সাইদ ভাইয়ের সকালের ফোনটা আমি গত চার বছর ধরে মিস করি। রিপোর্ট ছাপা হওয়ার সকালে সাইদ ভাইয়ের ফোন মানেই অবধারিতভাবে বকা খেতে হবে। প্রশংসাও জুটতো – কিন্তু সেই ভাগ্য খুব কমই হয়েছে। সকালের ওই ফোনটা এখন কেবল ভালোবাসা আর স্নেহের পরম স্মৃতি হয়ে থেকে গেল।
টেলিকম এবং ডিজিটাল সেবা নিয়ে ওনার এমন অবস্থান যে কোনো রিপোর্টারের পক্ষে ওনাকে সন্তুষ্ঠু করা ছিল এক কঠিন কাজ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বকাবকি করলেও ওনার ওনারশীপ আমার মতো রিপোর্টারের ওপর ছিল। সে কারণে আবার পাবলিকলি সুপার হিরো টাইপ পজিশন দিতেন।
সত্যিকারের কাজের মানুষটাকে ওউন করবেন – ভালোবাসা দেবেন আবার বকাবকির চূড়ান্ত করবেন এই না হলেন আমাদের সাইদ ভাই! রিপোর্টারকে আইডিয়া দেবেন, সঙ্গে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আর যুঁতসই কড়া একটা কমেন্ট দেবেন আর তার ওপর সংশ্লিষ্ট জানাশোনা মানুষের সঙ্গে রিপোর্টারের আলাপ করিয়ে দেবেন – এই তো আমাদের আবু সাইদ খান।
যে দুই চারবার দেশের বাইরে এক সঙ্গে গিয়েছি – সাইদ ভাই অবধারিতভাবে অভিভাবক হয়েছেন। কোথায় ভিন্ন রুচির খাবার খাওয়াবেন, কোন সেমিনারে থাকা উচিৎ, কোথায় বেড়াতে যাওয়া দরকার – সব বলে দিয়েছেন নির্দেশের মতো করে। একবার তো ওয়ার্ল্ড মোবাইল কংগ্রেসে যাওয়ার আগে হোটেল পাচ্ছিলাম না। সাইদ ভাই তার এক উরুগুয়ান বন্ধুর বাসায় থাকার আয়োজন করলেন। উরুগুইয়ান যে বন্ধু, সেও এয়ারবিএনবি’র মাধ্যমে বাসা ভাড়া করতে গিয়ে ওনার বন্ধু হয়েছেন। সেবারেই ছোট্ট একটা দূর্ঘটনায় সাইদ ভাইয়ের পা মচকে গেল। দক্ষিন আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের সেই মানুষটাই যে কিভাবে সাইদ ভাইয়ের পায়ের যত্ন নিলেন বিস্ময়কর! সেই সম্মান আসলে তিনি আদায় করে নিয়েছিলেন। বিদেশি বন্ধুরা, বিশেষ করে নন-এশিয়রা, ওনাকে আবু নামেই বেশী জানতেন। গত কয়েকদিন সাইদ ভাইয়ের তিন-চারজন বন্ধু তো নিয়মিত ভিত্তিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ওনার খোঁজ নিয়েছেন। তাদের মধ্যেও দেখেছি প্রিয়জন হারানোর বেদনা।
তিনটা ওয়ার্ল্ড মোবাইল কংগ্রেসসহ আরো কয়েকটা অন্যান্য আন্তর্জাতিক আয়োজনে সাইদ ভাইকে দেখেছি। সাদা চামড়ার পোড় খাওয়া টেলিকম এক্সপার্টরাও যেভাবে ওনার খাতির করেছেন – নির্দ্বিধায় বলছি, বাংলাদেশের আর কেউ কখনোই এতোটা সম্মানের সঙ্গে গৃহীত হননি – অন্তত টেলিযোগাযোগ ও সংশ্লিষ্ট সেবা খাতে।
স্থলভাগ দিয়ে ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে এশিয়াকে যুক্ত করার ‘এশিয়ান টেরিস্টোরিয়াল কেবল লিংক’ এর ধারণা সাইদ ভাইয়ের দেওয়া – যা উন্নত বিশ্বের কাছেও সমাদ্রিত হয়েছে। এই কেবলের মাধ্যমে এশিয়াকে এক সুঁতোয় গাঁথার প্রচেস্টার উদ্যোগ নিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সস্মানও তিনি বহুগুণে বাড়িয়েছেন। এই হলেন আমাদের সাইদ ভাই।
