসব পোশাকে ফিউশনের মাধ্যমে ভিন্নতাও আনা হচ্ছে। পাটের চট থেকে তৈরি করা হচ্ছে ইউনিক সব পণ্য। যা দেখতে নান্দনিক ও ব্যবহারও সহজ। পাটপণ্য যত্ন নেয়াও সহজ বলে ধীরে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
দেশীয় বিভিন্ন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন নিজ নিজ দক্ষতা নিয়ে। পাট ও পাটপণ্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা করা হচ্ছে। আবার বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীদের দক্ষ করা হচ্ছে। খুবই খুশির সংবাদ হলো পাটকল গুলো আবার চালু করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর মাত্র অল্প কয়েকটি দেশে পাট উৎপাদন করা হয়। তবে অনেক দেশ পাটপণ্য ব্যবহার করতে পছন্দ করে। কেননা পাট একটি পরিবেশ বান্ধব পণ্য। যেখানে বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন এবং পলিথিন ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জানে সেখানে পাটপণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকবে। তাই বাংলাদেশের পাট বিশ্ববাজারে আবার তার স্বরূপ নিয়ে ফিরে আসার দ্বারপ্রান্তে। এখন শুধু দরকার যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পাট নিয়ে কাজ করলে এর সুদিন ফিরে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না ইনশাআল্লাহ।
পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। আর সোনালি আঁশের সোনালী সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাট শুধুমাত্র পরিবেশ বান্ধব নয় এর আরও বহু উপকারী দিক রয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাটের ভূমিকা রয়েছে । পাট পণ্য ব্যবহার যেমন পরিবেশের জন্য উপকারী তেমনি দেশীয় অর্থনীতি বিরাট ভূমিকা রয়েছে পাটের। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম।
আর তাই পাটের ব্যবহার বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণ করেছে।
পাট ও পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী সোনালি আঁশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটপণ্যকে ‘বর্ষপণ্য ২০২৩’ এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
বাংলাদেশে ২৮৫ টি পাট পণ্য রয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশ পণ্য (২৩৫ টি) বিদেশে রপ্তানি হয়।
২০২৩ – ২০২৪ অর্থবছরে বিজেএমএ ও বিজেএসএ এর তথ্য মতে (জুলাই/২০২৩- ফেব্রুয়ারি/২০২৪) বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত পাটজাত পণ্যের পরিমাণ ৩.৪৪ লক্ষ মেঃ টন। মোট রপ্তানির পরিমাণ ১.০৩ লক্ষ মেঃ টন। মোট রপ্তানি আয় ৯৬.২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ ১০৫৮.৯৮ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ৯১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। যা ২০২১- ২০২২ অর্থবছরের তুলনায় ১৯% কম ছিল।
বিশ্বের বহু দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাট পণ্যের চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে। ইউরোপ, তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩৫টি দেশে কাঁচা পাট রপ্তানি হয়ে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জুলাই ২০২৩ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত কাঁচা পাট রপ্তানির পরিমাণ ৬৯৭৮৪৭ বেল। কাঁচা পাট থেকে রপ্তানী আয় লক্ষ মার্কিন ডলার ৮০৫.০৯। যা বাংলাদেশী টাকায়
৮৫৭.১৮ রপ্তানী আয় কোটি টাকা।
বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে পরিবেশ যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে পৃথিবী হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। তাই বিশ্ববাসী আরও সচেতন হচ্ছে। বিশ্বের পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন গুলো পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ বান্ধব পাটপণ্য ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
প্লাস্টিকের সাথে পাটের মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে পণ্য যা পরিবেশ বান্ধব পণ্য হিসেবে ই বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্ববাসীর পাট পণ্যের প্রতি আগ্রহ এবং চাহিদা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য সুখবরই বটে। কেননা বাংলাদেশের মতো এতো উন্নত জাতের পাট পৃথিবীর আর কোন দেশে উৎপাদিত হয় না। ফলে উন্নত প্রযুক্তি, যথাযথ পরিকল্পনার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলার সোনালী আঁশ পাটকে বিশ্বজুড়ে আরও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
পাটের রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। পাট বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল এবং পাট পণ্য বহুমুখী পণ্য। একটা পণ্য জি আই ট্যাগ পেতে যা বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন তা সবই পাটের রয়েছে। পাট বাংলাদেশের জি পণ্য হওয়া উচিত। জি আই স্বীকৃতি পেলে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভবপর হবে।
রুমা আক্তার
স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার জুট হ্যাভেন