শেহরীন সহিদ হৃদিতা, চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম ডটটিভি// আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের দেশ, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, এই বাংলাতেই আমাদের সংস্কৃতি। আর এই বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি-ই আমাদের বাঙ্গালি সত্ত্বার ধারক-বাহক। বাঙালির এই সংস্কৃতি চিরকালই সার্বজনীন, চিরকালই অসাম্প্রদায়িক। এখনো আমাদের দেশে সব স্তরের মানুষেরা , সব ধর্মের মানুষেরা একসাথে নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়। একসাথে হাসে, একসাথে কাঁদে , একসাথে গায় প্রাণের গান। উৎসবে-পার্বণে , আজ-ও এখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রকে নয়, বরং মানুষ ও মানবতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আজও তাই বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। যে উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব। এই উৎসব বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।
পহেলা বৈশাখ,বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বাঙালী জাতির ঐতিহ্যবাহী এই দিনকে বর্ষবরণের দিন বলা হয়। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও ত্রিপুরায় বাঙলিদের মধ্যে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে। আর গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিশেষ দিনগুলোর সমন্বয় আনতে বাংলা একাডেমি নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করে। সে অনুযায়ী বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই ছয় মাস ৩১ দিনে হবে। ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল অধিবর্ষের বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হবে।
‘আমি কে, আমি পারিনে চিনতে আজ
কি অবাক কি অবাক।
পুরোনো আমাকে নতুন নতুনে
সাজিয়েছে বৈশাখ
দুচোখ আমার নতুন নীলিমা
নতুন পৃথিবী ডাকে
দেখি বার বার উৎসব দিনে
বাংলায় বাংলা।’–সৈয়দ শামসুল হক।
আসলে এই পহেলা বৈশাখের ইতিহাসটা বেশ প্রাচীন। অবিভক্ত বাংলায় মোঘল শাষণ আমলে মোঘল সম্রাট আকবর এই বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন করেন।অবশ্য কয়েকজন ঐতিহাসিক বাঙ্গলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর। তবে পরবর্তীতে যে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন, তা সুনিশ্চিত। এর আগ অবধি বছর হিসেব করা হতো হিজরী বা চান্দ্রপক্ষ মোতাবেক অর্থাৎ চাঁদের উদয়-অস্ত যাওয়ার উপর নির্ভর করতো মাস এবং বছরের হিসেব।তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ, ”আর্তব উৎসব” বা ”ঋতুধর্মী উৎসব” হিসেবে পালিত হত। এই উৎসবের সৃষ্টির পিছনে কারন ছিলো মূলত জমিদারের খাজনা আদায়ের সুবিধা,তখন-ও এটি সার্বজনীন হয়ে উঠেনি।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটদের হিজরী বর্ষ পঞ্জিকা অনুসারে কাজ করতে হতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না।ফলে কৃষকের খাজনা আদায়ের সাথে ফলনের সময়ের মিল থাকতো না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। আর তাই খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর এই প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন একটি সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন; আর তাই বাংলা সন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে। প্রথমে বাংলা সনের মূল নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহী। পরে সবার সুবিধার্থে এই সনের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সন। তারিখ-এ-এলাহী অনুযায়ী বছরের বারো মাসের নাম ছিল যথাক্রমে_ “কারবাদিন, আর্দি, বিসুয়া, কোর্দাদ, তীর, আমার্দাদ, শাহরিয়ার, আবান, আজুর, বাহাম ও ইস্কান্দার মির্জা।”
পরে তা পরিবর্তন করে “বঙ্গাব্দ” বা ”বাংলা বর্ষ” নামে অভিহিত করা হয়। আর এই বছরের বারো মাসের নামকরণ সম্পর্কে ধারনা করা হয় যে_ এগুলো বারোটি নক্ষত্রের নাম থেকে উদ্ভুত। অর্থাৎ, “বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র।”
তবে বঙ্গাব্দ শব্দটি ব্যবহার এবং গৃহীত হওয়া নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা আছে এখনো। এমনকি, আকবরের সময়কালের কয়েক শত বছর পূর্বে দুটো শিব মন্দিরে এই শব্দটির প্রমাণ পাওয়া যায়, যা বলছে বাংলা দিনপঞ্জির অস্তিত্ব আকবরের সময়ের পূর্বেও ছিল!