প্রথমবার সাইদ ভাই ফোন করে ডেকে নিয়েছিলেন আমার একটা রিপোর্ট দেখে। ওই রিপোর্টের ফলোআপ কিভাবে কি প্রক্রিয়ায় হতে পারে – সে সবই ছিল আমাদের প্রথম সামনাসামনি আলাপের বিষয়। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই আলাপটা ব্যক্তিগত থেকে পারিবারিক পর্যায়ে চলে গেল। অফিসে গেলে খাওয়াতেন এনার্জি বিস্কুট আর লাল চা। বাসায় গেলে ভুরিভোজের মহা আয়োজন। পরিস্কার বলে দিতেন প্রথমটা অফিসের খরচ। বলার অপেক্ষা রাখে না, দ্বিতীয় আয়োজনটা ব্যক্তিগত। মোবাইল টেলিকম অপারেটরদের কেতাদূরস্ত সিইওদের বোর্ড মিটিংয়েও এনার্জি বিস্কুটের বেশী খাওয়াতে তিনি রাজি ছিলেন না।
সাইদ ভাইয়ের বকাবকি থেকে বাঁচতে মাঝে মাঝে যে ভাবীর সাহায্যও নিতাম, তিনি কয়েক বছর আগে ক্যানসারে কাছে পরাজিত হন। অদৃষ্টের কি খেলা সাইদ ভাইও হার মানলেন ক্যানসারের কাছে। ক্যানসারের সঙ্গে অবশ্য তার লড়াইটা ছিল অল্প দিনের; কিন্তু সে লড়াইয়ে তেঁজ ছিল। নিজের অসুস্থতার কথা কখনোই আরেকজনকে জানতে দিতেন না। কখনো জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যেতেন।
ঈদের সপ্তাহ দুয়েক আগে হাসপাতালের বিছানায়ই তখন তার সময় কাটছে। প্রতিবারই দেখি আগের চেয়ে অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আগের অনেক কিছুই আর মনেকরতে পারেন না। শেষ দিকে দেখতাম মানুষও চিনতে পারছেন না। এক দিন তো কয়েকবার জানতে চাইলাম – সাইদ ভাই চিনতে পারছেন? ঘন্টাখানেক থাকার পর একবার বললেন – ‘না চিনে উপায় আছে।’ বুঝলাম এটা চিন্তা করেও বের করতে অনেকটা সময় আর পরিশ্রম করতে হয়েছে ওনাকে।
সাইদ ভাইকে কেন্দ্রে রেখে আমরা কয়েকজন বন্ধু একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত ছিলাম। সেখানে তিনিই ছিলেন আমাদের ‘পীর’। আসলেই পীর হিসেবে মানতাম আমরা তাকে। নানান বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি দুষ্টমি, ঝগড়াঝাটি সবই আমরা করেছি। বয়সের এতোটা ব্যবধান আমাদের ছিল কিন্তু বন্ধু হতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। এই হলেন সাইদ ভাই।
গত কয়েক মাস আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার কয়েক বন্ধু বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। কেউ পড়াশোনা করতে, কেউ স্থায়ীভাবে বিদেশে বাস করতে। সে সময় বেশ মন খারাপ ছিল। তেমনই একটা সময়ে সাইদ ভাই একদিন বলছিলেন – “তুমি তো দেখি প্রেমিকা হারানোর শোক পেয়েছো।” আসলেই আমি তখন শোক পেয়েছিলাম। তবে সাইদ ভাইয়ের মতো বন্ধু হারানোর শোক তো প্রেমিকা হারানোর চেয়ে বড় শোক। এটা কিভাবে কাটাই?
এই শহরে বন্ধু হারানো যে কতো কষ্টের, যারা হারায় কেবল তারাই জানে। আর সেই বন্ধু যদি হয় সাইদ ভাইয়ের মতো আধুনিক চিন্তা ও মননের, রাজনৈতিক ভাবে চূড়ান্ত রকমের সচেতন অথচ প্রযুক্তি জ্ঞানে ঋদ্ধ। উচ্চ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এবং চারিপাশে ভালোলাগার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন – তাহলে হাহাকারটা তো আরো বেশীই হয়।
লেখক : জাহিদুল ইসলাম সজল (হেড অফ কমিউনিকেশন, নগদ) এর ফেসবুল ওয়াল থেকে সংগৃহীত