অভ্রর শুরু ২০০৩ সালে। আমি তখন নটর ডেম কলেজের ছাত্র। তখন কম্পিউটার আর টুকটাক প্রোগ্রামিং নিয়ে নেশা তুঙ্গে। জানলাম, একুশে বইমেলায় বায়োস (Bangla Innovation Through Open Source) নামে এক বাংলাদেশি সংগঠন থেকে কিছু ছেলেমেয়ে পুরোপুরি বাংলায় লোকালাইজ করা একটা লিনাক্স ডিস্ট্রো নিয়ে এসেছে। নাম বাংলালিনাক্স। মানে, সেখানে শুধু বাংলা লেখাই যায় না, সেই সঙ্গে সব উইন্ডোর টাইটেল, মেনু, ডেস্কটপ লেখা বাংলায়। কম্পিউটারে বাংলা মানেই তখন বিজয় আর প্রবর্তন। সেগুলো দিয়ে শুধু খুব দরকার পড়লে বাংলায় লেখালেখি করা যায়। কিন্তু এখানে আস্ত একটা অপারেটিং সিস্টেম বাংলায়! বইমেলা উপলক্ষে ওদের একটা সাইটও ছিল, সেটাও বাংলায়। আমার মুগ্ধতা আর কাটে না।
খুঁজে দেখলাম তারা একটা নতুন ফন্টও নিয়ে এসেছে, নাম ইউনিবাংলা। সেটা বিজয় দিয়ে লেখা যায় না। এর আগে ইউনিকোডের নাম শুনিনি, এই প্রথম ইউনিকোড কী সে সম্পর্কে কিছু জানলাম। আমি তখন ব্যবহার করি উইন্ডোজ। বাংলালিনাক্স আমার তেমন কাজে এল না, কিন্তু ফন্টটা নিয়ে পড়ে রইলাম। মজার জিনিস লক্ষ করলাম, মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে ইনসার্ট ক্যারেক্টার ব্যবহার করে ফন্টটা দিয়ে লেখার সময়—ক লিখে হসন্ত লিখে আবার ক লিখলে সেটা নিজে থেকে যুক্তাক্ষর হয়ে যাচ্ছে! অর্থাৎ বিজয়ে যুক্তাক্ষর লিখতে যেমন বিজয় সফটওয়্যার ও ফন্ট দুটোর ওপরেই নির্ভর করতে হয়, এখানে তেমন নয়, যুক্তাক্ষর বানানোর জন্য ফন্টই যথেষ্ট। যেহেতু মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ইনসার্ট ক্যারেক্টার ব্যবহার করে একটা একটা করে বর্ণ লেখা তেমন সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। মনে হলো এখন শুধু একটা কি-বোর্ড ইনপুট মেথড লাগবে। খুঁজে দেখলাম ইন্টারনেটে, বাংলার জন্য উইন্ডোজে কাজ করে এমন ইউনিকোডভিত্তিক ইনপুট মেথড নেই কোথাও। কিন্তু মনে হলো, আমি জানি কীভাবে বানাতে হবে! লেগে থেকে প্রোটোটাইপ বানিয়ে ফেললাম একটা।
অনেকেই জানেন না, অভ্রর প্রথম সংস্করণের নাম অভ্র ছিল না, ছিল ইউনিবিজয়। ইউনিকোড, ইউনিবাংলা ফন্ট, বিজয় কি-বোর্ডের ইউনিকোড সংস্করণ—সব মিলিয়ে তখন আর কোনো নাম মাথায় আসেনি। পরের ভার্সনেই নাম পাল্টে অভ্র দিয়েছিলাম। ডিকশনারি ঘেঁটে বের করা নাম, এর অর্থ আকাশ। এটা বিনা মূল্যের সফটওয়্যার হবে, সবার ব্যবহার করার স্বাধীনতা থাকবে—এসব ভেবে এ নামটাই সবচেয়ে পছন্দ হয়েছিল। অভ্রর সাইটের নাম ওমিক্রনল্যাব মাথায় এসেছিল মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সায়েন্স ফিকশন ওমিক্রনিক রূপান্তর বইটি পড়ে। লেজের সঙ্গে ল্যাব লাগিয়ে দিয়েছিলাম একটা ভারিক্কি ভাব আসে বলে, শুনলেই মনে হয় এখানে সিরিয়াস সব মানুষ সিরিয়াস সব কাজ করে!