কিন্তু, মূলত আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উৎসবের মতো উদ্যাপন করা শুরু হয়। প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনের মধ্যে সকল খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এর পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে জমিদাররা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রজাদেরকে মিষ্টান্ন এবং ফলাহারের মাধ্যমে আপ্যায়ন করতেন। আর এই উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন আমোদ-প্রমোদের আয়োজনও করা হত।তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ এবং সংশ্লিষ্ট শুল্ক আদায়।অর্থাৎ, তখন এই উৎসবটি শুধু জমিদার আর প্রজাদের মধ্যেই সীমিত ছিলো। কিন্তু এখন এই উৎসবটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে একটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
তবে এই অতিক্রমের পথটাও কিন্তু বেশ দীর্ঘ। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, সর্ব প্রথম আধুনিক ভাবে নববর্ষ পালিত হয় ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে! সে বছর পহেলা বৈশাখে কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও একই কাজ করা হয়। কিন্তু সাড়ম্বরে বাঙালি সমাজে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রচলন শুরু হয় কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।আসলে এই ঠাকুরবাড়ি থেকেই পহেলা বৈশাখ, নবান্নের উৎসবসহ নানারকম পালাপার্বণ ও বিবিধ কৃষ্টি কালচার উদযাপনের উৎপত্তি। নববর্ষে নতুন কাপড় পরা এবং গুরুজনদের প্রণাম করার রীতি এবং আনন্দ আয়োজনের শুরু ওখান থেকেই।
১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভাগের পরে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা জারি করতে শুরু করে। এই অবজ্ঞার প্রতিবাদস্বরূপ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন‘ছায়ানট’এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি বাজিয়ে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়। সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখতে আজও রাজধানীর রমনার বটমূলে প্রতি নববর্ষের প্রথম প্রহরে একইভাবে স্বাগত জানানো হয় ১লা বৈশাখকে। ২০১৬ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেস্কো বাংলা নববর্ষকে স্বীকৃতি দেয়।
স্বাধীন বাংলায় আজ এই পহেলা বৈশাখ পালিত হয় মহা সমারোহে। প্রাচীন সময়ে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ খাজনা আদায় করার লক্ষ্যে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেছিলেন। আর সেই সঙ্গে তখনকার বণিক সম্প্রদায় তাদের বকেয়া পাওনা আদায় করার জন্য হালখাতা নামক অনুষ্ঠানের রীতিও চালু করে। এখনকার পহেলা বৈশাখেরও প্রধান ঘটনা হলো হালখাতা শুরু করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন এবং শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।
পহেলা বৈশাখের দ্বিতীয় আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলাকায় আয়োজন করা হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ঢাকা শহরে এটি প্রবর্তিত হয়। ১৯৮৯ সালে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন স্বরূপ এই মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এই শোভাযাত্রায় বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙ-এর মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর বিশাল আকৃতির পুতুল-প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেত হয়।
বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনের ফলে ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ জাতিসংঘের সংস্কৃতি,শিক্ষা এবং ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তথা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।
পহেলা বৈশাখের আসলে মূল আগ্রহবিন্দু রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানট কর্তৃক আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।সেই ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু হয়ে আজ অবধি এই ঐতিহ্য চলে আসছে।পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে রবি ঠাকুরের সেই পরিচিত গান গেয়ে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত জানান।
সারাদিন ব্যাপী চলে বর্ণাঢ্য আয়োজন, যা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরে সবার সামনে।
গ্রামেও এই দিনের আনন্দ অন্য মাত্রা লাভ করে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে,বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং সুন্দর করে সাজানো হয়। এরপর, নতুন জামাকাপড় পরে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায় সবাই।পহেলা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা।কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন।একইসাথে এই দিনে বাঙালীদের ঐতিহ্যবাহী নানা খাবার-দাবারের আয়োজন-ও হয় ঘরে-বাইরে। সকালবেলা পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজার সুবাসিত ঘ্রাণে মৌ মৌ করে উঠে চারিদিক। এর-ই সাথে আছে নবান্নের নতুন চাল আর নলেন গুড়ের তৈরি হাজারো রকম পিঠা , পুলি, পায়েসের সমাহার।আর গ্রাম বাংলার নববর্ষের দিনে একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি বা বলী খেলা অন্যতম।
সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুর জেলা-ও মেতে উঠে নববর্ষের আনন্দে। চাঁদপুর জেলায় প্রতিবছর-ই জেলা প্রশাসন এবং বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক এবং আলোচনা অনুষ্ঠান। এছাড়াও জেলার নানা স্থানে বসে অসংখ্য প্রাচীন এবং স্বাধীনতাত্তোরকালীন বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মেলা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ “বাবুরহাট বাজার মেলা, বড় ষ্টেশন মোলহেডে জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত পহেলা বৈশাখ মেলা, ফরিদগঞ্জের চৈত্র সংক্রান্তি এবং বৈশাখী মেলা” ইত্যাদি।
এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ও এদিনকে সামনে রেখে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান।
শুধু বাঙালীরাই যে এই নববর্ষের উৎসব পালন করে তা কিন্তু নয়। দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা-ও নানা আচার-আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষ বরণ করে নেয়। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। একত্রে ওদের এই বর্ষবরণ উৎসবকে “বৈসাবি” বলে।এছাড়াও মারমাদের পানি খেলাও তাদের কাছে নববর্ষের এক উল্লেখযোগ্য আনন্দ আয়োজন।
প্রতিবছর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে দেশীয় শাড়ি,গয়না, মৃৎশিল্পসহ নানা দেশিয় কুটির এবং মাঝারি শিল্প পল্লীগুলো। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে চারিদিকে যেন সাজ-সাজ রব পড়ে যায়। দেশীয় সাজপোশাকে যেমন সেজে উঠে বাংলা , তেমনি ঘরে বাইরে ব্যবহৃত হয় দেশীয় তৈজসপত্র আর সাজ-সরঞ্জাম। লাল-সাদায় মেতে উঠে পুরো বাংলাদেশ। পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে ছোট থেকে বড় সব প্রতিষ্ঠানগুলোই নিজেদেরকে সাজিয়ে তোলে নতুন আঙ্গিকে, নতুন পরিকল্পনা তৈরি করা হয় এই দিবসকে মাথায় রেখেই। তাঁতিপল্লিতে, গয়নার কারখানায় কিংবা মৃৎশিল্পের পল্লীগুলোতে এই সময়ে অর্থাৎ প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের অনেক আগে থেকেই কারিগরদের দম ফেলার সময় হয় না।
কিন্তু এবার দেশের বিরূপ পরিস্থিতির কারণে দেশে হচ্ছে না জনসমাগমের মাধ্যমে কোনোরকম উৎসব। গতবছরের মতো এবারও বন্ধ রাখতে হচ্ছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার বটমূলে সমস্বরে তোলা গান। গৃহবন্দী অবস্থায় পালিত হবে এবারের পহেলা বৈশাখ। ফলে দু’বছর ধরে বন্ধ থাকার কথা ছিলো এসময় উপলক্ষ্য করে করা সমস্ত কাজ। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা ছিলো ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ীদের, মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের। কিন্তু দৃশ্যপটটা বেশ অন্যরকম।
দেশীয় পন্যের চাহিদা এই করোনাকালীন সময়ে বেড়েছে বহুগুণে। চাঁদপুরের কুমারপল্লীতে গিয়ে দেখা যায় তারা ব্যস্ত মাটির হাঁড়ি, কলস এবং সরা তৈরিতে। তারা জানান, “অনলাইনে ই-কমার্স প্রসারের ফলে তাদের বিক্রি এখনো চালু রয়েছে, হাতে নতুন কাজ-ও আসছে।”
সত্যি-ই এই করোনাকালীন সময়ে ই-কমার্স এবং এফ-কমার্সের উন্নয়নের ফলে দেশীয় পণ্যের প্রচার এবং প্রসার ঘটছে দ্রুত।আর দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তারা বর্তমানে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের থেকেই সংগ্রহ করছেন দেশীয় পণ্যগুলো। অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিধার জন্য ক্রেতারা এদিকেই আগ্রহ অনুভব করছেন বেশি। ফলে, গৃহবন্দী এই সাদামাটা নববর্ষকে একটু আনন্দময় এবং রঙ্গিন করে তুলতে অনলাইন-ই হচ্ছে বেচাকেনা। ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশীয় পন্যের প্রসার ঘটেছে আর তার কল্যানেই এখনো চলছে তাঁতিদের তাঁতকল, গয়নার কারখানা থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে, কাঠের চাকায় অনবরত ঘুরছে কাদামাটির তাল।
আবার সেই বৈশাখ এসেছে। আমাদের অপরাজিত পূর্বপুরুষের মতো আমরাও এখন এগিয়ে চলছি দ্রীপ্ত পায়ে। বৈশাখ শেখাবে আমাদের বজ্রের ভাষা,রৌদ্রের বর্ণমালা। আবার-ও নতুন ভাবে জন্ম নেবো আমরা, নতুন করে বাঁচার জন্য।
এই বাংলা আমাদের , এই সংস্কৃতি আমাদের। এই বাংলার সংস্কৃতিতে মিশে আছে ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা। এই মাটিতে রক্ত, বরকত-সালামদের। এই বাতাসে মিশে আছে রুমি-আজাদের দীর্ঘশ্বাস। অথচ আজ কার বা কাদের করাল থাবার ঘাতে চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাঙালী সত্ত্বা। আজ উঠুক আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে প্রবল ঝড়, খরবায়ু উড়িয়ে নিয়ে যাক সকল গ্লানি, সকল জরাকে। আবার এই বাংলায় বৈশাখ আসুক, তার অগ্নিস্নানে মুছে যাক সকল বেদনা আর মালিন্য। এসো হে বৈশাখ, তোমারই প্রতীক্ষায় আবারও উন্মত্ত এ বাংলা!
শুভ নববর্ষ, ১৪২৮।