প্রায় ২০০ বছর আগের গল্প। লোকমুখে শুনা যায়, সিরাজদিখান থানার সন্তোষপুর গ্রামে সেকালে রাত জেগে মাটির চুলায় কেজি কেজি দুধ জ্বাল করত ঘোষ বাড়ির কারিগরেরা। তারপর ঘন হয়ে আসা দুধে সামান্য চিনি ও হলুদ গুড়া মিশিয়ে মাটির পাত্রে ঢেলে দিতো। ঠান্ডা হওয়ার পর কলা পাতায় মুড়িয়ে দিতো। এভাবেই জন্ম পাতক্ষীরার।
পাতক্ষীরা এক ধরনের মিষ্টান্ন,যা খাবার শেষে দইয়ের মত পরিবেশন করা হয়।দইয়ের মত পরিবেশন করা হলেও এর স্বাদ ছিলো একদম ভীন্নধর্মী।
প্রায় ৬ কেজি দুধ জ্বাল করে ১ কেজি পাতক্ষীরা বানানো হয়।পাতক্ষীরা নামটার একটা বিশেষত্ব আছে।
ক্ষীরা বানানো পর একে ঠান্ডা করে কলা পাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয় বলেই এর নামকরন করা হয়েছে পাতক্ষীরা।
লোকমুখে শুনা যায়,২০০ বছর আগে সিরাজদিখান ছিলো জমিদার ও বাবুদের এলাকা। সে সময় প্রায় অনেক স্বচ্ছল পরিবারেই গাভী পালন করা হত,তার মধ্যে একটা স্বচ্ছল পরিবার ছিলো ঘোষবাড়ি।ঘোষবাড়ির গাভীদের বালতি উপচে পরা দুধ পরবারের কেউ খেয়ে শেষ করতে পারতো না। তখন থেকেই দুধকে ঘন করে জ্বাল দিয়ে ক্ষিরা বানানো হত।প্রথমে পাতলা করে ক্ষীরা বানিয়ে পরিবেশন করলেও পরে খেয়াল করে দেখলো, দুধ যত জ্বাল দিয়ে শুকানো হয়, তত বেশি মজার হয় এই খাবারটা খেতে। সেই দুধ শুকানোর প্রকিয়া থেকেই, কলাপাতায় মোড়ানো পাতক্ষীরার জন্ম।
সেসময় পাতক্ষীরা ছাড়া বাবুদের কলকাতার সাথে বানিজ্যের আড্ডাই জমত না। প্রতিবার কলকাতায় বানিজ্য করতে যাওয়ার সময় মিষ্টান্ন হিসেবে নিয়ে যাওয়া হত এই পাতক্ষীরা। এমনকি এখনো প্রতিবছর ২৫ শে ডিসেম্বর বিদেশী কূটনীতিকদের আপ্যায়ন করতে বঙ্গভবনে পাতক্ষীরা থাকে।
লোকমুখে শুনা যায়,ঘোষবাড়ির সন্তান প্রয়াত সুনীলচন্দ্র ঘোষের হাত ধরে শুরু হয় পাতক্ষীরার প্রচলন।
আবার অনেকে এ ও বলেন, পুলীনবিহারী নামক এক ব্যাক্তী তার স্ত্রী কে নিয়ে প্রথম পাতক্ষীরা বানান।
তবে কালক্রমে এই বিখ্যাত খাবারের প্রচলন ধরে রেখেছে এখনো ঘোষবাড়ির ছেলেরাই।ঘোষবাড়ির বংশ পরম্পরা হিসেবে ধরে রাখা হয় এই পাতক্ষীরা তৈরির প্রকিয়াকে। ঘোষবাড়ির ছেলেরা এবং বাড়িতে বউ আসা প্রতিটা মেয়েদের বাধ্যতামূলত শেখা লাগবে পাতক্ষীরা তৈরির প্রক্রিয়া। এ সম্পর্কে ঘোষবাড়ির কর্তারা বলেন, “যত শিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিতই হোক না না,পরিবারের মেয়ে,বউ সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে শেখা লাগবে পাতক্ষীরা তৈরির প্রক্রিয়া।” বাড়ির মেয়েরা না শিখলেও, বউ হয়ে আসা প্রতিটা মেয়ে ঠিকই রপ্ত করে নিয়েছে পাতক্ষীরা তৈরি কে।
বর্তমানে সন্তোষপুর গ্রামের প্রায় ৭ টি পরিবার এই কাজের সাথে জড়িত। তবে সবচেয়ে জমজমাট ঘোষ বাড়ির পাতক্ষীরাই।
প্রতিবছর কলকাতা সহ বিভিন্ন দেশে এই পাতক্ষীরা পাঠানো হয়।অনেক পরিবারেরই বিদেশে অবস্থানরত সদস্যদের জন্য প্রতিবছর পাঠান পাতক্ষীরা। ফ্রান্স,জার্মান,ইতালি সহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে প্রসেসিং এর মাধ্যমে নিয়মিত যায় পাতক্ষীরা,এমনটাই বলেন পাতক্ষীরা বিক্রেতারা।
পাতক্ষীরা বিভিন্ন ভাবে খাওয়া যায়।খাবার শেষে দইয়ের মত খায় অনেকে,অনেকে আবার একে পাটিসাপটার ভেতরের পুর হিসেবে ব্যবহার করে।আমের ঋতুতে মুড়ি,আমা,পাতক্ষীরা মেখে খাওয়ার ও বেশ প্রচলন আছে মুন্সিগঞ্জে।
মুন্সিগঞ্জ জেলা অতিথি আপ্যায়নের দিক থেকে সেরা।জামাই আদর থেকে শুরু করে দূর দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয় স্বজন পর্যন্ত সবাইকে পাতক্ষীরা খেতে দেওয়া হয় খাবারের শেষ পাতে।
কালের স্রোতে মুন্সিগঞ্জ থেকে অনেক ঐতিহ্যবাহী পণ্য হারিয়ে গেলেও পাতক্ষীরা বেশ নাম ডাক নিয়েই টিকে আছে।তবে পাতক্ষীরার কারিগরদের ধারনা,সরকার থেকে সহায়তা এবং যাথাসাধ্য প্রচার করলে পাতক্ষীরা ব্যবসায়ের দিক থেকে বেশ জমজমাট থাকবে।
বর্তমানে বেশ কিছু তরুন তরুনী ই-কমার্সের মাধ্যমে পাতক্ষীরা বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে।তবে মুন্সিগঞ্জ থেকে খাবার পাঠানোর মত কুরিয়ার সার্ভিসের সুব্যবস্থা না থাকাতে অনেকেই পিছিয়ে পরছে।এইরকম কোন শক্তপোক্ত ব্যবস্থা যদি থাকা পাতক্ষীরা পাঠানোর মত,তাহলে ই-কমার্সের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলার জনপ্রিয় হয়ে উঠবে মুন্সিগঞ্জের এই বিখ্যাত খাবারটি,এমনি ধারনা করেন পাতক্ষীরা নিয়ে ব্যবসায়ের চিন্তা করা তরুন তরুনীরা।
লেখক,
ফারিয়া ওমর ঝুমুর
স্বত্বাধিকারী: কারূঘর