কিন্তু সেই সিরিয়াস সাইটের হোস্টিং ছিল একটা ফ্রি হোস্টে (ট্রাইপড বা অন্য কিছু, এখন পুরোপুরি মনে নেই)। আমার প্রবাসী মামাকে অনুরোধ করে ডোমেইন নামটা কিনেছিলাম। মামা দেশে এসে বিয়ে করেছিলেন তার কিছুদিন আগে। বিয়ের ছবি তোলার গুরুদায়িত্ব ছিল আমার। omicronlab.com ডোমেইনটা যখন কিনে দিলেন, মামাকে খুশি করার জন্য সাইটে তাঁর বিয়ের ছবি দিয়ে একটা গ্যালারি বানিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে তাঁর বন্ধুবান্ধবকে দেখাতে পারেন। তার একটু নিচে ছিল একটা লিংক, যেখানে লেখা, ‘তুমি যদি এই সাইটে ইউনিবিজয়ের খোঁজে এসে থাকো, এখানে ক্লিক করো’। ব্যস, আর কিছু নেই।
মামার বিয়ের ছবিসহ অভ্রর সাইট বেশি দিন থাকেনি যদিও। খুঁজে দেখলাম, সারা বাংলাদেশে ইউনিকোড বাংলা ফন্ট একটা, সেই ইউনিবাংলা। কিন্তু ভারতে ফ্রি বাংলা ফন্ট প্রজেক্ট নামে ইউনিকোড ফন্ট বানানোর দারুণ একটা কাজ চলছে। তাদের মেইলিং লিস্টে অভ্রর (তখনো নাম ইউনিবিজয়) কথা লিখে মেইল করে জানালাম সবাইকে, ফন্ট বানান তাঁরা, লিখতেও হয় সেই ফন্ট দিয়ে নিশ্চয়ই। লেখার সময় চাইলে এই টুলটা তাঁরা ব্যবহার করতে পারেন, এইটা ছিল ভাষ্য।
একটা-দুইটা করে জবাব আসতে লাগল। বেশির ভাগের কথা একই, এই সফটওয়্যার তো শুধু ক্র্যাশ করে! আমার ঘুম বলতে কিছু নেই তখন। ডটনেট ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে বানানো, সেটাও তখন একেবারে নতুন, বেশির ভাগ ক্র্যাশও ওই কারণে ধরে নিলাম। এবার ডটনেট বাদ দিয়ে ক্ল্যাসিক ভিজ্যুয়াল বেসিকে নতুন করে লিখে ফেললাম আবার সব কোড। ক্র্যাশের ঝামেলা কমল। অভ্রর সাইটটা নতুন করে বানানোয় মন দিলাম। ই-মেইলে বারবার সবাইকে একই ধরনের কথা বলা লাগে, মামাকে আবার বললাম পয়সা দিয়ে শেয়ার্ড একটা হোস্টিং কিনে দিতে, ফ্রি হোস্টিংয়ে সীমাবদ্ধতা অনেক। সেটায় ফোরাম সেটআপ করলাম একটা, যেন সব কথাবার্তা আর প্রশ্নোত্তর একই জায়গা থেকে সবাই পড়ে নিতে পারে। সেই সময় আমি প্রজেক্টটাকে সিরিয়াসলি নেওয়া শুরু করেছি। কলেজপড়ুয়া একটা ছেলে বাসায় বসে বসে শখের বসে একটা সফটওয়্যার বানিয়েছে, এটা শুনলে কেউ পাত্তা দেবে না (আমার ‘আইটি বিশেষজ্ঞ’ আরেক প্রবাসী আত্মীয় এটার কথা শুনে অবজ্ঞাভরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ও! কত মেগা সাইজ?’, সাইজ দিয়ে উনি কী মাপতেন সেটা আমার কাছে এখনো স্পষ্ট না), কাজেই এ রকম কোনো ছাপ রাখা যাবে না। আমি চেষ্টা করতাম নিয়ম মেনে ভার্সন নম্বর বাড়ানোর, রিলিজলগ লিখতাম (যেখানে প্রতিটা ভার্সনে কী কী নতুন, সবকিছু লেখা থাকে, কেউ পড়ুক আর না পড়ুক), সাইটে নিউজ সেকশন আপডেট করতাম, ফোরামে সবাইকে মেইল করে জানাতাম, বিশাল বিশাল ইউজার ম্যানুয়াল লিখতাম সবকিছু ব্যাখ্যা করে। কাজ করতে করতে যখন মনে হতো কাজ শেষ, তখনই আবার নতুন কোনো আইডিয়া আসত। অথবা ঘুমাতে গিয়ে উঠে পড়তাম, হয়তো কোনো একটা ডায়লগ বক্সের নিচের বাটনগুলোর ডিভাইডারের দাগটা মাইক্রোসফট তাদের সফটওয়্যারে যেভাবে দেয়, আমি সেভাবে দিইনি, আরও ভালোভাবে করা যায়। অবসেশনের বাংলা কী এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, খুঁটিনাটি বিষয়ে নাছোড়বান্দার মতো নজর রাখা ছাড়া একটা কাজ ভালোভাবে করার আর কোনো ফর্মুলা আমার এখনো জানা নেই।
যারা আমাকে চিনত না, আমি শুনেছি তাদের অনেকের ধারণা ছিল দেশের বাইরে থেকে প্রফেশনাল সফটওয়্যার ডেভেলপারদের একটা গ্রুপ এই প্রজেক্টটা চালায়। এখন ফ্রি দিচ্ছে মার্কেটিংয়ের জন্য, পরে পয়সা নেবে। দেশ নিয়ে এই অবজ্ঞা কেন, আমি জানি না, যেন দেশে ভালো কিছু হতে পারে না। তা ছাড়া শখের প্রজেক্টেই-বা কী সমস্যা?
