উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথেই শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধ। উচ্চশিক্ষার আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির জন্য বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে থাকেন। আর এ সুযোগেই প্রশ্নপত্রের প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউসিসির বিরুদ্ধে। এছাড়া বিভিন্ন সময় প্রক্সিকান্ডে কোচিং শিক্ষকদের জড়িত থাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতিসহ নানান অভিযোগ উঠেছে এ কোচিং এর বিরুদ্ধে।
জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতির মত ঘটনা ঘটেছে যার বেশির ভাগ ঘটনায় ইউসিসির নাম উঠে আসে। বর্তমানে ভর্তি জালিয়াতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্ভব না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউসিসি কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্রের ও ভর্তি জালিয়াতির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কোচিংয়ে ভর্তি করাচ্ছে। যার ফলে শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবক্ষয়ের সাথে সাথে তাদের পড়াশোনার মানসিকতাও হারিয়ে ফেলছে বলে ধারণা সচেতন অভিভাবক দের।
প্রশ্নপত্রের প্রলোভনের ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউসিসির সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, সবাই তো চায় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি সেই আশা থেকেই ইউসিসিতে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হতো। বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে মোটামুটি ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা হলেই জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতো ইউসিসি।
এখন টাকা দিয়ে জালিয়াতির সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা হচ্ছে সব থেকে বড় ব্যবসা যদি ঠিক মত করা যায় আর কি। এখন জালিয়াতির সুযোগ না থাকলেও এই প্রলোভনটা কাজে লাগিয়েই বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছে। মানে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর আশায় প্রশ্নপত্রের প্রলোভন কাজে লাগাচ্ছে ইউসিসি।
প্রশ্নপত্রের আশায় ইউসিসিতে ভর্তি হওয়া ২০২১-২২ সেশনের ইলিয়াস (ছদ্মনাম) বলেন, ইউসিসির এক ভাইয়ার থেকে শুনেছিলাম টাকা দিয়ে নাকি ভর্তি পরীক্ষার দিন সকালে এমন কিছু প্রশ্ন দিবে যা থেকে মোটামুটি সম্পূর্ণই কমন পাওয়া যাবে তাই আমি আর আমার বন্ধু দুইজন একসাথেই ভর্তি হইছিলাম। পরে বুঝলাম সিস্টেম করে এখন আর ভর্তি হওয়া সম্ভব না কিন্তু এই প্রলোভনে আমি পড়াশোনা ও করিনি ইউসিসিতে ভর্তির টাকাও নষ্ট। এখন সেকেন্ড টাইমের প্রস্তুতি নিব।
বিগত সময়ে ঢাবির প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ইউসিসি!
বিগত দীর্ঘ কয়েক বছর ঢাবিতে ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউসিসি। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউসিসি জড়িত বলে অভিযোগ ওঠেছিল। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে বিভিন্ন প্রমাণসহ জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে ইউসিসির সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনেন।
২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে চারটি ইউনিটে জালিয়াতির অভিযোগে আটক সাদনাম আহমেদ সৈকত, জায়েদ হাসান ও বদিউজ্জামান জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিজেদের ইউসিসির শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকার করেন। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে আটক হাসিবুল হাসান সামু ইউসিসির কোচিং সেন্টারের শিক্ষকের সহায়তায় ৫ লাখ টাকার চুক্তির কথা স্বীকার করেছিলেন।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ১৩ জনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তাদের দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদের মধ্যে পাঁচজনই ইউসিসির কয়েকজন শিক্ষকের সহযোগিতায় জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। এছাড়া একই শিক্ষাবর্ষে ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় আটকদের মধ্যেও তিনজন নিজেদের জালিয়াতির সঙ্গে ইউসিসির শিক্ষকের সম্পৃক্ততার কথা জানান। এছাড়াও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে জালিয়াতির দায়ে আটককৃত দের মধ্যে দুজন ছিল ইউসিসির ছাত্র, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হওয়া জাহিদ হাসান আকাশও জালিয়াতি করেছিলেন ইউসিসির মাধ্যমে।
কোচিং না করিয়েও ইউসিসির আকাশচুম্বী প্রচারণা!
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউসিসি কর্তৃপক্ষ সংবর্ধনার নাম করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ছবি, মোবাইল নম্বর, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও প্রাপ্ত জিপিএ সহ ফরম পূরণ করিয়ে নেয়। এসব তথ্য ব্যবহার করে ইউসিসি ২০১৯ সালে রাজশাহী শাখা থেকে প্রকাশিত প্রসপেক্টাসে সংবর্ধনার নামে তথ্য নেয়া রাবি শিক্ষার্থীদের ইউসিসি’র শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের কেউই ইউসিসিতে কোচিং করেনি।
এর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চারুকলায় প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন পাবনা গভর্নমেন্ট এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র রাকিন নাওয়ার। এরপরই রাকিনকে নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপনে মেতেছিল ইউসিসি। অথচ খোজ নিয়ে জানা যায়, ইউসিসিতে “চ” ইউনিটের কোচিংই করানো হয়না।
ইউসিসির চটকদার বিজ্ঞাপন!
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউসিসি সহ অন্যান্য কোচিং গুলোর বিজ্ঞাপন চটকদার হলেও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে এসব কোচিং সেন্টারগুলো যথাযথ প্রস্তুতি নিতে বা পাঠদান দিতে পারছে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের এবং প্রশ্ন কমন আসার লোভ দেখিয়ে ইউসিসি ভর্তি কোচিংয়ে না পড়েও ‘মডেল টেস্ট’ প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোরও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে ইউসিসির বিজ্ঞাপন শুরু হলেও মূলত ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে চমকপ্রদ সব বিজ্ঞাপন সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুনে ছেয়ে ফেলে রাস্তা ঘাট। এর আগে অবৈধভাবে পোস্টার লাগানোর দায়ে ইউসিসিসহ ছয় কোচিং সেন্টারের লাইসেন্স বাতিল করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এরপরও রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় ব্যানার পোস্টার টানিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে কোচিং সেন্টারটি।
ইউসিসির লাগাম ছাড়া কোর্স ফি !
বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতিসহ না অভিযোগ থাকলেও প্রাচীন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় থাকে ইউসিসি কোচিং সেন্টারটি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। জানা যায়, ইউসিসিতে কোর্স ফি ক ইউনিট+জিকে-১৭০০০ টাকা, খ/ঘ ইউনিট-১৬০০০ টাকা, গ ইউনিট + জিকে-২০০০০ টাকা, গ ইউনিট ১৮০০০ টাকা, ক+খ ইউনিট ২৮০০০ টাকা, গ+খ -২৮০০০ টাকা।
২০২২-২৩ সেশনের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ইউসিসিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক সিহাব উদ্দিন বলেন, এইচএসসি শেষ হবে আর কিছু দিন পরে, সহজ কয়েকটা বিষয়ের পরীক্ষা বাদ আছে। ইউসিসিতে ভর্তির ডিটেইলস শোনার জন্য গেছিলাম। কোর্স ফি অনেক বেশি মনে হয়েছে। দেখি এখন আইকোন কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারি।