ফারিয়া ওমর ঝুমুর, মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি, টেকজুম ডটটিভি// অনেক আগের কথা, প্রায় ১০০ বছর আগে গ্রামবাংলায় মাটির ঘর-বাড়ি দেখা যেত,সে ঘরের পেছনে দেখা যেত অজস্র বাশের ঝোপ। এই চিত্র তখন মুন্সিগঞ্জের গ্রামবাংলায়ও অনেক দেখা যেত। গ্রামের চারপাশে অসংখ্য ঝোপ-ঝাড়।ছোট ছোট বাচ্চারা তখন তাদের দুরন্ত শৈশব কাটাতো মাঠ,ঘাট,বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে।বাড়ির পেছনের ঝোপ থেকে থোকায় থোকায় পেকে যাওয়া এক প্রকার ফল এনে লবন মরিচ পুড়িয়ে মজাদার ভর্তা বানিয়ে খেতো তারা।ফলের নাম ছিল বেতন।
বাশের ঝোপ-জঙ্গলে অযত্নে অনেক গাছ বেড়ে উঠতো।যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যেতো বেত গাছ। সে গাছের ফলকেই বলা হতো বেতন।অযত্নে বেড়ে উঠলেও সে বেত ছিলো অনেক কাজের।
বাড়ির গৃহিনীরা অবসর সময়ে সে বেত দিয়ে বানাতো নানা রকম শৌখিন সামগ্রী।যদিও তখন সেগুলো তাদের নিকট প্রয়োজনীয় বস্তুই ছিলো। শৌখীন সামগ্রীর মধ্যে ছিলো বেতের মোড়া,ঝুড়ি,নামাযের পাটি,টুকরি,হাতপাখা,শীতলপাটি ইত্যাদি।
দেশ স্বাধীন হলো,গ্রামবাংলার দৃশ্যপট পাল্টে গেলো,বাড়ির পেছনে ঝোপ-ঝাড় বিলীন হওয়া শুরু হলো।কিন্তু মুন্সিগঞ্জের বেত শিল্প রয়ে গেলো শিল্পীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।ক্রমে ক্রমে মুন্সিগঞ্জের ঐতিহ্য হয়ে দাড়ালো এই বেত শিল্প।
বেত এর ব্যবসা আর্থিক উপার্জন থেকেও বেশি ছিলো তাদের কাছে বংশ পরম্পরা হিসেবে ধরে রাখা।তাইতো বেত ঝাড় বিলীন হলেও, ঠিকই টিকে থাকলো বেত শিল্প।
বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানার বিভিন্ন ইউনিয়নে এখনো বেত শিল্প বেচে আছে।তবে সিরাজদিখান থানার রাজানগর ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের মনিপাড়ায় এখনো বেত শিল্পকে আগলে রেখেছে বংশ পরম্পরা হিসেবে। মনিপাড়ার প্রায় ৪০ টির ও বেশি পরিবার এখন বেত শিল্পের সাথে জড়িত।তথ্যসূতে জানা যায়,তারা প্রধান জীবিকাই নির্বাহ করে বেত এর পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে।
সেখানকার এক বেত পণ্য ব্যবসায়ী হ্নদয় দাস জানান,স্বাধীনতার পর থেকেই তারা বেত শিল্পে জড়িত। প্রথমে তার দাদা,তারপর তার বাবা,এখন সে ও বেত এর ব্যবসা করেন।এক একটা বেত এর তৈরী পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে তাদের খুব সীমিত লাভ হয়,তবুও তারা ধরে রাখতে চান বেত শিল্পকে। গ্রামে এখন আর বেত এর ঝোপ না পাওয়ার কারনে, বেতের কাচামাল কুষ্টিয়া,খুলনা সহ বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করে থাকেন তারা।
তাদের বানানো বেত এর সামগ্রী ঢাকার এলিফেন্ট রোড,গাউছিয়া মার্কেট,আড়ং সহ বিভিন্ন জায়গায় যায়,এমনকি বৈশাখী মেলার ও একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে তাদের বেত এর পণ্যসামগ্রী।
কিন্তু বর্তমানে করোনা মহামারীর কারনে কোন মেলা হয় না,কমে গেছে বিভিন্ন মার্কেটেও তাদের বিক্রি। ফলে ব্যবসায় খুব খারাপ পরিস্থিতিতে যাচ্ছে।কর্মীদের বেতন দিতে,এমনকি নিজেদের সংসারের খরচ মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে অনেক বেত এর পণ্য ব্যবসায়ী।
অন্যদিকে মনিপাড়ার আরেকজন ব্যবসায়ী নিরঞ্জন দাস জানান,বেত শিল্প নিয়ে তার অধীনে অনেক কর্মাচারী কাজ করেন।মাসে লাখ লাখ টাকার বেত পণ্য তিনি শুধু আড়ং এর শো রুমেই পাঠান।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,সরকার থেকে কোন ঋন গ্রহনের সুবিধা পান না। চাইলেই বাড়ির পাশে একটা বেত এর ব্যবসায়ের জন্য কারখানা দিতে পারছেন না অর্থের অভাবে। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়ি,বাড়ির আশেপাশে পরিত্যাক্ত জায়গাকেই বেছে নিয়েছেন বেত পণ্য বানানোর কাজে।
মনিপাড়ায় বানানো বেত পন্য রাজধানীর বিভিন্ন শো রুমের শোভা বাড়ালেও পিছিয়ে আছে জেলার মানুষদের কাছ থেকে। মুন্সিগঞ্জের একদম শেষ পর্যায় মনিপাড়া গ্রাম থাকার কারনে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং যোগাযোগের অভাবে জেলার অনেকেই জানেন না বেত শিল্প নিয়ে। এমনকি অনেকে এটাও জানেন না,বেত শিল্প এখনো মোটামুটি সচল।
বেত শিল্পের ব্যবসায়ীদের মতে,তারা চায় তাদের শিল্পের অনেক প্রচার হোক।মুন্সিগঞ্জ জেলার আনাচে কানাচে সবাই জানুক তাদের ঐতিহ্যের কথা।
বর্তমানে ই-কমার্স এর উদ্যোক্তাদের প্রশ্ন উঠাতে তারা জানিয়েছে,বড় পরিসরে বিক্রি করলেও,তারা জেলার নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প মূলধনে বেত পণ্য দিতে রাজী। কেউ যদি তাদের বেত পণ্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হোন,তারা প্রয়োজনে স্বল্প পণ্য দিয়েও ব্যবসা শুরুতে সহযোগিতা করবেন।বিনিময়ে শুধু চায় প্রচার।
এমনকি অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে বেত পণ্য বিক্রি করার প্রসঙ্গ আসলে তারা জানান,”কেউ যদি দূরের পথের কারনে বেত পণ্য নিতে আগ্রহী না হোন,তাহলে চাইলে ফোনে যোগাযোগ করে নিতে পারবেন।অপরপাশের কেরানীগঞ্জ,ঢাকা থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে তাদের পণ্য মুন্সিগঞ্জ জেলায় পাঠানো হবে”
বর্তমানে দেশীয় পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প।গ্রামীন বাংলার পাকা হাতের এই সুক্ষ্ম কাজগুলো আজীবন ধরে উচ্চপর্যায়ের মানুষের বিলাসিতা চাহিদার একটা বিরাট অংশের অভাব পূরন করে যাচ্ছে সীমিত লাভে।এই ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের একটা অংশ হচ্ছে বেত শিল্প।আমার মনে হয় এই শিল্পকে বাচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য। একটু যোগাযোগের সুব্যবস্থা,পণ্যের প্রচার ও সরকারি সহায়তা পেলে মুন্সিগঞ্জের বেত শিল্প এগিয়ে যাবে অনেকদূর।
বর্তমানে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে আগ্রহী ও নবীন কাজ করা উদ্যোক্তারা বেত শিল্পে একটু নজর দিলেই এর ব্যপক প্রচার হতে পারে।