ওই সময়ে আমার সবচেয়ে পছন্দের দেশীয় কম্পিউটার ম্যাগাজিন ছিল কম্পিউটার টুমরো। যেমন কনটেন্ট, তেমন ঝকঝকে গ্রাফিকস। অভ্র শুরুর দিকের প্রচারণায় খুব বড় ভূমিকা ছিল ম্যাগাজিনটার। মারুফ ভাই ছিলেন ওটার সহসম্পাদক, অভ্রর ফোরামের মাধ্যমেই ওনার সঙ্গে পরিচয়। অভ্র নিয়ে একেবারে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে ফেলেছিলেন উনি কম্পিউটার টুমরো-তে। প্রতিটা ম্যাগাজিনের সঙ্গে সিডিতে ছিল অভ্রর একটা কপি। সে মাসে নিউমার্কেটের দোকানে দোকানে সিডিতে অভ্রসহ ম্যাগাজিন, কী যে দারুণ অনুভূতি! মনে হচ্ছিল রাস্তায় সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাই!
অভ্র সে অর্থে বড়সড় আয়োজন ছিল না কোনো দিনও। সত্যিই কাজ করতে চাইলে খুব বড় আয়োজন দরকারও হয় না বোধ হয়। অভ্রর ফোরামটার ভূমিকা অভ্রর জন্য ছিল অনন্য। শুরুতে বানানো হয়েছিল ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে, কিন্তু এই ফোরামের মাধ্যমেই অভ্র টিমের বাকি সবার সঙ্গে পরিচয়। প্রথমে পরিচয় হয়েছিল ওমর ভাইয়ের সঙ্গে, ধীরে ধীরে ফোরামের অ্যাডমিন হয়েছিলেন উনি। এলিফ্যান্ট রোডে ওনার নিজের বানানো সফটওয়্যার বিক্রির একটা দোকান ছিল, ‘বাঙ্গালিয়ানা’ নামে। সমমনা আর কাউকে চিনি না তখন উনি ছাড়া, সেই দোকানেই আড্ডা দিতে যেতাম। সেখানে রিফাতের সঙ্গেও পরিচয়। এখন অভ্রর যে ম্যাক ভার্সন, সেটা রিফাতের বানানো।
সিয়াম আর শাবাব ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ও ফোরামের মাধ্যমে। অভ্রর নিজের দুইটা ফন্ট সিয়াম রুপালি আর কালপুরুষ সিয়ামের বানানো। শাবাব ভাই কমিউনিটি সামলাতে ওস্তাদ লোক। দেশের বাইরে থেকে একজনই ছিল, নিপন। ও ভারত থেকে খোঁজ পেয়ে এসেছিল ফোরামে, পরে মডারেটর হয়ে যায়। মজার ব্যাপার, এত বছর পরেও আমাদের একটা গ্রুপ ছবি নেই, যেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। এর আরও অনেক পরে সারিমও যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে, অভ্রর লিনাক্স ভার্সন এবং https://avro.im সাইটের কাজ ওর করা। এমনকি আমার স্ত্রী (তখনকার বান্ধবী) সারা মাস অভ্রর অভিধানের দেড় লাখ শব্দ সম্পাদনা করে দিয়েছিল। আমি চেষ্টা করি এদের কথা সব জায়গায় বলতে। কারণ, শুরু করাটাই যথেষ্ট না, এদের একজনও না থাকলে অভ্র আজকে যেখানে আছে, সেখানে থাকত না।
যেকোনো কিছু অনেক বড়, অনেক বিখ্যাত হয়ে গেলে মানুষ শুরুর গল্প শুনতে চায়। অভ্র সে অর্থে বড়সড় আয়োজন ছিল না কোনো দিনও। সত্যিই কাজ করতে চাইলে খুব বড় আয়োজন দরকারও হয় না বোধ হয়। ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, আমার একটা নোটবুক ছিল। মাথায় যেসব প্রজেক্টের আইডিয়া আসত লিখে রাখতাম ওটাতে। হার্ডওয়্যার বা ইলেকট্রনিকস প্রজেক্টগুলো কখনোই করা হয়ে ওঠেনি, ওই সময় আমার পক্ষে নিজে নিজে সবকিছু জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। ক্লাস নাইনে উঠে বইপত্র জোগাড় করে প্রোগ্রামিংটা শিখে নেওয়ার পরে সফটওয়্যার ছাড়া আর কিছুর দিকে তাকানো হয়ে ওঠেনি, এখনও লেগে আছি। একটা কম্পিউটার আর ইন্টারনেট থাকলে আর কিছু প্রয়োজন হয় না। তবে দিন শেষে মনে হয়, প্রোগ্রামিংটা ইন্টারেস্টিং, অনেকটা সুপার পাওয়ারের মতো, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং সেই সুপার পাওয়ার ব্যবহার করে মানুষের কাজে লাগে এমন কিছু বানাতে পারা। যাঁরা সেই মজা পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতে পাবেন, সেই সব মানুষের জন্য ভালোবাসা।