ভাষার মাসে বহুজাতিক মার্কিন সমাজে বাঙালির এগিয়ে চলার অভিযাত্রায় যুক্ত হলো আরেকটি অধ্যায়। এতে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন কঠোর পরিশ্রমী ও মেধাবী একজন বাংলাদেশি অভিবাসী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাসরত প্রকৌশলী আবুবকর (হানিপ)। বাংলাদেশি মার্কিন হিসেবে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা অর্জন করলেন তিনি।
১১ ফেব্রুয়ারি ভার্জিনিয়ার ভিয়েনায় অবস্থিত ‘আই গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি’ (ইনোভেটিভ গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি তথা আইজিইউ)–এর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন আবুবকর। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান, ব্যবসা ও প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় শিক্ষার্থীদের কাছে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত।
১১ ফেব্রুয়ারি কাগজপত্রের স্বাক্ষর-অনুস্বাক্ষর ও রাষ্ট্রীয় প্রটোকল মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীসহ পুরো অভিবাসী সমাজে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাও বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সুযোগ পাবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিমধ্যে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এসেছেন এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।
জানা গেছে, গত ১২ বছরে ৪ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ শতাধিক। এর মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীর (ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট) সংখ্যাই বেশি। প্রকৌশলী আবুবকর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান এবং মালিকানায় আসার পর শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এনে সব ডিগ্রিধারীকে উপযুক্ত চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সহায়তা আর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আবুবকর যুক্তরাষ্ট্রে পিপলএনটেকর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে গত দেড় দশকে ৭ হাজারের বেশি প্রবাসীকে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই এখন প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন।
আবু বকর বলেন, ‘উচ্চ বেতনে চাকরি পাওয়ার জন্য আপনার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু কেবল ডিগ্রিই আপনাকে চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। যেমনটা আমাকে দেয়নি ২০ বছর আগে। বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি থাকার পরও আমি এখানে স্বল্প পারিশ্রমিকের কাজ, অর্থাৎ ‘অড জব’ করতাম। সে সময় আমি অনুভব করেছি, আমার এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি থাকলে হয়তো আমি ভালো ও বেশি বেতনের চাকরি পাব।’
আইজিইউয়ের চেয়ারম্যান ও সিইও আবুবকর বলেন, ‘প্রায় ৫০ হাজার ডলার ঋণ নিয়ে আমি কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করলাম। সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে পাস করার পরও সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পাইনি। ফের ফিরে গেলাম অড জবে। কিন্তু আমি থেমে যাইনি, হতাশও হইনি। বেশ কিছুদিন পরে আমি ঠিকই স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং করে আইটি খাতে চাকরি পেলাম। তখন আমি বুঝলাম, ডিগ্রি দরকার। কিন্তু স্কিল ডেভেলপমেন্ট ছাড়া শুধু ডিগ্রি দিয়েও একজন তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে না। সেই মানসেই আমি ১৫ বছর আগে ‘পিপলএনটেক’ গড়ে তুলি, যার মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার অভিবাসী এখন উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন। সেই অভিজ্ঞতাই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এত দিন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আজ সে স্বপ্ন পূরণ হলো।’
বাংলাদেশি এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘এখন আমি ও বিশ্ববিদ্যালয় টিম বেশ গর্ব করেই বলতে পারছি, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমরা ক্যারিয়ার সহায়তা দেব। কেননা, সেই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা সুবিধাদি আমরা এরই মধ্যে অর্জন করেছি পিপলএনটেকের মাধ্যমে। আমাদের শিক্ষকেরা শুধু স্কলার নন, তারা ইন্ডাস্ট্রি প্র্যাকটিশনারও, যাদের রয়েছে ৪ থেকে ৩০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা।’
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার অব সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি (এমএসআইটি), মাস্টার অব সায়েন্স ইন সাইবার সিকিউরিটি ও মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (এমবিএ) উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া যায়।
আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্যাচেলর অব সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি (বিএসআইটি) ও ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ)। এ ছাড়া কম্পিউটার ও আইটি বিষয়ে বেশ কিছু সার্টিফিকেট কোর্সও রয়েছে। ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শিগগিরই হেলথ কেয়ার, নার্সিং, ডেটা সায়েন্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়েও বেশ কয়েকটি কোর্স চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বার্ষিক দুলাখ ডলারের শিক্ষাবৃত্তি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ। এই শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন করা যাবে www.igu.edu ওয়েবসাইটে।
প্রকৌশলী আবুবকর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক করার পরও একজন চাকরির শুরুর দিকে ৪০/৫০ হাজার ডলারের বেশি বেতনে চাকরি পায় না। অনেকেই শিক্ষাঋণ নিয়ে পড়াশোনা করে ভালো চাকরি না পাওয়ার কারণে তা দ্রুত পরিশোধ করতে পারেন না। এ জন্য হতাশ হয়ে পড়েন। ফলে ঋণ নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের চেয়ে দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার চিন্তায় অনেকে উবার-লিফট চালানোসহ অন্যান্য অড জবকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন।
পিপলএনটেকের প্রতিষ্ঠাতা সিইও ও আইজিইউর চ্যান্সেলর আবুবকর বলেন, আই গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি শিক্ষাদান ও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে সহায়তার যে মডেল তৈরি করেছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। এ জন্য দেশের সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তিনি যৌথভাবে পাঠদানে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গেও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করতে আগ্রহী বলে জানান।
বিজ্ঞাপন
আবুবকর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স), তৈরি পোশাক ও কৃষি। তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) দেশের অর্থনৈতিক চেহারা আরও দ্রুত পাল্টে দিতে সক্ষম। এ জন্য বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে সঠিক আইটি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বিদেশে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশিরা এসে চাকরি করতে পারেন। এমনকি বাংলাদেশে থেকেও একজন ব্যক্তির প্রতি মাসে ২/৩ লাখ টাকা উপার্জন করা সম্ভব।
আবুবকর বলেন, আইটি খাতে ভারত যে জায়গাটি দখল করেছে, বাংলাদেশও তা করতে পারে। এ জন্য স্নাতকের আগেই দরকার হাতে-কলমে শিক্ষাদান। এতে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পও আরও বেগবান করা সম্ভব।
আই গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি (আইজিইউ) যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন, ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, স্টেট কাউন্সিল অব হায়ার এডুকেশন ফর ভার্জিনিয়া, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর স্টেট অথোরাইজেশন রিসিপ্রোসিটি অ্যাগ্রিমেন্টস, অ্যাক্রিডেটিং কমিশন অব ক্যারিয়ার স্কুলস অ্যান্ড কলেজ-এসিসিএসসির সনদপ্রাপ্ত। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর প্রোগ্রামের (এসইভিপি) আলোকে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আই-২০’ ইস্যুর জন্য ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস), মার্কিন সরকারের জে-১ প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ফেডারেল স্টুডেন্ট এইডের জন্য এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অনুমোদন রয়েছে আইজিইউর।